বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরের শেখ মুজিব রোডে ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করা হয় বক্স কালভার্ট। এরপর ২৭ বছর পার হলেও কখনোই সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা হয়নি বক্স কালভার্টটি। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালে এ বক্স কালভার্ট পরিষ্কারের ঘোষণা দিয়েও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি সিডিএ। বর্তমানে ১০ ফুট গভীর বক্স কালভার্টটির সিংহভাগ ভরাট হয়ে আছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি নিষ্কাশন। ফলে যে উদ্দেশ্যে এ কালভার্টটি নির্মাণ করা করা হয় তার পুরোপুরি সুফল মিলছে না। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) উদ্যোগ নিচ্ছে বক্স কালভার্টটি পরিষ্কারের। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা নিচ্ছে সংস্থাটি। এর আগে ১৯ মার্চ চসিকের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি বক্স কালভার্টটি পরিষ্কারের সুপারিশ করে। শীঘ্রই বক্স কালভার্টটি পরিষ্কারের কাজ শুরু হবে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
জানা গেছে, শেখ মুজিব রোডের ফায়ার সার্ভিসের সামনে থেকে শুরু হয়েছে কালভার্টটি। বারিক বিল্ডিং মোড় হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতর দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। এটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার। এটি নির্মাণে ব্যয় হয় ২৯ কোটি টাকা। বর্তমানে বক্স কালভার্টটির উপরের স্তর জায়গা ভেদে মূল সড়কের প্রায় ৪ থেকে ৬ ফুট গভীরে। কালভার্টটির চওড়া সাড়ে ৩ মিটার।
১৯৮৮–৮৯ সালে নগরের চাক্তাই খাল, বির্জা খাল ও নাসির খালের সংস্কার এবং পাবলিক টয়লেট নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে বিশ্বব্যাংক ৩৭ মিলিয়ন ডলার সাহায্য করে। ওই প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৮ সালে শেখ মুজিব রোডে বক্স কালভার্টটি নির্মাণ করা হয়। অবশ্য ১৯৯৫ সালে সিডিএর মাস্টার প্ল্যানে বক্স কালভার্টটির বিষয়ে সুপারিশ করে।
জানা গেছে, এ বক্স কালভার্ট দিয়ে আগ্রাবাদ, পাঠানটুলী, গোসাইলডাঙ্গা, দেওয়ানহাট, চৌমুহনী ও দেওয়ানহাটসহ বেশ কিছু এলাকার পানি প্রবাহিত হয়। টাইগারপাস এলাকার পাহাড় থেকে যেসব পানি নেমে আসে সেগুলো দেওয়ানহাট হয়ে বক্স কালভার্ট দিয়ে প্রবাহিত হয়। এটি পরিষ্কার থাকলে পানি দ্রুত নেমে যাবে এবং জলাবদ্ধতাও কমে আসবে।
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, বক্স কালভার্টটিতে অনেক বিষাক্ত গ্যাস জমে আছে। তাই পুরোপুরি প্রস্তুতি এবং সেফটি ছাড়া এটা পরিষ্কারের জন্য ঢুকলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে। সেজন্য ফায়ার ব্রিগেডের সাহায্য নিয়ে কাজটা করতে চাচ্ছি। তারাও অ্যানালাইসিস করছে, কীভাবে করা যায়। এর বাইরে পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও বলেছি। তারাও সাহায্য করবে। কাজ শুরু করলে এটা পরিষ্কারে ১৫–২০ দিন লাগবে। তিনি বলেন, ২৭ বছর আগে এটা নির্মাণ করা হয়। এ পর্যন্ত কখনেই সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা হয়নি। এটা আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে।
সিটি মেয়রের জলাবদ্ধতা বিষয়ক উপদেষ্টা শাহরিয়ার খালেদ আজাদীকে বলেন, বক্স কালভার্টটিতে একটা ম্যানহোল আবিষ্কার করেছি। ওখানে দেখলাম চার থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত আবর্জনা–মাটি আছে। বক্স কালভার্টটির মুখও আবর্জনায় ভর্তি।
