উপজেলার সদরের প্রাচীনতম মীরসরাই কলেজটি আজও বৈষম্যের শিকার, জাতীয়করণ দাবি

আতিকুল ইসলাম লতিফী | সোমবার , ১২ মে, ২০২৫ at ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ

একদিকে পাহাড়ী বনভূমি আরেক দিকে সমুদ্র উপকূল। ভৌগলিকভাবে উপজেলার মধ্যবর্তী ও প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মীরসরাই কলেজটি প্রাচীনতমভাবে যেমন ঐতিহ্যমণ্ডিত নানান স্বাক্ষর বহন করে। আবার ফটিকছড়ি সংযোগ সড়ক সহ উপকূলাঞ্চলের বিভিন্ন ইউনিয়নের সংযোগস্থল হিসেবে কলেজটি বিভিন্ন শ্রেণি পেশা, গোষ্ঠী ও বর্ণের মানুষের জন্য অনেক গুরুত্ব বহন করে। এখানকার পাশ্ববর্র্তী অঞ্চলেই রয়েছে পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ উপজাতীয় কিছু জনপদ, আবার অনেক জেলে তাঁতি পরিবার থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের বৃহৎ জনপদ এলাকার একমাত্র অবলম্বন এই মীরসরাই কলেজ।

পাকিস্তানের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আলহাজ্ব মাহফুজুল হক ১৯৭৩ সালে এই কলেজের যাত্রা শুরু করলেও নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কলেজটি আজো জাতীয় করণের কাছাকাছি পৌঁছেও পারেনি লক্ষ্যে পৌঁছাতে। প্রতিবছর শত শত শিক্ষার্থী জিপিএ৫ অর্জন করেও অগনিত শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে গেরৈবান্বিত পদে অধিষ্ঠিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে সচিবালয়, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বিভিন্ন পেশায় তো রয়েছেন অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ যাঁরা এখনো এই কলেজটির জাতীয়করণে প্রত্যাশা মনে প্রাণে পোষণ করে, রহস্যজনকভাবে বৈষম্যতার শিকার বলে নীরব। উক্ত কলেজের ছাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর শওকত আলী বলেন, আমি এই কলেজের ছাত্র বলে গর্বিত কিন্ত মন খারাপ হয় যখন নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নানা ভাবে গৌরবোজ্জ্বল থাকার কথা থাকলে ও সরকারের সুদৃষ্টি থেকে পিছিয়ে রয়েছেন। চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার মীরসরাই কৃষি, পর্যটন, ব্যবসাবাণিজ্য এবং শিল্পসমৃদ্ধ উপজেলা। উপজেলার শিক্ষা বিস্তারে যে কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে তার মধ্যে মীরসরাই কলেজ অন্যতম।

পাকিস্তানের প্রাক্তণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আলহাজ্ব মাহফুজুল হক এবং তদীয়পুত্র বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি থেকে নির্বাচিত দুই দুইবারের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব এম এ জিন্নাহ এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধুমাত্র এই রাজনৈতিক বিবেচনায় মীরসরাই কলেজকে জাতীয়করণ থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই কলেজ জাতীয়করণ না হওয়ায় অত্র কলেজের শিক্ষার্থীরা আজও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম জেলার প্রবেশদ্বার হচ্ছে মীরসরাই উপজেলা। এ উপজেলার হেড কোয়াটারে ঢাকাচট্টগ্রাম ট্রাংক রোডের পূর্ব পার্শ্বে এবং মীরসরাই ফটিকছড়ি রোডের উত্তর পার্শ্বে এক মনোরম পরিবেশে ঐতিহ্যবাহী মীরসরাই কলেজটি অবস্থিত। প্রায় ৬ লক্ষাধিক লোক অধ্যুষিত মীরসরাই উপজেলা শিক্ষার পাশাপাশি শিল্প, কৃষি ও ব্যবসাবাণিজ্যে ক্রমউন্নতির পথে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল এ উন্নতিকে আরও ত্বরান্নিত করবে। এ শিল্প অঞ্চলকে ঘিরে দেশীবিদেশী লক্ষলক্ষ লোক মীরসরাই সদরে অবস্থান করছে। ফলে সদরের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৯৭৩ সালে মীরসরাই কলেজ স্থাপিত হয়। ১৯৮৪ সালে এ কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। ২০১৭১৮ শিক্ষাবর্ষে হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা এবং ২০১৮১৯ শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে সম্মান কোর্স চালু করা হয়। পাহাড় নদী ও সাগরের কোলাশ্রিত এই মিরসরাই উপজেলা। খৈয়াছড়ার পাহাড়ী ঝর্ণার জলস্রোতের সুরমূর্চ্ছনা, পাহাড় নিঃসৃত জলধারার নয়নাভিরাম মহামায়া লেক আর বঙ্গোপসাগরের সন্ধীপ চ্যানেলের গর্জন ধ্বনির সাহসী উচ্চারণের নিত্য সাথী, ১৭ হাজার একর চর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক জোন, সবকিছু মিলিয়ে মীরসরাইয়ে উন্নত জীবনবোধ সম্পন্ন্র শ্রেণির সম্মীলন ঘটেছে। সড়ক, রেল এবং সন্ধীপ চ্যানেলের নাব্যতায় জলপথ যোগাযোগ এ উপজেলাকে সমগ্র দেশের সহিত যোগাযোগের এক চমৎকার বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছে। এ কারণে বিভিন্ন জেলার ছাত্রছাত্রীরাও আমাদের এ মীরসরাই কলেজে সহজে আসাযাওয়ার বাস্তবতায় এক অনাবিল পরিবেশে অধ্যয়নের সুযোগ প্রাপ্তিতে পুলকিত। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতি ও তফসীলি সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষার্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

মীরসরাই উপজেলা সদর ও পৌরসভার উন্নতি এবং শ্রীবৃদ্ধির সাথে এ কলেজের উন্নতি জড়িত। সকল পর্যায়ের সরকারি চাকরিজীবীদের ছেলেমেয়েরাও এই কলেজে পড়াশোনা করে থাকে। ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছাস ও প্রবল বর্ষণজনিত বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সমুদ্র উপকূলবর্তী এবং নিম্নাঞ্চলবাসী দুস্থ জনগণ তাদের মূল্যবান গৃহসামগ্রী, গবাদিপশু এবং পোষ্যবর্গকে নিয়ে মীরসরাই কলেজে আশ্রয়গ্রহণ করেন। এছাড়া যে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের উপজেলা পর্যায়ে সাময়িক অবস্থান কিংবা সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নিমিত্তে বিশেষ করে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে কলেজ ভবন ও আঙিনা ব্যবহার মীরসরাই কলেজকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এশিয়ার সর্ববৃহৎ জোন মীরসরাই ইকোনোমিক জোন। এ অঞ্চলের সাথে বদিউল্লাহপাড়া সড়ক হয়ে ওবায়দুল্লাহ এভিনিউ অতিক্রম করে সদরে আগমন, চরশরৎ ও ৬নং ইছাখালী থেকে সদরে আগমনের সংযোগ সড়কগুলোর এক মিলন কেন্দ্র সদর হওয়ায় মীরসরাই কলেজকে জাতীয়করণ সময়ের দাবি।

উপজেলার অর্ধশত উচ্চ বিদ্যালয় ও দাখিল স্তরের শিক্ষার্থী, পার্শ্ববর্তী উপজেলা এবং পাহাড়ী অঞ্চলের অধিবাসীদের সন্তানরা এই কলেজে স্বাচ্ছন্দে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে। গরীব, মেধাবী, উপজাতি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের পারিবারিক সদস্যগণ বিনা বেতনে অধ্যয়নের পাশাপাশি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ বইখাতাকলম, শিক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করে উচ্চ শিক্ষা লাভে নিরন্তর উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছেন।

সরকারি স্টেডিয়ামের সীমানাঘেঁষা, নীল জলরাশি সুবিশাল দিঘির পাড়ে সবুজ বৃক্ষরাজির ছায়াবেষ্টিত মনোরম পরিবেশের এ কলেজটি বিভিন্ন সময় ও পর্যায়ে আলোচনার ধারাবাহিকতায় সর্বাগ্রে বিবেচিত হওয়ায় সরকারিকরণের তালিকায় উক্ত কলেজের নাম থাকা যুক্তিসংগত। তাই উপর্যুক্ত তথ্যাবলির আলোকে উপজেলা হেড কোয়ার্টারে অবস্থিত মীরসরাই কলেজকে আশু জাতীয়করণ করার প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত মীরসরাই কলেজটি বেসরকারি পর্যায়ে উপজেলার প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ কলেজ। অত্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিভাগ এবং স্নাতক পর্যায়ে বিএ, বিএসএস, বিবিএস (পাস) কোর্স চালু রয়েছে। হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে। সর্বশেষ মে’ ২০২৫ পর্যন্ত চলতি সেশানে এই কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩২০০ (তিন হাজার দুইশত)। একদল মেধাবী, দক্ষ ও নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক মণ্ডলীর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত এইচএসসি, স্নাতক (বিএ ও বিএসএস) এর স্টাডি সেন্টার চালু আছে। অত্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত স্নাতক (পাস) ও স্নাতক (সম্মান) এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত এইচএসসি প্রোগ্রাম ও বিএ,বিএসএস প্রোগ্রামের পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে।

ইতোমধ্যে কলেজটি জাতীয়করণে অন্তর্ভুক্তির জন্য তৎকালীন মীরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিগত ১৭/১২/১৯৮৫ তারিখে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে এবং ০৯/০৬/১৯৮৭ তারিখে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক স্মারক নং ৫৩৩/৮৭ শিক্ষামূলে শিক্ষা সচিব বরাবর আবেদন জানান। ১৯৭৬ সনে তৎকালীন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান মীরসরাই থানা পরিদর্শনে এসে মীরসরাই কলেজকে জাতীয়করণের আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। ১৯৯২ সনের তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী উপজেলার এক জনসমাবেশে মীরসরাই কলেজকে জাতীয়করণ করার যাবতীয় সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তৎকালীন সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা বিগত ০৬/০৫/১৯৯২ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বলেছিলেন, যে সকল উপজেলায় সরকারি স্কুল ও কলেজ নেই সেসব উপজেলায় একটি স্কুল ও একটি কলেজ জাতীয়করণ করা হবে। এমতাবস্থায় চট্টগ্রাম, মীরসরাই এর তৎকালীন সংসদ সদস্য এম এ জিন্নাহ এর ২৫/০৭/৯২ তারিখে মীরসরাই কলেজকে জাতীয়করণের আবেদন করায় উক্ত আবেদনে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বিধি মোতাবেক মীরসরাই কলেজকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয়করণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেন। ২০১৬ সালে এ কলেজকে জাতীয়করণের দাবিতে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, উপজেলা হেড কোয়ার্টারে অবস্থানসত্ত্বেও অত্র কলেজটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে জাতীয়করণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ ও বর্তমান সভাপতি, মীরসরাই কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঢেউয়ের তোড়ে
পরবর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক নার্স দিবস ২০২৫ : সেবার ছায়ায় লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি