কান্না থামছে না সপ্তম শ্রেণিতে পড়া খুদে ক্রিকেটার রাহাতের মা–বাবার। এ ঘটনা শুধু একটি প্রাণ কেড়ে নেয়নি; ভেঙে দিয়েছে একটি পরিবারের সব স্বপ্ন। এক সময়ের সরব বাড়িটি এখন শোকে স্তব্ধ। রাহাতের রুমের চারপাশে ছড়িয়ে আছে তার ব্যাট, বল, ট্রফি, সার্টিফিকেট, টুর্নামেন্টের ছবি। তার ব্যবহার করা জিনিসপত্র এখন পরিবারের কাছে বেদনার স্মারক।
১২ বছর বয়সী মো. রাহাত খান ছিল নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বড় স্বপ্ন ছিল তার; একদিন সে হবে দেশের গর্বিত এক ক্রিকেটার। খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। স্কুলের মাঠে ব্যাট হাতে দাঁড়ালে মনে হতো, এ ছেলেকে থামানো যাবে না। সে চট্টগ্রাম ব্রাদার্স ইউনিয়ন জুনিয়র ক্রিকেট দলের সদস্য ছিল। আগামী মৌসুমে অনূর্ধ্ব–১৪ তে খেলার জন্য তাকে বাছাই করা হয়েছিল। ইংলিশ স্পোকেন কোর্সও শেষ করেছিল।
রাহাতের মা–বাবা স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তাদের ছেলে দেশের হয়ে খেলবে। হয়তো একদিন তাকে দেখা যাবে আন্তর্জাতিক মাঠেও। কিন্তু সে স্বপ্ন দেখা থেমে গেল। রাহাত চলে গেল চিরজীবনের মতো। রেখে গেল অসীম শূন্যতা।
রাহাতের মা–বাবা আজ নির্বাক। তারা তাকিয়ে থাকেন রাহাতের খালি বিছানার দিকে। চোখের কোণে জল শুকায় না। কানে বাজে রাহাতের শেষ কথাগুলো। স্বপ্ন আজ স্মৃতি।
নিহত রাহাতের বাসায় তার ছোট্ট খালাতো বোনের চোখেও দেখা গেল প্রতিবাদের ছাপ। তার নিষ্পাপ চোখে–মুখে নীরব প্রতিবাদ। আধো কণ্ঠে ভাই হত্যার বিচার চাইল হাফছা।
রাহাতের মা রুজি আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আমার ছোট ছেলেটা আর নেই। ওর হাসি, ওর দৌড়ঝাঁপ সবকিছু এখনো চোখে ভাসছে। আমার ছেলে আমাকে ছাড়া থাকত না। প্রতিদিন তাকে স্কুলে এবং একাডেমিতে নিয়ে যেতাম, বসে থেকে আবার বাসায় নিতে আসতাম। আমার ছেলে বলত, সে খেলোয়াড় হয়ে আমাকে বিমানে চড়াবে। সবকিছু আজ স্মৃতি হয়ে আছে। কেবল একটি বেঞ্চে বসার মতো সাধারণ ঘটনায় এ হত্যাকাণ্ড হতে পারে না। এটা শুধু হত্যা নয়, এটা পরিকল্পিত হত্যা। ঘটনার পর ৬/৭ দিন চলে গেলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা দেখছি না। জড়িতদের মা–বাবাকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই।
রাহাতের বাবা লিয়াকত আলী বলেন, আমার ছেলেকে এভাবে যারা মেরেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই। এই অপরাধীদেরকে ফাঁসি দেওয়া না হলে তারা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। আমি চাই এ রকম ঘটনা আর না ঘটুক। আজকে আমার বুক খালি হয়েছে, আমি চাই না আর কোনো মা–বাবার বুক খালি হোক। আমার জীবনের আশা–ভরসা ছিল আমার ছোট্ট রাহাত। আজ আমার সব শেষ। আশা ছিল আমার ছেলে বড় হয়ে দেশে–বিদেশে খেলবে আর আমি টিভিতে দেখব। এটা আমার বড় স্বপ্ন ছিল। আমার ছেলেকে বলতাম, তুই বড় হয়ে আমার দুই ছেলেকে দেখবি, ওদের মাথায় সমস্যা।
সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আবুল মনসুর চৌধুরী বলেন, রাহাতের মৃত্যু মর্মান্তিক। সে দুষ্টু প্রকৃতির ছিল না। সে ছিল বুদ্ধিমান ও মেধাবী। এমন একটি ঘটনার শিকার হওয়ায় আমরা গভীতভাবে শোকাহত। যেহেতু অভিযুক্তরাও আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিষয়টি আমাদের আরও উদ্বিগ্ন করেছে। আমরা রাহাতের পরিবারের পাশে আছি এবং তার হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। ইতোমধ্যে বিচার দাবিতে মানববন্ধন করেছি এবং রোববার দোয়া মাহফিলের আয়োজন করি। ওখানে রাহাতের পরিবারও অংশ নেয়। তার সহপাঠীদের সঙ্গে কবর জিয়ারত করেছি এবং সোমবার শ্রদ্ধা জানিয়ে স্কুলের সকালের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ব্রাদার্স ইউনিয়নের জুনিয়র ক্রিকেট কোচ মো. আবদুস ছামাদ বলেন, রাহাত যখন প্লে গ্রুপে পড়ত, তখন থেকেই তার পরিবার তাকে ক্রিকেট খেলায় যুক্ত করে। ছোটবেলা থেকে আমরা তার বিশেষ যত্ন নিয়েছি, কারণ তার মন–প্রাণ জুড়ে ছিল ক্রিকেট। সে ছিল প্রতিশ্রুতিশীল খুদে ক্রিকেটার। অনূর্ধ্ব–১১ দলে সর্বশেষ ম্যাচে সে ৪৯ রানে অপরাজিত ছিল। আগামী মৌসুমে তাকে অনূর্ধ্ব–১৪ দলে খেলার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। তার মেধা ছিল, ভদ্র প্রকৃতির ছিল। রাহাত আমাদের মাঝে নেই–এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। নির্মম ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক–এটা আমাদের চাওয়া।
জানা যায়, দুই মাস আগে স্কুলের বেঞ্চে বসা নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে রাহাতের বাকবিতণ্ডা হয়। সেই ঘটনা ধীরে ধীরে রূপ নেয় ট্র্যাজেডিতে। পূর্বের বিরোধের জেরে ২৯ এপ্রিল রাহাতকে মারধর করে নদীতে ফেলে দেয় তারই কয়েকজন সহপাঠী। পরে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে সহপাঠীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাহাতের মরদেহ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় চার সহপাঠীর বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয় ৪ সহপাঠীকে।
রাহাত চান্দগাঁও থানার পূর্ব ফরিদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। তার বড় দুই ভাই যমজ হলেও মানসিকভাবে দুর্বল। তাই মা–বাবার স্বপ্ন ও নির্ভরতা ছিল রাহাতকে ঘিরে।