“আচ্ছা বলো তো সেলিম, এই কফি শপের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চমৎকার করে সাজানো গোছানো প্রায় খালি এই বিরাট রুমটি পিছু ফেলে সৌদি কিশোর তরুণেরা সব এই গরমেও বাইরে বারন্দায় বসেছে কেন?”
শোন ফিল, আমি হইলাম দুই দিনের বৈরাগী, অতএব এ ব্যাপারে আমি আর বলবো কী? বরং তুমি দাও না সবক আমারে। আমিও তো বরং ভাবছি, সময়টা এখন শেষ বিকেল হলেও, সুয্যি মামা বিদায় নেবার আগে এই মরুর দিকে যে ভাবে দিনশেষে শেষ বারের মতো চোখ পাকাচ্ছে, তাতে কী এমন সুধা আছে যে ওরা সব বাইরে বসেছে ? অবশ্য বারান্দায় বসার ব্যাপারটা আরামদায়ক করার জন্য এই কফি শপের কর্তারা ওখানে বড় বড় পাখা লাগিয়ে রাখার সাথে, মেশিন দিয়ে ক্রমাগত জলকনা ছিটানোর ব্যবস্থা রাখলেও; মোটেও স্বস্তিকর মনে হয় না আমার ওখানে বসাটা ।
“আচ্ছা তুমি কি ঐ চুটকিটা শুনেছ ?”
কোনটার কথা যে বলছো, তা তো বুঝতে পারছি না। এখানে আসার পর ভাণ্ডারে তো অবশ্যই বেশ ক’টা নতুন চুটকি যোগ হয়েছে। তবে নানান দেশ বা জাতি নিয়ে যে সব সরস চুটকি বলা যেত এক সময়, কোন চিন্তা ভাবনা না করে, আজকাল তো সে সব বলতেও হয় রয়ে সয়ে, মাপজোখ করে। বলা তো যায় না এন্টিরেইসিজম নিয়ে কোম্পানির যে সব নীতিমালা তৈরি হয়েছে, কোন সময় তার কোনটার খাড়ায় পড়ে, গলা আবার! তদুপরি তুমি হইলা বস। বসের সামনে কী বলতে গিয়া কী বইলা আবার বেয়াদবি কইরা ফালাই বলা তো যায় না! সো এট দিস মোমেন্ট লেট ইট বি ফ্রম দ্য হর্সেস মাউথ।
“হা হা হা।” বিশালদেহী ফিলের স্বভাবসুল্ভ ছাদ ফাটানো হাসির সাথে এসময় একদিকে যেমন কফি শপের কাউন্টারের ওপাশে ব্যস্ত কর্মীরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, তেমনি কফির কাপে চুমুক দিতে ঠোঁটের কাছে নিয়ে ধরা তার কাপ থেকেও ছলকে গেল গরম আমিরাকানো ব্ল্যাক কফির বেশ কিছুটা।
কপাল ভাল, অনুচ্চস্বরে কথা বলার জন্য টেবিলের উপর দুজনেই দুজনের দিকে ঝুঁকে থাকার কারণে ছলকে যাওয়া সামান্য কফি, ফিলের জামায় পড়লেও বেশীর ভাগটাই পড়েছে টেবিলে। দ্রুত তাই দু’জনে সামনে রাখা টিস্যু পেপার নিয়ে টেবিল মুছতে শুরু করতেই, কাউন্টার থেকেও একজন এসে একই কাজে নিয়োজিত হতেই, তাকে ধন্যবাদ দিয়ে নিবৃত হলাম দুজনে। কারণ কথায় তো আছেই, অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।
অতঃপর টেবিল মুছে কফিবালক নিষ্ক্রান্ত হতেই বললো ফিল,“শোন মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে সেদিন ফাহাদ আল হিন্দিকে তার রেইসিস্ট কথাবার্তার জন্য একটা জবর সবক দিয়েছিলাম। বলেছে নাকি সে কিছু তোমাকে? তোমার অফিসে তো প্রায়ই যায় সে দেখেছি। জিজ্ঞেস করছি তাই।”
