সম্প্রতি দেশে আকস্মিকভাবে অপরাধমূলক ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। লোভ–লালসা, নারী ও সম্পত্তি নিয়ে বিরোধসহ বিভিন্ন নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলছে। প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ দুই নারী শিক্ষার্থীকে দেখে হাসাহাসি করার জেড়ে এই হত্যাকাণ্ড। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দল রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় দোকানে এসে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সুমনকে হত্যা করে চলে যায়। ফিরোজপুরের হারুণ কাউছার (২০) ঢাকায় এসে কারখানায় কাজ করে পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে চেয়েছিলেন। সেই কাউছার ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন। কিশোর অপরাধ নিয়ে দেশের জাতীয় পত্রিকার সংবাদ হেডলাইন, ‘কুমিল্লায় বেপরোয়া কিশোর গ্যাং’, ৮ বছরে ১২ হত্যাকাণ্ড–সংঘর্ষ–হানাহানি ঘটছে অহরহ, ২০টির বেশি গ্রুপের দৌরাত্ম্য, ১৪ থেকে ২০ বছরের কিশোর–তরুণরা জড়িত, আধিপত্য বিস্তারে অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া, স্কুল–কলেজকেন্দ্রিক গ্রুপগুলো খুন–জখমেও লিপ্ত——। (খবরের কাগজ–২৭ এপ্রিল–২০২৫ই) এলাকা বদলে তৎপর কিশোর গ্যাং ইত্যাদি ইত্যাদি। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলো দেখলে যে কেউ আতকে উঠবে।
বর্তমান সময়ে দেশের সমাজ ব্যবস্থায় অবক্ষয়ের যে ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে, নৈতিকতার বিপর্যয়ে যেভাবে রোগাক্রান্ত পুরো মানব সমাজ এত্থেকে উত্তরণ জরুরী। সাম্প্রতিক সময়ে পিটিয়ে হত্যা, নারী –শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, শ্লীতাহানি, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হামলা, দখল, চোরাচালান, মাদক ব্যবসার মতো অন্তত ১১ ধরনের অপরাধ মূলক ঘটনা বেড়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে জোরালো পদক্ষেপ না থাকায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘সমাজে অপরাধমূলক নানা ঘটনায় স্পষ্ট যে মানুষ কতটা অসহিষ্ণু এবং ভুক্তভোগীরা কত অসহায়।’ আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্বে ঘাটতির বিষয়টিও দৃশ্যমান। দায়িত্বশীলদের সঠিক জবাবদিহির আওতায় না আনায় ও আইন মেনে চলার চর্চা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা এসব ঘটনার পেছনে অনেকাংশে দায়ী বলে তারা মনে করছেন।
কিশোর অপরাধের সবচেয়ে বড় কারণ হলো পারিবারিক অসচেতনতা। শিল্পোন্নত ও পুঁজিবাদী সমাজের মতো বর্তমানে স্বল্পোন্নত সমাজেও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে বিদ্যমান হতাশা, নৈরাজ্য আর দারিদ্র কিশোর অপরাধ সৃষ্টির প্রদান কারণ। শহরের দূষিত পরিবেশ মানবেতর জীবনযাপন ও অশিক্ষা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য কিশোরদের চুরি, ছিনতাই, পকেটমারের মতো অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করে। মূলত সামগ্রিকভাবে কিশোর অপরাধের প্রধান কারণগুলো হলো, (ক) ভগ্ন পরিবার ও পিতামাতার দাম্পত্য কলহ যেখানে আবেগ, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে, (খ) চরম দারিদ্র্য ও পিতামাতার অবহেলা শিশুশ্রম ও জোরপূর্বক শিশুকে কাজে বাধ্য করা, (গ) খারাপ সঙ্গীর সাথে চলাফেরা করা পারিবারিক অস্থিতিশীলতা ও অসম্প্রীতি, (ঘ) পিতা বা মাতার পুন:পুন: বিবাহ, (ঙ) মা কর্মজীবী হওয়ায় পর্যাপ্ত শিশুযত্নের অভাব, (চ) অতিরিক্ত শাসন, রক্ষণশীলতা ও বাবা–মার পরস্পরবিরোধী মানসিকতা, রাজনীতিবিদ কর্তৃক কিশোরদের পিকেটিং এ ব্যবহার, সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। এসব কারণে সমাজ কলুষিত হচ্ছে, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত।
এক সময়ে কিশোরদের অপরাধে শীর্ষে ছিল, চুরি আর পকেটমার। বর্তমানে তারা ক্রমশ মাদক, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মারামারির ন্যায় অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। সন্তানদের যদি আমরা সত্যিকারভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ মনে করি, তাহলে কঠিন এ সময়ে নিশ্চুপ বসে থাকলে চলবে না। যে অবস্থায় আমরা এখন আছি, একে সামাজিক অবক্ষয়ের বিপজ্জনক পর্যায় বলা যেতে পারে। এত্থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে। কিশোরেরা যখন ভয়ানক সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তখন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারে না।
