সংগীত একটি প্রাচীন শিল্পকলা যা প্রাগৈতিহাসিক কালে শুরু হয়েছিল এবং এটি সারা বিশ্বের প্রতিটি মানব সংস্কৃতির ইতিহাস বহন করে। শব্দ, সুর, সাদৃশ্য, ছন্দ, চলন, গঠন বা রূপ সংগীতের মৌলিক কাঠামো।
সংগীত এমন একটি শিল্পকলা যা কন্ঠস্বর বা যন্ত্রের শব্দ কখনো কখনো উভয়কেই একত্রিত করে একটি ধারণা প্রকাশের জন্য। সংগীত মানুষের আত্মার সাথে কথা বলে। ছন্দ, শব্দকে একত্রিত করে একটি কার্যকরী সুরের ধারা সৃষ্টি করে যা সময়ের সাথে সাথে প্রতিটি মানব সংস্কৃতির ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।
ইতিহাস জুড়ে প্রতিটি সংস্কৃতি সংগীতকে জীবনের একটি প্রাথমিক উপাদান হিসেবে ঘকরে তুলেছে। যুগ যুগ ধরে সংগীত মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে মৌলিক স্তরে স্থানান্তরিত হয়েছে কিন্তু আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যে রেকর্ড করা সংগীত ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মধ্যযুগীয় সন্ন্যাসীদের লিখিত ঐতিহ্যের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল।
স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত ‘সংগীতের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে দীন নাথ সেনের প্রবন্ধ গানের কাল কালান্তর‘ পৃ–১৬৯ এ উল্লেখ করেছেন, সব আওয়াজই শেষ পর্যন্ত গান। শব্দবিজ্ঞান অবশ্য শ্রবণ ক্ষমতার মাত্রা মেপে ডেসিবেলের মাপ ঠিক করে দিয়েছে।এই সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে আমরা শ্রবণসহ বিবিধ পশুপাখির আওয়াজের মিষ্টত্ব খুঁজে পেয়েছি। ঝিঁঝিঁ, ঘুঘু, কোকিল, ময়ূর এমনকি ব্যাঙ সবার ডাকে আহা উহু উচ্ছ্বাস শোনা যায় গানে, কবিতায়। ওই সঙ্গী সান্নিধ্যের ব্যাকুলতার আওয়াজই মানুষের কানে গান হয়ে বাজে। শুধু প্রাণী কেন, গান বাজে জড়বস্তুর আঘাতে, কম্পনে, ঘর্ষণে।
তবলায় আঘাত, বাঁশীতে ফু, হারমোনিয়ামের বেলো, করতালে ঘর্ষণ এসব তো সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ অথবা উৎস সঙ্গী। কালজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর রবিশংকর প্লেগ রোগ চলচ্চিত্রে দেখিয়ে দিয়েছেন শ্রমজীবীর হাত ও পায়ের কারুকৃতিতেও রাগ রাগিনীর সুর বাজে।
আমরা এমন বক্তব্যের অনুকূলে আমাদের চট্টগ্রামের বহুল জনপ্রিয় আঞ্চলিক গানের মহান স্রষ্টা মানব দরদী সুর সাধক এম এন আখতার রচিত ‘এম এন আখতারের গান’ বইয়ের মলাটে তাঁর লিখিত বক্তব্যে পাই, ‘আদি কালে গান বলে কোন শব্দ ছিলনা। গান মানেই সুর। বিজ্ঞানীরা যখন জানলেন সুর বলে একটি মহান শক্তি বাতাসের মত পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এবং প্রাণীজাত তথা মানবদেহের সাথে সম্পৃক্ত মুখে প্রকাশ পায়। যেমন কোকিল, শেয়াল, মোরগ, ডাকে, পাঁচ ওয়াক্ত আজানের সুর কতটা মধুর, সুন্দর! তারা কি সংগীত চর্চা করেছিল? এই সুর হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথের মেজাজ। যার গতি আছে, লয় আছে, দোল আছে, ছন্দ এবং সুর আছে’।
