অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। স্বাধীন বাংলাদেশে চট্টগ্রাম থেকে তিনি প্রথম সরকার প্রধান হয়েছেন। তাই তাকে ঘিরে চট্টগ্রামবাসীর উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশাও বেশি। সবাই বলছেন, আঁরার ইউনূস, আঁরার প্রত্যাশা ত বেশি তাইবু (আমাদের ইউনূস, আমাদের প্রত্যাশা তো বেশি থাকবে।)
কী সেই প্রত্যাশা? নগরবাসীর সঙ্গে আলাপকালে তারা অনেক প্রত্যাশার কথা বলেছেন। এর মধ্যে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জানিয়েছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহসহ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) তিনটি প্রকল্প আটকে আছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সহযোগিতা পেলে লাভবান হবে কর্পোরেশন এবং সুফল পাবেন নগরবাসী। সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, চট্টগ্রামের ইংরেজি বানান পরিবর্তন করা হয় ২০১৮ সালে। পূর্বের বানানটি যেন আবার ফিরিয়ে আনা হয়। কারণ পূর্বের ‘চিটাগং’ বানানটির সাথে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য।
এছাড়া চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা, চট্টগ্রামকে পূর্ণাঙ্গ বা সত্যিকার অর্থে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হোক। পাহাড়, নদী এবং সমুদ্র রয়েছে চট্টগামে। ফলে পর্যটন শিল্পের বিকাশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। তাই চট্টগ্রামকে পর্যটন নগরী হিসেবে ঘোষণারও প্রত্যাশা আছে নগরবসীর।
এছাড়া চট্টগ্রাম শহরে ওয়ান সিটি টু টাউন করা, চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরে উন্নীত করা, বে টার্মিনালের কাজ দ্রুত শুরু করা, কর্ণফুলী টানেলের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং চট্টগ্রাম–কক্সবাজারের দূরত্ব কমানোর লক্ষ্যে আনোয়ারা–বাঁশখালীর ভেতর চার লেন রাস্তা করে কক্সবাজার সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার সড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করা, কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য ড্রেজিং করা, চট্টগ্রামে হাই কোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করা।
মেয়রের তিন প্রত্যাশা : সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হাসেন আজাদীকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে জোর দিচ্ছেন। খাল–নালা পরিষ্কারের সুবিধার্থে মেশিনারিজ এবং ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহে সিটি কর্পোরেশনের একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে আছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে এই প্রকল্পটি যেন পরিকল্পনা কমিশন হয়ে দ্রুত একনেকে অনুমোদন পায়। কারণ জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল–নালা পরিষ্কার এবং বর্জ্য অপসারণের জন্য ইক্যুইপমেন্ট এবং মেশিনারিজগুলো সংগ্রহ করা জরুরি। এগুলোর বিকল্প নেই। গত ৪ ফেব্রুয়ারি আমি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ওইদিনও বিষয়টি অবহিত করি।
মেয়র বলেন, প্রকল্পটি ৩৯৮ কোটি টাকার ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় ১০০ কোটি টাকা কমিয়ে ২৯৮ কোটি টাকা করে ফেলে। টাকা কমালেও চট্টগ্রামের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা চাই প্রকল্পটি যেন দ্রুত অনুমোদন হয়।
শাহাদাত বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের বাইরে থাকা ২০টি খাল সংস্কার করার জন্য পাওয়ার চায়নার সাথে কথা বলেছি। তারা আমাদের সাথে চুক্তি করে খালগুলোর সংস্কার কাজ করে দিতে চায়। এ বিষয়েও সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, এখন আমরা প্রাইমারি কাজ করছি। খাল ও নালা পরিষ্কার করতে পারছি না। ২০টি খাল পরিপূর্ণভাবে আমরা সংস্কার করতে চাই। সেটা আমাদের সেকেন্ডারি প্ল্যান। ২০টি খাল সংস্কার করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। পাওয়ার চায়না এ বিষয়ে অর্থায়নে রাজি হয়েছে, যদি সরকার এ বিষয়ে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে।
মেয়র বলেন, বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার বিষয়েও ইউকের একটি প্রজেক্ট গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সাবমিট করেছিলাম। এখন পর্যন্ত সেটারও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ প্রকল্পটিও দরকার শহরের জন্য। কারণ ময়লাকে সম্পদে পরিণত করতে পারলে এটাও জলাবদ্ধতার জন্য স্থায়ী একটা সমাধান হবে।
চট্টগ্রামের ইংরেজি বানান পূর্বেরটা বহাল রাখা : চট্টগ্রামের ইংরেজি বানান ছিল Chittagong. ২০১৮ সালে ৪ জুন প্রজ্ঞাপন করে Chattogram করা হয়। দাবি আছে, বানানটি পূর্বের ন্যায় Chittagong লেখা হোক। এ বিষয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম ঐতিহ্য রক্ষা পরিষদ লিখিতভাবে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে।