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র আর শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত করে রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার স্বার্থেই রাষ্ট্র যদি নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ায় ব্যর্থ হয় তাহলে রাষ্ট্রটিই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কোন সময় দেখা যায় রাষ্ট্রীয় একটি শ্রেণি কিংবা গোষ্ঠীকে নির্যাতনের লক্ষ্যে ক্রীড়ানক হয়ে ওঠে, আবার অনেক সময় দেখা যায় রাষ্ট্র আর আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় কিংবা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের মধ্যে বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়। আইনের শাসনের ঘাটতি দেখা যায় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিও বলবৎ থাকে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, খবরের কাগজ, খুললেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্র ওঠে আসে। অর্থাৎ নিরাপত্তা শৃঙ্খলায় রয়েছে দেশের জনগণ, যে কোনো সময় আক্রান্ত হওয়ার ভয় মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অপরাধ কেন বাড়ছে? সম্প্রতি একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, চুরির তুলনায় ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বাড়ছে। খুনের ঘটনা বাড়ছে ব্যাপকভাবে। অনেকেই খুনের ঘটনাকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলে চালিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা এমন যে, রাজনৈতিক মোড়ক ব্যবহার করলে খুনের ঘটনা থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ব্যাপারগুলো আদতেই এমন হওয়া উচিত নয়, রাষ্ট্রকে তার নিজস্ব নীতিতে পরিচালিত হতে দেওয়া উচিত।
অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই অপরাধীরা বার বার অপরাধ করছে। দেখা যাচ্ছে চিহ্নিত দাগী আসামিরা প্রকাশ্যে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার অন্যদিকে জামিনযোগ্য মামলায় আসামিরা জামিন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এসব ব্যবস্থাপনা আইনের শাসনের অন্তরায়। আইনকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে; আইন সর্বজনীন। আইন ব্যবস্থপনায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। আইন বিভাগ স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে পথ চলতে পারলে অবক্ষয়মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ অসম্ভব কিছু নয়।
রাষ্ট্রের জনগণ কখনো আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না, রাষ্ট্রের জনগণ যদি আইনহাতে তুলে নেয় তাহলে রাষ্টের কার্যকারিতা প্রকারান্তরে নষ্ট হয়ে যায়। কেউ অপরাধ করলে তার বিচার করবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নির্দিষ্ট আইনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। মব জাস্টিসের নামে কেউ বা কোনো গ্রুপ ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম পরিচালিত করলে সেটি কোনোভাবে রাষ্ট্র বরদাশত করতে পারে না। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মব জাস্টিসের অনেক ঘটনার বিচার হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে যেমন হয়রানি করা যায় না ঠিক তেমনিভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলাও মওকুফ করা যায় না। যেকোনো ধরণের অবৈধ চর্চা একটি রাষ্ট্রের স্থিতির জন্য অশনিসংকেত। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক করা যাবে না।
যখন মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম পর্যায়ে পৌঁছে, সমাজ থেকে নৈতিকতা নির্বাসনে যায়, আইন–শৃঙ্খলা রক্ষায় রাষ্ট্রের দুর্বলতা বড় হয়ে দেখা দেয়, তখনই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ–নিপীড়ন, বেড়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখনো প্রধান চ্যালেঞ্জ দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। নিরাপদে বসবাস করা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর মানুষের সেই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। খুন খারাবির–ধর্ষণ–মব জাস্টিস যাই বলি না কেন এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে জনমনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তীব্র হয়ে উঠবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, ‘অপহরণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও অসামাজিক কার্যকলাপ এবং মব জাস্টিসদের বিরুদ্ধে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে। কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠীর নামে কিংবা ছদ্ম নামে চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করলে অপরাধীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।
আমাদের প্রত্যাশা। অবনতিশীল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কঠোর হস্তে দমন করা হবে অপহরণ–চাঁদাবাজি–সন্ত্রাসী– মব জাস্টিস–যৌন হয়রানির ন্যায় সব ধরণের অপরাধ।
আমাদের সন্তানদের যদি আমরা সত্যিকারের ভবিষ্যৎ মনে করি, তাহলে কঠিন এ সময়ে নিশ্চুপ বসে থাকলে চলবে না। কিশোরো যখন ভয়ানক সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তখন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, কেউ মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারে না।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক– শিল্পশৈলী।