যুদ্ধ হোক বা না হোক উপমহাদেশে এখন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। মনে হচ্ছে যুদ্ধ বুঝি লেগেই গেল। যুদ্ধ কোন সমাধান না। কিন্তু মাঝে মাঝে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমরা যারা কিশোর বেলা পার করার সময় মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি আমরা জানি যুদ্ধ কেন হয়। কি কারণে যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আবার আমাদের শৈশব আর যৌবনে বহু যুদ্ধ দেখেছি যার কোনো কারণ ছিল না। চট্টগ্রামে তখন একটি মাত্র স্টেডিয়াম। এর নাম এখন পরিবর্তন করা হয়েছে শুনলাম। বর্তমান নাম কি আমি নিশ্চিত না বলেএটি আমার কাছে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামই থাক। এর আউটার স্টেডিয়াম তখন ফাঁকা মাঠ। বিশাল ময়দান। আরেকদিকে এখন যে খানে নেভিদের কোয়ার্টার সেটি ছিল হেলিপ্যাড। মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার এসে নামতো ওখানে। আমার শৈশবে ওসব ময়দানে হঠাৎ গর্ত খোঁড়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। গর্তগুলো ছিল নানা ধরনের ইংরেজী অক্ষরের মতো। এল. কে, আই এমন সব অক্ষরের মতো সাজানো গর্তগুলো করা হয়েছিল বিমান হামলা হলে মানুষ যেন সেখানে লুকাতে পারে। পাক ভারত যুদ্ধের সেই ডামাডোলে মাঝে মাঝে সাইরেন বাজতো। আমরা প্রবল উৎসাহে সেসব গর্তে গিয়ে লুকাতাম। মূলত তখনকার পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশে কোন যুদ্ধ হয় নি। সেই বাঁশী আর লুকানো ছিল রিহার্সেলের অংশ। পরে এটা নিয়ে ব্যাপক মজা করতাম আমরা।
যুদ্ধ কোন আশাব্যঞ্জক ঘটনা না। আজকের দুনিয়ায় আরেক বিপদ হচ্ছে যারা যুদ্ধ চায় বা তৈরী করে তারা যুদ্ধ শেষ করে না। কেন করে না? এক দল যারা বিশ্বমুরুব্বি নামে পরিচিত তারা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে যুদ্ধ থামায় না। ভিয়েতনাম বা কোরিয়া যুদ্ধের দিন শেষ। এখন ইউক্রেন বা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে দেখবেন যুদ্ধ মানে সাধারণ মানুষের ভয় মৃত্যু আর অশান্তি। মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হবে কিন্তু তাদের সরকার যুদ্ধ বন্ধ করবে না । চাইলেও করতে পারবে না। শক্তিধররা মুখে বলবে নো ওয়ার। কিন্তু কাজে র বেলায় দেবে যুদ্ধের মাল মশলা। আমার ধারণা পাক ভারত যুদ্ধ ও শেষতক হবে না। আর হলেও তার অবসান কোথায় কেউ জানে না। তাই আপাতত যুদ্ধের বিভীষিকা বা ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণের জন্য কিছু সংগৃহীত গল্প পেশ করি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই মজার ঘটনাটি ঘটেছিলো ফ্রান্সের এক যুদ্ধের ময়দানে। ব্রিটিশ সৈন্যরা সারাদিন ক্লান্তিকর যুদ্ধের পর তারা রাতের অন্ধকারে শত্রুপক্ষের ক্যাম্প থেকে খাবার চুরি করবার পরিকল্পনা করে।
ব্রিটিশ কিছু সৈন্য রাতে লুকিয়ে শত্রু ক্যাম্প থেকে কিছু খাবারের প্যাকেট নিয়ে দ্রুত নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে আসে। আনন্দের সাথেই ব্রিটিশ সৈন্যরা প্যাকেটের সেসব খাবার খেতে আরম্ভ করে। কিছুক্ষণ পর তারা বুঝতে পারে তারা যে খাবারটি খাচ্ছে সেটি কোনো মানুষের জন্য তৈরি খাবার নয়, এটি মুরগীদের জন্য তৈরি বিশেষ খাবার। এই খাবার খাওয়ার পর সৈন্যাদের মাঝে অস্বস্তি তৈরি হয়। এই ঘটনা তখন তাদের সকলের মাঝে এক হাস্যরস তৈরি করে। খুব দ্রুতই এই ঘটনা পুরো ব্রিটিশ ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে, পুরো ক্যাম্পে তখন হাস্যরসের সৃষ্টি করে যা তাদের যুদ্ধের ক্লান্তি কিছুটা হলেও লাঘব করেছিলো। পরবর্তীকালে সৈন্যরা এই ঘটনার কথা স্মরণ করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতো।
অস্ট্রিয়ার ভুল যুদ্ধ ঘোষণা (১৮৭৮)
১৮৭৮ সালের ঘটনা, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের সৈন্যরা ভুলবশত নিজেদের দেশেরই একটি শহরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বসে। ১৮৭৮ সালে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য ‘বসনিয়া–হার্জেগোভিনার’ দখল নেয়। তখন এই অঞ্চল ছিল তুর্কিদের অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে, অটোমান সাম্রাজ্যের তখন শক্তি কমে এসেছে তারা এই অঞ্চল অস্ট্রিয়াকে দিয়ে দেয়। আর তাই বসনিয়া পুরোপুরি নিজের দখলে নিতে অস্ট্রিয়ার সৈন্যরা সেখানে সামরিক অভিযান চালায়।
অভিযান চালানোর সময় অস্ট্রিয়ার একটি সেনাদল ভুল মানচিত্র ও ভুল দিকনির্দেশনার কারবে নিজেদেরই সীমান্ত শহর Schwechat কে শত্রু এলাকা মনে করে আক্রমণ করে বসে। তারা শহরের বিভিন্ন এলাকাকে উদ্দেশ্য করে কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রযুক্তির তখনো অতোটা উন্নতি ঘটেনি। বেডিও, টেলিগ্রাফের মতো যন্ত্রগুলো তখনো সহজলভ্য হয়ে উঠেনি। এমন পরিস্থিতিতে সৈন্যরা দ্রুত ও নিরাপদে তথ্য আদানপ্রদান করতে পায়রা ব্যবহার করতো। নির্দিষ্ট স্থানে বার্তা প্রেরণের জন্য তারা পায়রাগুলেকে বিশেষ ট্রেনিং দিতো। একবার একটি পায়রার মাধ্যমে মিত্রবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পাঠানো হচ্ছিলো। বার্তাটি ছিলো শত্রু পক্ষের কাছাকাছি থাকা মিত্র বাহিনীকে সতর্ক করার জন্য। কিন্তু পায়রাটি ভুল করে শত্রু পক্ষের ক্যাম্পে পৌঁছে যায়।
শত্রুরা বার্তাটি পড়বার পর তাদের কাছে এই বার্তা এতোটাই অদ্ভুত ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে যে হাসতে হাসতে তারা নিজেদের কাজই ভুলে যায়। চিঠিতে কি ছিলো তা এখনো পুরোপুরি অস্পষ্ট, তবে এই হাসাহাসি অসাবধানতার কারণে মিত্রবাহিনী আক্রমণের জন্য সুযোগ পায় এবং সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয় তাদের জন্য।
এখন দিন বদলেছে। যুদ্ধ এখন বাটন বা বোতাম নির্ভর। একদল বোতাম চিপলেই আরেক দলের ঘরবাড়ি শহর গ্রাম উড়ে যাবে। পড়ে থাকবে ছিন্নভিন্ন মানুষের শরীর। থাকবে ধ্বংসস্তুপ। আমরা কি তেমন পরিস্থিতি চাই? যারা জ্ঞানে বিজ্ঞানে এগিয়ে যাদের নাটক সিনেমা লেখালেখি বা সভ্য জীবন আছে তারা কি চাইবে তাদের সুখের ঘরে আগুন লাগুক? যদি না চায় তারা যুদ্ধ বাধাবে না। আর আক্রান্ত হলে তারা একা কেন লড়বে? তাদের সাথে থাকবে দেশের মানুষ থাকবে বিশ্ব জনমত।
যাদের থালা আছে ভাত নাই, যাদের দেশ আছে টাকা নাই। যাদের ধর্মের নামে উন্মাদনা আছে বিশ্বাস নাই তারা যুদ্ধ করতে চাইবে। আমরা যুদ্ধ চাইবো না। আমাদের কথা পরিষ্কার। এক ইউরোপে এমন কিছু দেশ আছে যারা বছরের পর বছর যুদ্ধ করেছিল। যাদের ক্রোধ বা আক্রোশ এখনো নানা কারণে দেখা যায়। কিন্তু তারা আর যুদ্ধ করে না। তারা জানে বাঁচতে হলে সবাই মিলে বাঁচতে হবে। তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন করেছে। একক মুদ্রা করেছে। ভিসা ছাড়া যাতায়াত করছে। তারা পারলে এশিয়া কেন পারবে না? একটা গল্প দিয়ে শেষ করি।
সৈয়দ মুজতবা আলী তখন প্যারিসে। ট্যাকসি চড়ে যাচ্ছিলেন থিয়েটার দেখতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চলছিল। মাঝপথে সাইরেন আর বিমানের আনাগোনায় তাদের ফিরতে হলো হোটেলে। মুজতবা আলী সুরসিক মানুষ। প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বলতো এই যুদ্ধে যদি জার্মানরা হেরে যায় কি হবে? ড্রাইভার জবাব দিলেন–ভালো হবে। তবে দুনিয়া থেকে বীরের জাতি মুছে যাবে। আর যদি ফ্রান্স হেরে যায়? লোকটি বললো: শিলপ সংস্কৃতি আর্ট কালচারের বারোটা বেজে যাবে। আর যদি ইংরেজ হারে? লোকটি মৃদূ হেসে বলেছিল: যদি হারে? অন্তত বেঈমানি দেশভাগ কমে যাবে। গল্পটা এখনো যুদ্ধ যুদ্ধ কালে মনে পড়ে। হায়রে যুদ্ধ!
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।