নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বেশি ‘ফোকাস’ করছেন বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম শহরকে পর্যটনবান্ধব ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটিতে রূপান্তর করার চিন্তা–ভাবনা থেকে নিজের সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেই আলোকে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক) স্বাবলম্বী করা এবং হকারদের শৃঙ্খলায় এনে যানজট নিরসন করে পথচারীকে স্বস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন বলেও দাবি করেন মেয়র। তিনি জানান, পরিচ্ছন্ন শহর করতে ইতোমধ্যে নেওয়া নানা উদ্যোগের পাশাপাশি স্কুলে স্কুলে ‘চাইল্ড এডুকেশন প্রোগ্রাম’ চালু করছেন শীঘ্রই। ময়লাকে সম্পদে পরিণত করতে নেওয়া হচ্ছে প্রকল্প। এছাড়া নগরবাসীর অভিযোগ পেতে এবং নাগরিক সেবা বাড়াতে চালু করছেন ‘অ্যাপস সেবা’। পঙ্গু এবং অটিস্টিক শিশুর জন্য নাগরিক কার্ড সেবা চালু করে দেবেন বিভিন্ন সুবিধা। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে হেলথ সেন্টার করা হবে জানিয়ে এ লক্ষ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা চলছে বলেও জানান তিনি।
দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস উপলক্ষে গতকাল রোববার আজাদীর সাথে আলাপে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় নিজের সাফল্য এবং পরিকল্পনাগুলোও তুলে ধরেন। তবে পরিচ্ছন্ন, জলাবদ্ধতামুক্ত শহর গড়তে মেয়রের উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতার ওপরও জোর দেন তিনি। বলেন, শহরকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন করতে গণসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রোগ্রাম আমরা চালিয়ে যাব। জলাবদ্ধতা নিরসনে ফোকাস : ডা. শাহাদাত বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশি ফোকাস করেছি; যেহেতু এটা শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা। জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে খাল–নালা পরিষ্কার করছি। এজন্য বিভিন্ন এনজিও এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও ইনভাইট করেছি। তারাও একসঙ্গে কাজ করছে। এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার নালা আছে। সেখানে থোক বরাদ্দ থেকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছি। তিনি বলেন, চারশ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট পরিকল্পনা কমিশনে আছে। সেটা অনুমোদন পেলে জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খননে আরো বেশ কিছু ইক্যুইপমেন্ট আমরা সংগ্রহ করতে পারব।
মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান সিডিএর মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১টি খাল নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা আছে। এই খালগুলো পুনরুদ্ধার ও সংস্কারে চীনের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়নার সাথে কথা হয়েছে। তারা এ খালগুলো সংস্কারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান নেই, সেটাও আমরা করে ফেলব।
মেয়র বলেন, খাল–নালায় পড়ে প্রাণহানি বা অন্যান্য দুর্ঘটনা এড়াতে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ৫৬৩টি স্পট চিহ্নিত করেছি। যেখানে স্ল্যাব ও ম্যানহোলের ঢাকনা বা নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই সেখানে আমরা কাজ করছি।
রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির উদ্যোগ : চসিকের রাজস্ব বৃদ্ধিতে কাজ করছেন জানিয়ে শাহাদাত বলেন, চাক্তাই ফিশারিঘাট গত ১০ বছর আওয়ামী লীগ দখল করে রেখেছিল। তারা কোনো রাজস্ব দিত না। সেটা উদ্ধার করেছি। এখন সিটি কর্পোরেশন প্রতিদিন সেখানে খাস কালেকশন করছে। এছাড়া পৌরকর আদায় বাড়াতে নিয়মিত করমেলা করা হবে। বন্দর থেকে ১০০ কোটি টাকা পৌরকর আদায় করেছি। এই টাকা আদায়ে মন্ত্রণালয়ে লিখেছি, তদবির করেছি, বন্দরের সাথে বৈঠক করেছি। শেষ পর্যন্ত যে টাকাটা পেয়েছি সেটা কর্পোরেশনের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
শুরু হচ্ছে চাইল্ড এডুকেশন প্রোগ্রাম : ডা. শাহাদাত বলেন, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে চাইল্ড হেলথ কেয়ার সিস্টেম বা চাইল্ড এডুকেশন প্রোগ্রাম চালু করতে যাচ্ছি। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্কুলে বাচ্চাদের সচেতন করা হবে, তারা যাতে যত্রতত্র ময়লা–আবর্জনা না ফেলে। তারা সচেতন হলে বাসায় এসে পরিবারকে সেটা শিখাবে।
তিনি বলেন, সেইভ সিটির আন্ডারেও স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম প্রাধান্য দিচ্ছি। কিশোর গ্যাং এবং ছোট ছোট বাচ্চারা যে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে সেজন্য স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা জন্য দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে স্কুলগুলোকে স্কুল হেলথ প্রোগ্রামের আওতায় আনতে চাচ্ছি।
মেয়র বলেন, শহরকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে। এজন্য আমরা বিন সাপ্লাই করছি। এটা অব্যাহত থাকবে। এরপরও কেউ যেখানে সেখানে ময়লা ফেললে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, ময়লাকে সম্পদে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন প্ল্যান আছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলেছি। বিভিন্ন কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভের সাথে কথা বলেছি। এটা যদি আমরা করতে পারি, রিসাইক্লিং প্রসেসে বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস অথবা সার উৎপাদন করতে পারি। এতে মানুষকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর একটা শহর উপহার দিতে পারব।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানসহ অনেকেই রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে পোস্টার লাগায়। এতে শহরটা নোংরা হচ্ছে। তাই চিন্তা করছি নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও পোস্টার লাগাতে না পারে সে ব্যবস্থা করব। প্রয়োজনে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিষয়টি তদারকি করবেন। বিভিন্ন জায়গায় যেসব ব্যানার লাগিয়েছে সেগুলো খুলে ফেলতে বলেছি। এখানে আমার মূল টার্গেট শহরটা যেন পরিচ্ছন্ন থাকে।
প্রতি ওয়ার্ডে হবে হেলথ সেন্টার : মেয়র বলেন, হেলদি সিটির আওতায় প্রত্যেক ওয়ার্ডে একটা করে হেলথ সেন্টার করা হবে। এ বিষয়ে একটা কোম্পানির সাথে আমাদের কথা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনসহ মিলে সেন্টারগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে আমাদের যে স্বাস্থসেবা সেন্টারগুলো আছে সেগুলো ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেমন–২ হাসপাতাল নিয়ে একটা শিল্প গ্রুপের সাথে কথা হয়েছে। ওই শিল্প গ্রুপসহ মিলে একটা জিরো ক্যাশ কাউন্টার হাসপাতাল করব; যেখানে যেকোনো রোগী কোনো টাকা ছাড়াই স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারবে।
তিনি বলেন, দ্রুততম সময়ে চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি অ্যাপ চালু করতে যাচ্ছি। যেটা দিয়ে নগরবাসী তাদের সেবা পেতে পারবেন। হোল্ডিং ট্যাঙ, ট্রেড লাইসেন্স এগুলো অটোমেশনের আওতায় আনছি। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, রাস্তার কাজ, ডেঞ্জার জোন থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলো এই অ্যাপস–থাকবে।
পর্যটন সিটি করার উদ্যোগ : ডা. শাহাদাত বলেন, চট্টগ্রাম শহরকে পর্যটন সিটিতে পরিণত করতে কাজ করছি। চর বাকলিয়া এলাকাকে চিহ্নিত করে কাজ করছি। ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ করার পরিকল্পনা আছে। শহরের কেন্দ্রীয় এলাকার চাপ কমাতে এবং নাগরিক সেবা সহজলভ্য করতে শহরকে দুই অঞ্চলে ভাগ করে পরিকল্পিত উন্নয়ন করা হবে। একটি অঞ্চল থাকবে বর্তমান নগর কেন্দ্র, অপরটি হবে কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ের নতুন টাউনশিপ।
