সোলস। SOULS। আত্মারা।
কিসের আত্মা? কার আত্মা? একদল গান পাগল সংগীতপ্রেমী তরুণদের আত্মা। যারা স্বপ্ন দেখেছিল গানের দল গড়বে। যারা স্বপ্ন দেখিয়েছিল চট্টগ্রামের তরুণদের। এবং তারা সেই স্বপ্ন একদিন সত্যি সত্যি বাস্তবে পরিণত করে সারাদেশ আলোড়িত করে ফেলে। সেই স্বাধীনতা উত্তরকালের প্রতিষ্ঠিত দেশ সেরা ব্যান্ড –সোলস, আজও সগৌরবে অনুষ্ঠান করছে। মাতিয়ে রাখছে শ্রোতাদের। কম সময়কাল তো নয়। ৫৩ বছর। সুবর্ণ জয়ন্তী পেরিয়ে সোলস–এর সংগীত ভ্রমণ আজও চলছে। বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে এটি এক অনন্য অর্জন। চট্টগ্রামের জন্য গৌরবের। কেননা বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকে আর কোন ব্যান্ড এই গৌরবময় অধ্যায় অর্জন করেনি।
স্বপ্ন দেখা : ১৯৭২ সাল। জানুয়ারি / ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রামের জামাল খানে সেন্ট মেরী‘স স্কুলের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ব্যাণ্ডের গান পরিবেশন করে “লাইটিনিংস“। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ তখন তারুণ্যের উচ্ছলতায় ভরপুর। ব্যাণ্ড সংগীত চর্চা নতুন মাত্রা পেল। ঢাকায় আজম খানের উচ্চারণ মাতাচ্ছে। যদিও দেশের প্রথম ব্যাণ্ড নাজমা জামান ও শাফক্বাত জামানের ” জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী” র যাত্রা চট্টগ্রাম কলেজের অডিটোরিয়াম থেকে, স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই।
যাহোক, সেই দিনের “লাইটিনিংস” ব্যান্ডের গান শুনতে গিয়েছিল অনেক তরুণ। তাদের মধ্যে তিন তরুণ – সাজেদ উল আলম, মমতাজুল হক লুলু, মাইনুল হক মইনু। লুলু ও মইনু বন্ধু। আবার সাজেদ ও মইনু বন্ধু। তো, মইনুর মাধ্যমে লুলু ও সাজেদের পরিচয় হলো অনুষ্ঠান শেষে। সবারই ভালো লেগেছে “লাইটিনিংস “-এর পরিবেশনা। পরে তিনজনের আলাপ হলো। সেইদিনই লুলু সাথে করে নিয়ে যায় সাজেদকে তার মোমিন রোডের বাসায়। বেনজু আর গিটার বাজিয়ে শোনায় সাজেদকে। দারুণ উত্তেজনা। সেই রাতে সাজেদ আবার লুলুকে নিয়ে যায় তার কাজীর দেউড়িস্থ বাসায়। এবার সাজেদ একোডিয়ান, গিটার বাজিয়ে শোনায়। এবার দুই বন্ধু মিলে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা নেয়। এরকম বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দল গঠন করলে মন্দ কি! সেই সময়ের ভাবনাকে রূপ দিতে দৃঢ় সংকল্প এই দুই তরুণ। বাজনা বাজিয়ে সাজেদ গেলো তার বাবার কাছে। আর্জি পেশ করলো,
তারা একটি নতুন গানের দল গঠন করবে। নাম দিতে হবে। সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম হলেন সাজেদের বাবা। ছেলের বাদ্যযন্ত্র বাজানোর বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল। ছেলের এমন আবদারে তিনি সম্মতি দিলেন। খানিক ভেবে নাম দিলেন – “সুরেলা“।
সুরেলা–র যাত্রা শুরু হলো : এভাবেই যাত্রা হলো শুরু। কখনো লুলুর বাসায়, কখনো সাজেদের বাসায় চলতে থাকে মহড়া। তবে বেশিরভাগ সময় সাজেদের কাজীর দেউড়ির বাসায়। সেই সময়ে ” সুরেলা ” দলের লাইনআপটা ছিলো এমন – সাজেদ, লুলু, এনায়েত, তৌহিদ। সময়টা ছিল ১৯৭২ সালের জুন / জুলাই মাস। এই চারজন গানপাগল তরুণ পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলতো দেশাত্মবোধক গান, বাংলা আধুনিক ও সিনেমার গান। একদিন সাজেদ ও লুলু নিয়ে এলো সুব্রত বড়ুয়া রনিকে। লুলুর জামাল খান বাসায় ভাড়া থাকতো রনি। রনি আর সাজেদ আবার কলেজিয়েট স্কুলে সহপাঠী। রনি তবলা ও কঙ্গো বাজাতো। এভাবেই গিটার–একোডিয়ান–বেনজু–র সাথে কঙ্গো /তবলা যুক্ত হয়ে অন্য মাত্রা যুক্ত হলো। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল / কলেজে/ পাড়ার ক্লাবে, অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকে। ভালোই সাড়া ফেলে এই “সুরেলা“। দর্শকও নতুনত্বের স্বাদ পেল। এভাবেই একদিন সুব্রত বড়ুয়া রনি দলে নিয়ে এলেন একজন হালকা পাতলা গড়নের গায়ককে। এই গায়ক আবার বাংলা গান অসাধারণ গায়। বিশেষ করে মান্না দে‘র গান এবং দেশাত্মবোধক গান। সেই দিনের সেই তরুণ হয়ে উঠলেন পরবর্তীতে দলের প্রধান গায়ক। নাম তার তপন চৌধুরী। ‘সুরেলা’ এবার পরিপূর্ণ দল হয়ে উঠলো। মোটামুটি এই লাইনআপে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ব্যাপক পরিচিত পায়।