তাঁর কাছে সুরেলা কথা হচ্ছে গান। সুর ছাড়া গান নয়। তাই প্রতিটি মানুষের কলব বা অন্তর পরিষ্কার করার জন্য অন্তত দু এক লাইন সুরেলা গান মুখে আওড়ানো উচিত। আমরা জানি সারা বিশ্বের দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে, গোত্রে গোত্রে, এমন কি প্রতিটি মানব সংস্কৃতির ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে সংগীত।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের লোকসংগীতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারি গানের প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা রয়েছে দেশে এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের মাঝে।
সত্তর দশকে চট্টগ্রামের গানে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলেও ১৯৩৪ সালে জগন্ময় মিত্রের তত্ত্বাবধানে কোলকাতা থেকে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গ্রামোফোন রেকর্ডে আহমুদুল হক সিদ্দিকী রচিত ও চট্টগ্রামের আর এক কিংবদন্তী শিল্পী মোঃ নাসিরের সুরে ও কন্ঠে প্রকাশিত হয়,
চান মুখে মধুর হাসি অ ভাই
দেবাইল্যা বানাইলরে
মোরে সাম্পানর মাঝি। এ গান।
অবশ্য নানাবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, উচচ, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণীর শ্রোতার মন মানসিকতা এবং নব্য আধুনিক গানের জোয়ার, পঞ্চকবির গান, প্রচলিত লোকসংগীতের প্রাবল্যের কারণে এ গানের শ্রোতা, উপরন্তু গ্রামোফোন, রেডিও বা প্রচার মাধ্যমে না আসার কারণে মানুষের কানে পৌঁছাতে সময় লেগেছে যা সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে বেতার ও গ্রামোফোন ও মাইকের কারণে শ্রোতাদের কানে মনে পৌঁছায়। যার আজ রমরমা অবস্থা। যে কোন অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের আনঞ্চলিক গান গাইতেই হবে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের কথা, তখন নতুন করে আবার সাংস্কৃতিক জোয়ার শুরু হয়ে যায় শহর ছাড়িয়ে গাঁও, গেরাম, গঞ্জসহ সর্বত্র ।
যাত্রা, নাটক, ভ্যারাইটি শো, সার্কাস সঙ্গে প্রিন্সেসদের উন্মাতাল নৃত্য। শুধু সঙ্গে বাজতো একটি হারমোনিয়াম, তবলা, করণেট ও পায়ে থাকতো ঘুঙুর।
ওরে সাম্পানওয়ালা সম্পর্কে বলার সংগত কারণে এখানে উল্লেখ করা যায় যে, আমার বাবার নামে গ্রামে ঐতিহ্যগত ভাবে প্রতি বছর বৈশাখে বসতো ‘রাজামিয়ার বলিখেলা’। প্রথমদিন গরুর লড়াই পরেরদিন বলি খেলা। আসতো নামী দামী বিশাল বিশাল গরু এবং খেলোয়াড় বলি। মেলার সাথে রাত্রে আয়োজন হত ভ্যারাইটি শো ও নাটক।শহর থেকে কন্ঠ, নৃত্য, যন্ত্রী শিল্পীরা আসত কি বিশাল বহর। লাইট, মাইক, স্টেজ সাজানোর সামগ্রী, মেকাপম্যন থাকতো সঙ্গে। সেবার আমিও ‘মুক্তাহার’ নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম।
সারা গাঁয়ে কি আনন্দ! সাজ সাজ রব সবদিকে। সেবার গানের ও নাটকের মিউজিকে জেকব ডায়েসের দল, অনুপ পাল ও জুনু পাগলা গানে। নৃত্যে সন্ধ্যা রাণী সহ সবার সঙ্গে আসল নতুন এক নৃত্য শিল্পী ‘মঞ্জুশ্রী সেন‘। অনুষ্ঠান তুঙ্গ উঠতেই ঘোষণা আসল ‘এবার নৃত্য পরিবেশন করবেন দেশ পাগল করা, সবার মন জয় করা নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী সেন’। তবলা মাস্টার ছিল সুলতান, হারমোনিয়াম মাস্টার ছিল কমল হরি ও করনেটে সামাদ।
শুরু হল নাচ গান দিয়ে। (তখন নৃত্যশিল্পীরা নিজেই মাইকের সামনে গাইত আর ফাঁকে নাচতো। সে নাচ ছিল ব্যাকরণবিহীন, মুদ্রাবিচ্যুত, বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি সম্বৃদ্ধ কোমর আর পাচা দোলানো)।
মানুষ প্রথম শুনল, আমিও এ গান প্রথম শুনলাম,
‘ওরে সাম্পান ওয়ালা
তুই আমারে করলি দেওয়ানা।