মেয়র বলেন, আমাদের যে জায়গাগুলো আছে সেখানে সৌন্দর্যবর্ধন করা হচ্ছে। বিপ্লব উদ্যানে কাজ শুরু হবে। আমবাগানে যে পার্ক আছে সেখানে কাজ শুরু করে দিয়েছি। বন্দর থেকে ছয় একর জায়গা নিয়েছি সেখানে থিম পার্ক গড়ে তুলব। সিআরবি এবং বাকলিয়ার মাঠটাকে দৃষ্টিনন্দন করব। ৪১ ওয়ার্ডের প্রতিটিতে একটি করে খেলার মাঠ করব। ইতোমধ্যে ৭ থেকে ৮টি মাঠের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। মাদারবাড়িতে বালুর মাঠ যেটা আছে সেটাকেও খেলার মাঠ করার চিন্তা করছি। একটা জেনারেশন, কিশোর গ্যাং যারা সমাজটাকে কলুষিত করছে তাদের জন্য যদি বিনোদনের জায়গা করে দিতে পারি তাহলে তাদেরকে নৈতিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারব।
তিনি বলেন, জলাশয়–জলাধারকে সংরক্ষণ করার চিন্তা করছি। সবগুলো দিঘি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। বিশেষ করে আসকার দিঘি, ভেলুয়ার দিঘি এবং ডেবার পাড়। ওখানে ওয়াকওয়ে ও লাইটিং করার পরিকল্পনা আছে। আসকার দিঘির মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। ওখানে ফার্নিচারের যেসব দোকান আছে তাদের মালিকের সঙ্গে নিয়মিত কথা হচ্ছে। সেখানে এক পাশে একটা মার্কেট করে দোকানগুলো সেখানে স্থানান্তর করতে চাচ্ছি। দিঘিটা উন্মুক্ত হলে ওখানকার দৃশ্যটা চেঞ্জ হয়ে যাবে। ডেবার পাড় নিয়ে রেলওয়ে ও বন্দরের সঙ্গে কথা চলছে।
অন্যান্য : ডা. শাহাদাত বলেন, একটি পরিবার একটি টিসিবির কার্ড পাাচ্ছে। সেখানে আমরা বয়স্ক ভাতা যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। এর বাইরে কিছু নাগরিক কার্ড আমরা দেব, এই বিষয়ে সমাজ কল্যাণ দপ্তরের সঙ্গে কথা হয়েছে। যাদের হাত বা পা নেই অথবা যারা অটিস্টিক চাইল্ড তাদেরকে নাগরিক কার্ড দেওয়া হবে। এতে তারা বিভিন্ন সুবিধা পাবেন। এর মাধ্যমে নাগরিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করব।
তিনি বলেন, হকারদের শৃঙ্খলায় এনে নিউ মার্কেট এলাকাকে যানজটমুক্ত করতে পেরেছি। সেখানে হকারদের বসার জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। আমরা উদ্যোগ নেওয়ায় ব্যটারিচালিত কিশা কিছুটা হলেও কমেছে।
মেয়র বলেন, শিক্ষাখাতেও অর্জন আছে। বেদখল হওয়া প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি উদ্ধার করেছি এবং সেখানে ভিসি নিয়োগ করা হয়েছে। এখন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি শৃঙ্খলায় এসেছে। তিনি বলেন, শহরকে গ্রিন সিটিতে পরিণত করার ভাবনা থেকে ১০ লক্ষ গাছ রোপণের পরিকল্পনা নিয়েছি। এটা আমরা শুরু করব।
তিনি বলেন, কূলগাঁওয়ে একটি বাস টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া বাকলিয়া এবং পাহাড়তলীতে বাস টার্মিনাল করব। বর্তমান সিজন শেষ হলে সাগরিকা গরুর বাজারে পাহাড়তলী বাস টার্মিনাল করা হবে। রাস্তার উন্নয়ন, ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ, খেলার মাঠ ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো আধুনিক ও সুবিধাজনক হবে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন। এতে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ডা. শাহাদাত। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন রেজাউল। ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডা. শাহাদাত ৯ জনকে বিবাদী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমিন ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে এ মামলার রায় দেন। রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়র নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেন। এরপর ৮ অক্টোবর শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। সর্বশেষ ৩ নভেম্বর শপথবাক্য পাঠ করেন এবং ৫ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেয়র শাহাদাত। ওই হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে আজ।