ছেলে বাবাকে গাউন পরিয়ে দিচ্ছেন। অদূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করছেন মা। বাবা–মা দুইজনের চোখই ঝলমল করছে। এই বুঝি চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে। ছেলেও অনেকটা আবেগাপ্লুত। চবি শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত উচ্চ শিক্ষার পর সেই আনুষ্ঠানিক সনদ প্রাপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণ দুয়ারে কড়া নাড়ছে। সেই স্মৃতিকে ফ্রেমে বন্দী করতে ব্যস্ত ও প্রস্তুতির যেন শেষ নেই। গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সামগ্রিক দৃশ্য এটি। আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন।
এ সমাবর্তন ঘিরে কত কত আশা, প্রত্যাশা আর প্রস্তুতি। শত–সহস্র আবেগ আর স্মৃতির সম্মিলন এ সমাবর্তন। সমাবর্তনের দুইদিন আগ থেকে গাউন বিতরণ শুরু হয়েছে। এরমধ্যে অসংখ্য কনভোকি গাউন সংগ্রহ করেছে। কালো গাউন, টুপি আর হুড পেয়ে সবচেয়ে কাছের মানুষ, যাদের ভালোবাসায় পৃথিবীর মুখ দেখা সমাবর্তীরা সেই বাবা–মাকে নিয়ে স্মৃতি জমাচ্ছেন ক্যামরার পাতায়। নিজের গাউন পরিয়ে দিচ্ছেন বাবা–মাকে। যেন মনে হচ্ছে দীর্ঘশ্বাসে জমে থাকা প্রতীক্ষার বোঝা নামল। দীর্ঘ ৯ বছর পেরিয়ে, অবশেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে ২৩’শ একর জুড়ে। আজ চবির পঞ্চম সমাবর্তন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর শিক্ষার্থীরা তাদের গর্বের ডিগ্রি হাতে নিবেন। ঘুচবে আনুষ্ঠানিক সনদপ্রাপ্তির অপেক্ষার প্রহর। আর সঙ্গে ফিরছে পুরনো দিনের বুনো উচ্ছ্বাস, হাসি আর আনন্দাশ্রুর সম্মিলন।
কত ব্যাচ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সমাবর্তনের ডাক আসেনি। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যে মুহূর্তের জন্য প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বুক বাঁধেন, যে দিনটির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন হাজারো গ্র্যাজুয়েট, সেটিই ফিরে এলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। এই ক্যাম্পাসে হাজারো স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল, আজ তার পূর্ণতা পেতে চলেছে। কিন্তু এ কি শুধু একটি ডিগ্রির আনুষ্ঠানিকতা? না, এটি তার চেয়েও বহুগুণ বেশি–এ এক আবেগের বিস্ফোরণ, স্মৃতির জোয়ার, জীবনযুদ্ধের এক নতুন মাইলফলক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে, শহীদ মিনার, সাইন্স ফ্যাকাল্টি মসজিদ, বুদ্ধিজীবী চত্বর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, সেন্ট্রাল ফিল্ড, প্রতিটি হল প্রাঙ্গণ, প্রতিটি অনুষদ প্রাঙ্গণ, প্রতিটি ঝুপড়ি, ঝুলন্ত সেতু, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফরেস্ট্রি ও মেরিন সাইন্স ও ওশানোগ্রাফি অনুষদসহ প্রতিটি সড়ক–যেন শত শত পায়ের শব্দে কেঁপে উঠছে। যতদূর চোখ যায় শুধু কালো গাউনে উৎসবে মেতে উঠার সেই মুহূর্ত দেখা যায়। প্রায় এক দশক পর পুরোনো বন্ধুদের দেখা হওয়ার উত্তেজনা, শিক্ষকদের কাছে গিয়ে সেই পুরোনো হাস্যরসের মুহূর্ত খুঁজে নেওয়া, সবকিছুই যেন এক বিস্ময়কর বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। ক্যাম্পাস যেন ফিরে গেছে অতীতে–সেই দিনগুলো, যখন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গল্পগুজব হতো, পরীক্ষার আগের রাতে পড়ার টেবিলে হাহাকার চলত, একসঙ্গে স্বপ্ন দেখার দিনগুলো ফিরে এসেছে নতুন রঙে। অনেক কনভোকি আগেরদিন চলে এসেছেন ক্যাম্পাসে। তারা বন্ধুদের নিয়ে পুরো চষে বেড়াচ্ছেন। রাত কাটাবেন সেই স্মৃতিবিজড়িত হলে। ঢাকা থেকে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী এসেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে সাইফুল ইসলাম, আহমাদ সালমান, আহমেদ সুমনসহ আরও অনেকে। তাদের সাথে চবির আলাওল হলের পাশে একটি দোকানে দেখা হয়। যেটি সাঈদ ভাইয়ের দোকান হিসেবে শিক্ষার্র্থীদের নিকট পরিচিত। তারা জানান, আমরা একসাথে হলে ছিলাম। এ সাঈদ ভাইয়ের দোকানে অনেক আড্ডা দিয়েছি। অনেক রাতে বসে বসে এখানে গল্পে কেটেছে। জীবনের সোনালী মুহূর্ত ছিল সেগুলো। এখনো স্মৃতি রোমন্থনে সে সব দিনগুলো হাতড়ায়। তাই এখানে আসলাম আড্ডা দিতে। আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন অনেকে। তারা জানান, দীর্ঘ সময় পর এই সমাবর্তন আয়োজিত হয়েছে। অনেক আলোচনা সমালোচনা থাকলেও অবশেষে সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হচ্ছে। বহুদিন পর সবাই আবার একত্রিত হচ্ছে এটা এক আনন্দঘন মুহূর্ত।
ক্যাম্পাসের বাতাসে আজ বইবে অন্যরকম ঘ্রাণ। পুরো ক্যাম্পাস সেজেছে উৎসবের সাজে, বর্ণিল আলোকসজ্জা, ব্যানার, ক্যামেরার ক্লিক, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক প্রজন্মের উদযাপন। হাসির রোল, আনন্দের স্রোত, আড্ডার মজলিশে সেই পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া আর সেই ফাঁকে এসব ফ্রেমবন্দী করার জন্য ক্লিকবাজি আছেই।