সে কি মানুষের উন্মাদনা,ব্যতিক্রমী কথা, নতুন সুর, নতুন শিল্পী। সে এক টালমাটাল অবস্থা। সে দৃশ্য বহু দিন মনে থাকবে। মানুষের মুখে মুখে ছিল সে গান।
পরে জেনেছিলাম শেফালী ঘোষের কন্ঠে গীত ও রেকর্ডকৃত এ গান।
সে অনেক বছর হয়ে গেছে চট্টগ্রাম কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বে অনার্স ও মাস্টার্স পড়াকালীন কুমার বিশ্বজিৎ, প্রবাল চৌধুরী, উমা খান, কল্পনা লালা, প্রদীপ ভট্টাচার্য পানচু সহ ‘রিদম–৭৭’ ও পরে জেকব ডায়েস এর সাথে ‘স্পাইডার’ পপ গ্রুপে যুক্ত হই। সঙ্গে ননী গোপাল দত্তের নেতৃত্বে আমি, শেফালী ঘোষ ও শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ‘আঞ্চলিকা‘ নামে একটি দল গঠন করে সারা দেশে কমার্শিয়াল শো করতে থাকি।
চট্টগ্রামের সংগীত জগতের সাথে জড়িয়ে পড়ার কারণ যথাক্রমে শ্রদ্ধাভাজন জেকব ডায়েস, প্রবাল চৌধুরী, ননী গোপাল দত্ত, শেফালী ঘোষ, শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ও দেশের খ্যাতিমান নৃত্য শিল্পী রুনু বিশ্বাস এর কারণে।
আমাদের নিয়মিত রিহার্সাল চলতো কুমার বিশ্বজিৎ এর আলকরণের বাসায়, শেফালী দি’র নন্দনকাননের বাসায় ও জেকব ডায়েস এর লালখানবাজারের বাসায়।
তখন চট্টগ্রামের শিল্পীদের মাঝে উত্তম দত্তের সাথে ছিল আমার দারুণ সখ্য। একদিন ননী বাবু আমাকে বেতারে ফোন দিলেন দুপুরে। ইকবাল তোমাকে সন্ধ্যায় বাসায় আসতে হবে।
আমি তখন বেতারে খণ্ডকালীন চাকুরি করতাম। সন্ধ্যায় ননীদা’র বাসায় গেলে দেখলাম বন্ধু শিল্পী উত্তম দত্ত, ওস্তাদ মিহির কুমার নন্দী, শিল্পী গীতিকার এম এন আখতার, শিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব, বেতারের এ আর ডি হারুণ ভাই ও পি ও আব্দুল হালিম ভাই বসে আছেন। আমাকে সবাই দেখে বললেন– তোমার জন্য বসে আছি।
যাক, একটি দেশাত্মবোধক গান লিখার জন্য সঙ্গে ছিল ভুঁড়ি ভোজনেরও আয়োজন।
মিহির দা, উত্তম, আখতার ভাই, শ্যাম দা সবার সহযোগিতায় লেখা ও সুর সম্পন্ন হল। এক ফাঁকে উত্তম বলে উঠল ‘ননীদা ওরে সাম্পান ওয়ালা গানটির আসল গীতিকার কে? অনেকে আখতার ভাইয়ের নাম বলে, কেউ বলে মোহন লাল দাস, সত্য কোনটা?
ননীদা বলতে লাগলেন, ‘আসলে এটি একটি মাইজভাণ্ডারি গানের অনুকরণে করা। গানটি সংগীত পাগল এক লোকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা। গীতিকার কে কেউ জানেনা আজ অবধি।
মূল গানটি হল :
‘ওরে শ্যাম তোরে পাইলে
নয়নে নয়নে রাখিব‘।
হৃদাসন সাজাইয়া
রাখব তোরে শোয়াইয়া
আর কেহরে চাইতে দিতাম না রে
শ্যাম তোরে পাইলে।।
কলিজার খুন দিয়া
রাঙা চরণ ধোয়াইয়া
মাথার চুল দি মুছাইয়া দিব
শ্যাম তোরে পাইলে।
গোপন কথা তোরে কইব
মনের দুঃখ বুঝাইব
আর কেহরে শুনতে দিতাম না রে
শ্যাম তোরে পাইলে।
আমি চট্টগ্রামের বিভিন্ন গীতিকারদের দিয়ে ‘ওরে শ্যামের জায়গায় ওরে সাম্পানওয়ালা’ বসিয়ে ঐ গানের আদলে কমার্শিয়াল ঢংয়ে একটু ‘ক্যাচি সুর‘ দিয়ে বাকী গানটা শেষ করি। আইডিয়াটা ছিল সম্পূর্ণ আমার। পরবর্তীতে ঢাকায় ‘সারগাম’ স্টুডিওতে রেকর্ডিং করতে গেলে রেকর্ডিস্ট ও সারগাম–এর স্বত্বাধিকারী কলিম শরাফী ভাই বললেন, এ গানের গীতিকার কে? আমার সাথে ছিল চট্টগ্রাম বেতারের বেহালা বাদক মোহন লাল দাস। আমি বললাম উনার নামটা দিয়ে দেন। সেই থেকে এ গানের গীতিকার– মোহন লাল দাস‘।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, সংগীতশিল্পী