না কিছুই বলেনি। বরং এ কয়দিন মনে হচ্ছে সে আমাকে এড়িয়েই চলছে । বরাবরের মতো সকালে অফিসে পা দিয়েই আমার রুমে বসে চা খেতে খেতে বেহুদা বংগবন্দনা করার পর, মিশরিদের যে মুণ্ডপাত করতো সে, তা আর করছে না।
“আই নো, আই নো। আমার কথার জবাবে ওটুকু বলার পরই, তার ব্ল্যাকবেরি বেজে উঠতেই, “এক্সকিউজ মি” বলে ফোনটি নিয়ে একটু দূরে গিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফিল।
এদিকে ভাবছি আমি, তাহলে বাংলায় যে কথা আছে “যাহা রটে তাহা কিছুটা তো বটেই’। তা তো সত্যিই। ঘটনা হচ্ছে অফিসের বাতাসে ভেসে বেড়ানো নানান কথা থেকে নানান জনের মুখ হয়ে টুকরো টাকরা ভাবে এসেছিল যা গত কয়দিনে আমার কানে, সে সব জোড়া লাগালে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এ রকম–সৌদি ফাহাদ আল হিন্দি যে নাকি সুযোগ পেলেই আমার কাছে মিশরিদের ব্যাপারে বিষোদ্গার করে বেড়ায়, সেই সে নাকি কিছুদিন আগে, আমারই টিমের সিনিয়র গ্রুপ প্রডাক্ট ম্যানেজার মিশরি আহমেদ রাদিকে এই বলে উস্কে দিতে চেয়েছিল যে, তার মতো একজন ঝানু সিনিয়র ম্যানেজার অফিসে মওজুদ থাকতে, বাংলাদেশ থেকে এই মিসকিনকে কেন চিফ মার্কেটিং অফিসার বানানো হল? এই কোম্পানির এ কোন ধারা! উত্তরে অত্যন্ত ঝানু ও চালু আহমেদ রাদি, কী বলেছিল জানি না। তবে কথাটা ফিলের কানে গিয়ে পৌঁছুলে মহা রেগে গিয়ে সে ফাহাদকে ডেকে তুমুল বকা ঝকা করার সাথে নাকি এই বলে শাসিয়ে ছিল যে, ফের ফাহাদ হিন্দি এমন কিছু বললে, তাকে ফিল সোজা জানালা দিয়ে অফিসের বাইরে ফেলে দিবে! একটু আগে দেয়া ফিলের ইঙ্গিতে ব্যাপার যা কানে এসেছিল এ ব্যাপারে তার পুরোটা না হলেও অনেকটাই যে সত্য বুঝতে পারছি।
“শোন সেলিম তুমি এটা শুনেছ কি না জানি না। চুটকি টা হল, ধরো কোথাও যদি এমন একটা প্রতিযোগিতা হয়, যেখানে শুধু নানান দেশ ও জাতির মানুষের মাথার জীবন্ত মগজ দেখিয়ে কোনটা কোন দেশের মানুষের মগজ প্রশ্ন করা হয়, তবে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে সে যদি সৌদিতে থেকে থাকে কখনও, তবে এক লহমাতেই সে সৌদিপুরুষের মগজটি চিনে ফেলবে। কারণ সেই মগজটির ৯৫ ভাগ থাকবে নারী ও যৌনকর্ম বিষয়ক চিন্তায় ব্যস্ত। বাকি পাঁচ ভাগ থাকবে ব্যস্ত, টাকা ও খাওয়া দাওয়া নিয়ে। হা হা হা, কি শুনেছ নাকি এটা? মজার ঘটনা হচ্ছে এই যে সৌদিকিশোর আর তরুণেরা বাইরের বারন্দায় কফির কাপ হাতে নিয়ে রাস্তার দিকে হা করে তাকিয়ে বসে আছে, এই চুটকিটাও ঐ বিষয় সম্পর্কিত“