তিনি বলেন, বক্স কালভার্টটি নির্মাণে ৩২ কোটি টাকা খরচ হয়। শুরুতেই আমরা এটার বিরোধিতা করেছিলাম। এটা অপ্রয়োজনীয় ছিল। এটা ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বলা হলেও বাস্তবে আমরা পাচ্ছি ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার। যখন নির্মাণ করা হয় তখন বলা হয়েছিল পাম্প করে আবর্জনাগুলো কর্ণফুলীতে ডাম্প করবে। কিন্তু করা হয়নি। এখন আবর্জনা যেতে পারে না। চুপসে চুপসে একটু পানি যায়। মেপে দেখেছি ১৬ ইঞ্চি পানি আছে।
ঘোষণা দিয়েও পরিষ্কার করেনি সিডিএ : ২০১৭ সালের ১২ আগস্ট এবং ১৪ আগস্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর মেগা প্রকল্পের কারিগরি দিক পর্যালোচনায় চসিক, সিডিএ ও ওয়াসার প্রকৌশল প্রতিনিধিরা পৃথক দুটি সভা করেন। পরবর্তীতে তারা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দেন। সেখানে শেখ মুজিব রোডের বক্স কালভার্টটি সম্পর্কে বলা হয়, ‘বিশেষায়িত পদ্ধতিতে বক্স কালভার্টটির পলি/সিল্ট মুক্তকরণে মাস্টার প্ল্যান–১৯৯৫ এ সুপারিশ করা হয়েছে। যা মেগা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত প্রয়োজন।’
এর কয়েকদিন পর সিডিএ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ‘মেগা প্রকল্পের ৩০২ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার ও মেরামতের যে সংস্থান রয়েছে সেখানে শেখ মুজিব রোডের ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট অন্তর্ভুক্ত। ফলে উক্ত কাজের আওতায় শেখ মুজিব রোডের বক্স কালভার্টটি পরিষ্কার ও মেরামত করা হলে পাঠানটুলীসহ আশেপাশের এলাকা জলাবদ্ধমুক্ত থাকবে’। কিন্তু এখনো বক্স কালভার্টটি পরিষ্কারে উদ্যোগ নেয়নি সিডিএ।
এ বিষয়ে জানার জন্য বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মঈনুদ্দিনের মোবাইলে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদ মনজুর আলম মেয়র থাকাকালে চসিকের উদ্যোগে একবার বক্স কালভার্টটি পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ‘নির্মাণ ত্রুটি’র কারণে পুরোপুরি পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।
চসিকের একাধিক প্রকৌশলী জানান, মনজুর আলম মেয়র থাকার সময় কিছু পরিষ্কারের পর কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ নির্মাণের সময় পরিষ্কারের জন্য কালভার্টটিতে যে ম্যানহোল রাখা হয় সেগুলো দিয়ে কোনো খনন যন্ত্র ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। লাইট দিয়েও ভেতরে বেশি দেখা যাচ্ছিল না। এছাড়া সেখানে জমে থাকা মিথেন গ্যাস প্রতিবন্ধক ছিল। এছাড়া নির্মাণের সময় পরিষ্কারের জন্য কালভার্টটিতে যে ম্যানহোল রাখা হয় সেগুলো একটির চেয়ে অপরটির দূরত্ব ৩০০ ফুটের বেশি। ফলে টেকনিক্যাল কারণে পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র থাকাকালে আরেকবার পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মেগা প্রকল্পের আওতায় সিডিএ পরিষ্কারের ঘোষণা দেওয়ায় চসিক আর করেনি।
চসিকের অবসরপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু সালেহ আজাদীকে বলেন, মনজুর আলম মেয়র থাকাকালে আমরা মোটামুিট পরিষ্কার করেছিলাম। ওখানে ৩০০ ফুট পরপর ম্যানহোল দেওয়া হয়। আমরা ১৫০ ফুট পরপর ভেঙে পরিষ্কার করি। ওই সময় ঢাকনা খুলে কিছুদিন রেখে দেওয়া হয়। এটি এখন পরিষ্কার করা উচিত। প্রয়োজনে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং আধুনিক পদ্ধতিতে করতে হবে। তিনি বলেন, একসময় শেখ মুজিব রোডে প্রচুর জলাবদ্ধতা হতো। বক্স কালভার্টটি নির্মাণের পর সেটি কমে গিয়েছিল।