সংগঠনটির আহ্বায়ক ও সাবেক সিটি মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম অঞ্চল অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভৌগলিক তথা ঐতিহ্যগত দিক থেকে বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থিত। চট্টগ্রামের স্থানীয় কথোপকথনে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হতে কিছুটা গুণগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের একমাত্র চট্টগ্রাম জেলা, চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম বিভাগকে ইংরেজিতে Chittagong বলা হয়। বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের ইতিহাস–ঐতিহ্য মূল্যায়ন না করে স্বপ্রণোদিত হয়ে এককভাবে চট্টগ্রামের ইংরেজি Chittagong শব্দটা বাতিল করে দেয়। চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণের মনে আঘাত দিয়ে বিগত সরকার এই অন্যায় আদেশ প্রদান করে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও পূর্ব পকিস্তান সৃষ্টির শতবর্ষ পূর্বে Chittagong নামটি বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ Chittagong বন্দরের বয়স ১৩৫ বছর, Chittagong ক্লাবের বয়স ১১০ বছর, Chittagong কলেজের বয়স ১৫৫ বছর। এভাবে দীর্ঘদিন Chittagong নামটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত। আমাদের প্রত্যাশা, পুরনো Chittagong নামটি বহাল রাখার জন্য প্রধান উপদেষ্টা আন্তরিকভাবে হস্তক্ষেপ করবেন।
পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক রাজধানী করার দাবি : ব্যাংক ও বীমাসহ চট্টগ্রামের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার হেড অফিস চট্টগ্রামে স্থাপনেরও দাবি আছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন নগরবাসী। সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত বলেন, ২০০৪ সালে মন্ত্রিসভায় চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীর করার বিষয়টি পাশ হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক রাজধানী গত ২১–২২ বছরেও হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামের মানুষ, তাই তিনি চট্টগ্রামকে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক রাজধানী করার বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন। এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করবেন, যেখানে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো সরাসরি চলাচল করবে। ব্যাংক–বীমাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের প্রধান অফিস স্থাপন করবেন। একইসঙ্গে চট্টগ্রামকে পর্যটন সিটি হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
হাই কোর্টের বেঞ্চ স্থাপন : চট্টগ্রামে হাই কোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে অতীতে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে আশ্বাস দিলেও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামে হাই কোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন।
এ বিষয়ে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, অবশ্যই চট্টগ্রামে হাই কোর্টের সার্কিট বেঞ্চ থাকা উচিত। এখন খুব কষ্ট করে চট্টগ্রামের মানুষকে ঢাকায় গিয়ে হাই কোর্ট থেকে জামিন নিতে হয়। সার্কিট বেঞ্চ হলে সে কষ্ট দূর হবে।
হাই কোর্ট বেঞ্চ স্থাপন পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এস এম বদরুল আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণ–পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। ২০০৩ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবে ঘোষিত হয় চট্টগ্রাম। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হতে শুরু করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে চট্টগ্রামের জনগণের অবদান অনস্বীকার্য। এসব কারণে চট্টগ্রামে হাই কোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করতে হবে।
অন্যান্য : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরীয়া আজাদীকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে চট্টগ্রামবাসী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, একটি পরিকল্পিত নগরী গঠন করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। চট্টগ্রামের দুঃখ জলাবদ্ধতা নিরসনে পরিকল্পিত, সমন্বিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে চট্টগ্রামবাসীকে মুক্তি দেওয়া হোক। চট্টগ্রামের লাইফ লাইন এবং বাংলাদেশের একমাত্র মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদী সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড কর্ণফুলী নদী রক্ষায় দখল ও দূষণ থেকে মুক্ত করা হেক। চট্টগ্রামের জন্য উন্মুক্ত স্থান হিসেবে সিআরবি এবং সার্কিট হাউস মাঠকে সাধারণ জনগণের জন্য সংরক্ষণ করা হোক।
সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করে। এটা হলে চট্টগ্রামবাসী লাভবান হবে। তাই প্রাদেশিক কনসেপ্ট তাড়াতাড়ি বস্তবায়ন করা উচিত। তখন আমরা হাই কোর্টসহ সবকিছু পাব। রাজস্ব আয় চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি হবে।