চুটকিটা এই প্রথম ফিলের মুখে শুনলেও, শুনেছিলাম তা এরই মধ্যে বেশ ক’বারই আরো নানান অসৌদিদের মুখে, যারা আমাকে সৌদি বিষয়ে দিয়েছে নানান সবক নানান সময়ে। তা বিদেশীদের মধ্যে জনপ্রিয় ঐ চুটকিটি শুনে নাম দিয়েছিলাম তার, মগজ দিয়ে যায় চেনা। অতএব সেই একই চুটকিতে এখন আমার মধ্যে হাসির জোয়ার ফুঁসে ওঠার বদলে, স্বভাবতই থাকার কথা তাতে ভাঁটার টানই। তারপরও বসকে বিব্রত না করার মানসে জোর হাসতে হাসতে বললাম, তা তো বুঝলাম, কিন্তু এই চুটকির সাথে এখানকার কিশোর তরুণদের দল বেঁধে এই গরমে বাইরের বারান্দায় কফির কাপ হাতে বসে থাকার যোগাযোগটা তো ধরতে পারছি না ঠিক-“যদিও এই এলাকায় কোন শপিং মল নেই, তবে প্রচুর ফাস্টফুডের দোকান আর কফি শপ যে আছে এখানে দেখতেই তো পাচ্ছো তা। দিনের অন্য সময়ে না হলেও, এই বিকেলের দিকে মাঝেমধ্যে দু একটা পেঙ্গুইন এখানে এসে গাড়ী থেকে নেমে কফি শপ থেকে দ্রুত কপি নিয়ে ফের গাড়িতে উঠে যায়। তো গাড়িতে তাদের ঐ ত্রস্ত উঠা নামার সময় আপাদমস্তক মোড়া তাদের কালো আবায়া যদি বেখেয়ালে সামান্য একটু উপরে উঠে যায়, আর সেই ফাঁকে তাদের পায়ের গোড়ালির সামান্যতমেরও যদি দেখা মেলে কপালগুনে, সে আশাতেই এরা বসে আছে এই গরমে এইভাবে বাইরে! নানান শপিং মলের আশপাশের কফি শপে বসে থাকা এরকম কিশোর তরুণদের সংখ্যা কিন্তু এখানকার চেয়ে ঢের বেশী”
হুম তা বুঝলাম। তা আবায়াআবৃত ঐ জেনানারা কফিশপে এসে কফির অর্ডার করে তা গাড়িতে না নিয়ে গিয়ে, সামান্য দয়াপরবশ হয়ে এখানে বসে খেলেই তো পারে। তাতে ঐ মজনু বাবাজীদের কপাল আরকেটু খুললেও, খুলতে পারে তো। তারাই বা এমন হৃদয়হীনা কেন?
“আরে না। তা হবার নয়। এসব দোকানে তো ফ্যামিলি সেকশন বলে মেয়েদের জন্য আলাদা কোন সেকশন নেই। এখানে মেয়েরা বসে কফি খেলে মোতাওয়ারা এসে শুধু তাদেরই ধরে নিয়ে যাবে তা নয়, এমন কি কফি শপের মালিকেরও বারোটা বাজতে পারে। তাই কফি শপের লোকজনও জেনানাদের এখানে বসতে দেবে না। এমনকি কফিশপে নারীরা ঢুকে যে অর্ডার দেয়, তাও কিন্তু তাদের নিজেদের ও কফিশপের উভয়ের জন্যেই ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও এটুকু ঝুঁকি নেয় দু’পক্ষই আজকাল, এই আর কি।”
হুম এখন মনে হচ্ছে মিলাতে পারছি; আমাদের যে কোন সায়েন্টিফিক মিটিংয়ের জন্য কেন শরিয়াহ পুলিশের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। তারা সম্ভবত নিশ্চিত হতে চায় যে, যে রেস্টুরেন্টে মিটিং হচ্ছে সেখানে মহিলা ও পুরুষদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা আছে কি না।
“একদম ঠিক ধরেছ। তবে এছাড়াও মোতওয়ারা আরো নিশ্চিত হতে চায় যে, সাইয়েন্টেফিক মিটিংয়ের নামে কোন ধর্মীয় আলোচনা হচ্ছে কি না। কারণ ইসলাম ধর্মের আলোচনা হলেও সালাফি ওয়াহাবি বাদে অন্য কোনো মতেরই ইসলামিক আলোচনাও নিষিদ্ধ, সৌদিতে। অন্যদিকে পুলিশ নিশ্চিত হতে চায়, কোথাও যেন সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, কোন আলোচনা না হয়। এ জন্যই এই দুই পক্ষের কাছ থেকেই অনুমতি নিতে হয়। কেন তোমার টিমের কেউ এসব বলেনি নাকি তোমাকে?”
হুম বলেছে। তারা অবশ্যই বলেছে যে, যে কোন বৈজ্ঞানিক মিটিংয়ের জন্যই পুলিশ আর মোতাওয়াদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করলাম কেন এমন? তা বলতে পারেনি। বলেছে এটাই এখানকার দস্তুর।
“তা হলে বুঝতেই পারছো যে কাদের নিয়ে কাজ করছ। ঠিক আছে চলো উঠি এখন। আট টায় তো আমাদের দাম্মাম যাবার ফ্লাইট, আর তোমার বাসা যেহেতু এয়ারপোর্টের বেশ কাছে, আগে চল তোমার ওখানে যাই। তুমি ওখানে তোমার গাড়ী পার্ক করে রেখে, আমার গাড়িতে যাবে। এই ফাঁকে আমিও একটু দেখে নেব কেমন বাড়ি পেয়েছ তুমি।”
ফিলের এই কথায়,বস ইজ অলয়েজ রাইট, এই আপ্তবাক্যটি জপতে জপতে কফি শপটির পেছনে থাকা আমাদের অফিসের দিকে এগুতে এগুতে ভাবছি, নাহ ঐতিহাসিক কারনে যতোই থাকুক না কেন ব্রিটিশদের ব্যাপারে আমার অতি ন্যায্য একটি চাপা ক্ষোভ ও বিদ্বেষ, যতোই যাচ্ছে দিন বিশালদেহী ব্রিটিশ আমেরিকান ফিলকে সেটির আওতার বাইরেই রাখতে হবে, প্রমাণিত হচ্ছে বারবার সেটিই। দেহের চেয়ে তার মনের বিশালতা আসলেই ঢের ঢের বিশাল।
ঘটনা হচ্ছে তিন দিন আগেই জেনেছিলাম, প্রথমবারের মতো আজ রাতে যাবো আমি রিয়াদের বাইরে, দাম্মামে। কারণ ফিল, তিন দিনের একটা অফ সাইট মিটিং ডেকেছেন ওখানে। মূল উদ্দেশ্য নতুন আমরা যারা এসে যোগ দিয়েছি তাঁর টিমে, তাদেরকে একাট্টা করে তাদের মতামত শুনে কোম্পানির পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনার একটা খসড়া রোড ম্যাপ তৈরি করা। তো সে মোতাবেক সকালে অফিসে আসার সময় ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে করে নিয়ে আসার সময় ভেবেছিলাম, অফিসে গাড়িটা পার্ক করে চলে যাবো ট্যাক্সি ধরে এয়ারপোর্টে। আমার প্রতিবেশী আমিন ইব্রাহিম দু’দিন আগেই চলে গিয়েছে জেদ্দায় কি একটা কাজে। ওখান থেকেই আসবে সে দাম্মামে, না হয় তার গাড়িতেই সকালে অফিসে এসে সন্ধ্যায় সে গাড়িতেই যেতে পারতাম এয়ারপোর্টে।
তো আজ সকালে ফিল এ কথা শুনেই বলেছিল যে, ট্যাক্সি করে যাওয়ার দরকার নাই। সে–ই আমাকে নিয়ে যাবে এয়ারপোর্টে তাঁর গাড়িতে। আর এখন তো দেখছি এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে, সে আমার বাড়িও দেখতে চায়। তার মানে তো হল এখুনি আমার বাড়ি চলে যাওয়া উচিৎ। বাড়ি গিয়ে দ্রুত চা কফি না হোক অন্তত এক গ্লাস শরবত তো তৈরি করতে হবে অতিথির জন্য। যতোই হিন্দি জাতের সৌদিরা আমাদের মিসকিন ডাকুক না কেন, বাংলার একদম হত দরিদ্র মিসকিনটিও তো তার বাড়ি থেকে কাউকে খালি মুখে যেতে দেয় না। সে জায়গায় ফিল তো আমার সাক্ষাৎ বসই না শুধু, বেশ দুস্প্রাপ্য জাতের বসই সে। এসব ভাবতে ভাবতে গাড়ীর ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে করলাম ফোন ফিল কে।
সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে এলো সহাস্য গমগমে কথা “গো এহেড সেলিম । সি ইউ সুন এট ইউর প্লেস।”
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক