(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম ভূ–প্রাকৃতিক বিস্ময় স্টোন ফরেস্টে ঘুরছি। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে শিলিন। প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বছর আগে সমুদ্রের তলদেশে সৃষ্ট চুনাপাথরের এই বিশাল গঠনকাঠামো এখন যেন এক জীবন্ত জাদুঘর, যেখানে প্রকৃতিই কিউরেটর, আর পাথরগুলো তার জীবন্ত শিল্পকর্ম।
পর্যটনবাহী গাড়ি থেকে নামার পর থেকে আমরা পায়ে হেঁটে ঘুরছি। চারদিকে কেবল পাথর আর পাথর। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে বড়বড় গাছগাছালীও রয়েছে। আমার ধারণা ছিল মরুভূমির মতো কোন জায়গায় পাথরের বন গড়ে উঠেছে। কিন্তু এখানে চারদিকে এতো সুন্দর এবং বিশাল বিশাল গাছ দেখে মনে হচ্ছিলো, গাছগাছালীর বিশাল উপস্থিতি পাথরগুলোকে আলাদা মাহাত্ম্য দিয়েছে। এমন গাছগাছালী না থাকলে স্টোন ফরেস্ট যেনো ঠিকঠাক আছে বলে মনে হতো না।
আমরা কখনো রোদে, কখনো ছায়াঢাকা পথ মাড়িয়ে হাটছিলাম। নানা ধরনের পাখীর উপস্থিতিও দেখা গেলো। হৃদ, ফুল, পাখী গাছগাছালী এবং অযুত নিযুত পাথর স্টোন ফরেস্টকে কী মোহনীয় রূপ যে দিয়েছে তা বলে বুঝানো অসম্ভব। আমি কবি নই, শিল্পীও নই। তবুও আমার অন্তর কেমোন যেনো নাচানাচি করছিলো।
চুনাপাথরের এক একটি কাঠামো প্রকৃতির যে কী অপূর্ব সৃষ্টি তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, লেখা পড়ে বুঝে নেয়া অসম্ভব। স্টোন ফরেস্টের হেথায় হোথায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল চুনাপাথরের স্তম্ভ, যেন কেউ বিশাল হাতুড়ি দিয়ে আকাশ থেকে পাথর পুঁতে রেখেছে। প্রকৃতির এই অদ্ভুত সৃষ্টি কয়েক কোটি বছরের ধীর বিবর্তনের ফসল। বাতাসের স্পর্শে, বৃষ্টির ধারায় আর ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহের খেলায় এসব পাথর আজকের রূপ পেয়েছে। এই স্টোন ফরেস্ট ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এটিকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যও বলা হয়।
চারদিকে অসংখ্য পাথর, সত্যি সত্যিই পাথরের বন। প্রকৃতিই পাথরগুলোকে কেটেকুটে বিভিন্ন ধরনের আকৃতি দিয়ে রেখেছে। নারীর মতো পাথর, মানুষের মতো পাথর, বন্যপ্রাণীর মতো পাথর। আরো কত ধরণের পাথর যে রয়েছে! পাঁচ দশ ফুট থেকে অন্তত একশ’ ফুট উঁচু অসংখ্য পাথর চারদিকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বিল একজন পেশাদার গাইডের মতো কাজ করছে। সে একটির পর একটি পাথর দেখিয়ে যাচ্ছিলো। এরমধ্যে কোন কোন পাথরের কী কী সব নামও যেনো সে বলছিল। অ্যাশ ট্রি, প্যাগোডা, গোল্ডেন লায়ন, সোর্ড পিক আরো কত নাম যে সে বললো! খবর নিয়ে জানলাম যে, প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়েই এই পাথরের জঙ্গল বিস্তৃত।
স্টোন ফরেস্টের একেকটি পাথরের গঠন দেখে মনে হলো, এগুলো কোনো এক প্রাচীন সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ। কিছু পাথর দেখলে মনে হবে তারা সৈনিক, কিছু মনে হবে বিশাল বটগাছ, আবার কোনোটি যেন কোনো গল্পের পৌরাণিক দৈত্য। বিশেষ করে “অ্যাশ ট্রি লিফ” নামের এক পাথর দেখিয়ে বিল বললো, ‘এই পাথরের বয়স হাজার বছরেরও বেশি, আর এর ছায়ায় দাঁড়ালে শীতলতা অনুভব করবেন।’ সত্যিই তাই, সূর্যের উত্তাপ থাকলেও সেই পাথরের নিচে যেন অন্য এক জগৎ!
স্টোন ফরেস্টের পাথরের রাজ্যে ঘুরতে গিয়ে আমার শরীর মন একইসাথে শিহরিত হচ্ছিলো। কী অপূর্ব! প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি না দেখলে জীবনে আফসোস থেকে যেতো।
আমি, লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী তখন স্টোন ফরেস্টের মধ্যিখানে। আমাদের চালক কাম গাইড বিল স্টোন ফরেস্টের নানাকিছু আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। সে জানালো যে,
স্টোন ফরেস্টের দুইটি ভাগ, মেজর স্টোন ফরেস্ট এবং মাইনর স্টোন ফরেস্ট। মেজর স্টোন ফরেস্টে বড় এবং বিখ্যাত সব পাথর, এবং মাইনর স্টোন ফরেস্টে রয়েছে তুলনামূলক ছোট কিন্তু বেশ মনোমুগ্ধকর অগুনতি পাথর। এসব পাথর নিয়ে রয়েছে দারুণ সব কল্পকাহিনী। যাতে প্রেম আছে, বিরহ আছে। স্থানীয়রা এসব উপাখ্যান বিশ্বাসও করে। বিল পাথরগুলোর গল্প বলে বলে আমাদের ঘোরাচ্ছিলো। তার কথার ঢং এতটাই আকর্ষণীয় যে মনেই হচ্ছিল না, আমরা কোনো বিদেশি গাইডের মুখে বাংলা শুনছি। পরিপাটি বাংলায় কথাবার্তা চালাচ্ছে বিল। সে জানালো, জীবনের একটা সময় সে ঢাকায় কাজ করতো। এক চীনা কোম্পানির ড্রাইভার হিসেবে। সেই সূত্রেই বাংলা রপ্ত হয়েছে তার। দেশে ফিরে নিজের গাড়ি কিনে পর্যটক সেবা শুরু করেছে। বর্তমানে গাইড কাম ড্রাইভার হিসেবে তার ভালোই আয়–রোজগার।
চারদিকে শুধু পাথর আর পাথর। কখনো সুউচ্চ সুচালো, কখনো ত্রিভুজাকৃতি, কোথাও আবার স্তম্ভের মতো সরু ও লম্বা। শত সহস্র পাথরের এক রাজত্ব পুরো এলাকাজুড়ে। আমি স্টোন ফরেস্ট বা ‘পাথরের জঙ্গল’ নামটি যিনি দিয়েছেন মনে মনে তাকে শ্রদ্ধা জানালাম। এমন যৌক্তিক নামাকরণ, ভাবা যায় না। এটি কোনো প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং জীবন্ত এক কবিতা, মনছোঁয়া গল্প।
স্টোন ফরেস্টের প্রতিটি পাথর যেন একটি করে গল্প। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি এক প্রেমকাহিনি। বিল আমাদের নিয়ে গেল সেই কিংবদন্তির গল্পে।
স্টোন ফরেস্টের গল্প বলতে গিয়ে বিল জানালো যে, এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে বসবাসকারী ‘ই’ জাতিগোষ্ঠীর একটি পরিবারে জন্ম নেয় এক অতিসুন্দরী তরুণী। তার নাম ছিল আশিমা। আশিমার রূপে–গুণে মোহিত ছিল গোটা এলাকা। তরুণী আশিমার হৃদয়ে একসময় জন্ম নেয় ভালোবাসার। স্থানীয় আহেই নামের এক রাখাল যুবকের জন্য এই ভালোবাসা সমাজের প্রভাবশালীরা মানতে পারছিলেন না। কিন্তু তরুণীর অন্তর আহেই’র জন্য আকুলি বিকুলি করতো। একসময় সমাজের ক্ষমতাশালী এক পরিবার জোরপূর্বক আশিমাকে তাদের পুত্রবধূ করতে চায়। আশিমা রাজি না হলে, তারা তাকে অপহরণ করে জোর করে বিয়ের আয়োজন করে। কিন্তু সাহসিনী আশিমা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
গল্পে বলা হয় যে, পালানোর সময় আশিমা পাহাড়ি এক নদীতে পড়ে ডুবে যায়। কিংবদন্তি অনুসারে, দেবতারা তার আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার প্রতি সম্মান জানিয়ে আশিমাকে একটি পাথর বানিয়ে অমর করে রাখেন। বলা হয়, সেই পাথর আজও দাঁড়িয়ে আছে স্টোন ফরেস্টে, নারী অবয়বে। স্থানটি পরিচিত “আশিমা রক” নামে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, এই পাথরেই আশিমার আত্মা বাস করে, আর সে এখনো অপেক্ষা করছে তার প্রেমিক আহেইয়ের জন্য।
প্রতি বছর আশিমার স্মরণে পালিত হয় ‘আশিমা উৎসব’। সেই উৎসবে মানুষ গান গায়, নাচে, ভালোবাসার জয়গান করে। এটি হয়ে উঠেছে ভালোবাসার এক প্রতীক। যেভাবে লাইলী মনজু, শিরি ফরহাদ কিংবা রোমিও–জুলিয়েটের নাম প্রেমের অমর প্রতীক হিসেবে মনে পড়ে, ঠিক একইভাবে কুনমিংয়ের এই অঞ্চলে আশিমা–আহেই’র প্রেমকাহিনী ঘরে ঘরে।
স্টোন ফরেস্ট ঘিরে প্রচলিত রয়েছে আরও কিছু কিংবদন্তি। বিল আমাদেরকে আরো একটি গল্প বললো। যেটিতে বলা হয়েছে যে, অনেক যুগ আগে এই এলাকা ছিল বিশাল এক সমুদ্রের নিচে। এক দেবতা মানুষকে ভূমি উপহার দিতে চেয়েছিলেন। তার জাদুকাঠি দিয়ে সমুদ্রের জল সরিয়ে দেন তিনি। কিন্তু ভুলক্রমে পুরো পানি সরানো হয়নি। ফলে সমুদ্রের নিচে জমে থাকা খনিজ পদার্থ এক বিশাল সময় ধরে গঠিত হয়ে উঠে আসে পাথরের মতো খাড়া, সুউচ্চ স্তম্ভ হয়ে। এই রহস্যময় রূপ নিয়েই সৃষ্টি হয় স্টোন ফরেস্ট।
আরেকটি গল্পে রয়েছে ড্রাগনের কাহিনি। এক দুষ্ট ড্রাগন এ অঞ্চলের মানুষদের উপর নিপীড়ন চালাতো। তাদের খাদ্য লুট করতো, মেয়েদের অপহরণ করতো। তখন এক সাহসী যুবক ‘আহেই’ ড্রাগনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দীর্ঘ সংগ্রামে ড্রাগনকে পরাজিত করে সে, এবং তার লেজ কেটে ফেলে। সেই লেজই নাকি রূপ নিয়েছে স্টোন ফরেস্টের কিছু পাথরে। আশ্চর্য মিল, এই কাহিনিতেও নায়ক ‘আহেই’। আশিমার প্রেমিকের নামও আহেই ছিল, ড্রাগনের গল্পেও আহেই’র উপস্থিতি রয়েছে।
প্রকৃত ঘটনা যাই হোক না কেন, স্টোন ফরেস্টের রহস্য, রূপ এবং রূপকথা একত্রে মিলে তৈরি করেছে এক অভূতপূর্ব আবহ। প্রকৃতির শিল্পবোধের এক অনুপম নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই অঞ্চলটি। স্টোন ফরেস্ট যে প্রকৃতির এক অপূর্ব খেয়াল তা নিশ্চিত। আর এই খেয়ালই পৃথিবীখ্যাত স্টোন ফরেস্টের জন্ম দিয়েছে। যা আজ হাজার হাজার পর্যটকের মন ভরাচ্ছে।
প্রকৃতির এই অপার বিস্ময় স্টোন ফরেস্ট শুধু একটি ভৌগোলিক বিস্ময় নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির এক অনন্য মিশ্রণ। চুনাপাথরের এই গঠনের সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয় কিংবদন্তির কারণে এটি চীনের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। সাধারণ পর্যটক, প্রকৃতিপ্রেমী এবং ভূতত্ত্ববিদদের জন্য বহুবছর ধরে এটি এক বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।