আধুনিকতায় সুরেলা : এভাবেই চলছিল। একদিন এই স্বপ্নবাজ তরুণেরা নতুনত্ব কিছু একটা করার আবারও স্বপ্ন দেখা শুরু করে। প্রখ্যাত সাংবাদিক মইনুল আলমের ব্যবসায়ী বন্ধু ওয়াদুদুল ইসলাম দুই দফায় বৃটেন ও ভারত থেকে নিয়ে এলেন ড্রামসেট, লিড গিটার, রিদম গিটার, বেস গিটার, এমপ্লিফায়ার ইত্যাদি। এবার নতুনভাবে গড়ে তোলা হলো। এরমধ্যে চট্টগ্রাম ক্লাব, ক্যাথলিক ক্লাবে অনুষ্ঠান করছে সুরেলা। বাংলা গানের পাশাপাশি এবার ইংরেজি গান গাইবার অনুরোধ আসতে থাকে। কিন্তু ইংরেজি গান গাইবার গায়ক তো নেই। তপন চৌধুরী তো কেবল বাংলা গানই গায়। এবার মুশকিল আসান করলেন সুব্রত বড়ুয়া রনি। তিনি নিয়ে এলেন পাথরঘাটাস্থ দুই খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী তরুণকে। এরা হলেন রুডি টমাস এবং লরেঞ্জো পল। এরা দুইজনই ইংরেজি গান গাইতে জানে আর বাজাতে পারে গিটার। ব্যস, এবার হয়ে গেলো অন্য মাত্রার পরিপূর্ণ সংগীতের দল।
নতুন বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয় আর গান নিয়ে নতুনত্বের স্বাদ দিতে মরিয়া এই গানপাগলের দল। “সুরেলা “-র বদলে আরেকটু আধুনিক পাশ্চাত্য ধাঁচের নামের প্রতি আগ্রহ জন্মালো তরুণদের। এবার এগিয়ে এলেন সাংবাদিক মইনুল আলম। দশটি নাম বাছাই করা হলো। এর মধ্যে একটি নাম ছিল THE SOULS । পরে THE শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু SOULS রাখা হলো।
শুরু হলো SOULS এর যাত্রা : ১৯৭২ সালের শেষের দিকেই ‘সুরেলা’ থেকে ‘সোলস’ গঠন হয়ে গেল। রীতিমতো হৈ চৈ অবস্থা। চট্টগ্রামের তারুণ্যের প্রতিক হয়ে উঠলো এই দলটি। এই দলের প্রথম লাইন আপ হলো এমনঃ সাজেদ – রিদম গিটার/ একোডিয়ান, লুলু– লিড গিটার /বেনজু, রনি– ড্রামস / কঙ্গো–বঙ্গো, তপন – মূল গায়ক (বাংলা), রুডি – বেস গিটার ও গায়ক (ইংরেজি), লরেঞ্জো– রিদম ও গায়ক ( ইংরেজি)।
এভাবেই ১৯৭২ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম থেকে সোলস –এর যাত্রা হলো শুরু। মহড়া চলতে থাকে কাজীর দেউড়ির সাজেদ উল আলমের বাসায়। আর সোলস দলের প্রথম ব্যবস্থাপক হলেন প্রয়াত রণজিৎ বিশ্বাস (সচিব ও রম্যসাহিত্যিক)।
পরবর্তী সময়ে নতুন সোলস গঠনের প্রক্রিয়ায় আর্থিক সহায়তা করেছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক সর্বজন শ্রদ্ধেয় জনাব এম. এ. মালেক, দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার মরহুম তসলিম উদ্দিন চৌধুরী।
আজ সুবর্ণ জয়ন্তী পেড়িয়ে সগৌরবে এগিয়ে চলেছে SOULS…. সেই দিনের কয়েকজন গানপাগল তরুণদের স্বপ্ন এবং ভাবনার ফল হলো এই দলটি। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে আজ গর্বের সঙ্গে স্থান করে নিয়েছে। লাখ লাখ মানুষের প্রিয় ব্যানড সোলস…
এই নামটি আজও আমাদের বড্ডো ভাললাগার নাম, একটি নষ্টালজিক নাম। এই দীর্ঘ সংগীত ভ্রমণে অনেক মেধাবী শিল্পী তৈরি করেছে সোলস। সময়ের বাস্তবতায় অনেকে এসেছেন। চলে গিয়েছেন। আজও তরুণদের সমন্বয়ে আজও আছে সোলস। কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে। আজও শুনছি সোলস–এর গান। এটাই আমাদের মত গান পাগলদের জন্য পরম পাওয়া। আর এর সাথে যারা যুক্ত ছিলেন এবং যারা আছেন, তারাও আমাদের বড় প্রিয় মানুষ।
সোলস–এর সংগীত ভ্রমণ অব্যাহত থাকবে – এটাই আমাদের চাওয়া।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী