ডুবে আছে ২৪ জাহাজ, বহির্নোঙরে ঝুঁকি

ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, এগুলো উদ্ধার করা ব্যয়বহুল, প্রয়োজন বিশেষ অ্যাকশন প্ল্যান

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী চ্যানেলের বাকলিয়া চর এলাকায় এমভি ব্ল্যাক পার্ল নামের একটি জাহাজ ডুবে যায় গত ২৩ মার্চ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজটির মালিক মিড ইস্ট শিপিং সার্ভিসেস এবং চট্টগ্রাম কাস্টমসকে কয়েক দফা পত্র দিলেও জাহাজটি উত্তোলন করা হয়নি। জাহাজটি কর্ণফুলী চ্যানেলে অভ্যন্তরীণ জাহাজ চলাচলের জন্য হুমকি হয়ে রয়েছে বলেও বন্দরের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি) এবং গুপ্তাখাল এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে গত ৩০ ডিসেম্বর অনিমা সায়মা২ নামের একটি বাল্কহেড ডুবে যায়। দফায় দফায় পত্র দিয়েও এই বাল্ক হেডটিকে উদ্ধার করানো সম্ভব হয়নি। বন্দর কর্তৃপক্ষ উক্ত স্থানগুলো সতর্কতার সাথে চলাচলের জন্য ইতোমধ্যে নোটিশ প্রদান করেছে।

শুধু উপরোক্ত দুইটি জাহাজই নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কাল থেকে গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ২৪টি জাহাজ ডুবে গেছে। যেগুলো নৌ চলাচলের ক্ষেত্রে বড় কোনো সংকট তৈরি না করলেও আন্তর্জাতিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিপজ্জনক বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করে রাখছে। এসব জাহাজ উঠানোর মতো সক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দর বা বাংলাদেশের নেই। বিষয়টি বেশ ব্যয়বহুলও। তবুও বন্দর তথা দেশ ও জাতির স্বার্থে ডুবে থাকা জাহাজগুলো উদ্ধারে বিশেষ অ্যাকশন প্ল্যান জরুরি বলে বন্দর ব্যবহারকারীরা জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, ১৯৮৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ডুবে যায় পণ্যবাহী জাহাজ এমভি লিটা। এর পর বঙ্গোপসাগরে বহু পানি গড়ালেও এখন পর্যন্ত জাহাজটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ২০০২ সালের ৩ জুলাই ডুবে যায় বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ সি১০৬৩। এরপর ২০০৫ সালের ২ আগস্ট ডুবে যায় এমভি ফরচুন। এভাবে গত অন্তত ৫০ বছর ধরে বন্দরের বহির্নোঙর ও আশপাশের এলাকায় অন্তত ২৪টি জাহাজ ডুবন্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এর মধ্যে কিছু জাহাজ দুই থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে পানির নিচে।

বিশেষজ্ঞ ও বন্দর ব্যবহারকারীরা আশঙ্কা করছেন, জাহাজগুলো ডুবে আছে বহুদিন ধরে। এগুলো এখন জাহাজ চলাচলের জন্য কোন সমস্যা করছে না। তবে ভবিষ্যতেও যে সমস্যা করবে না তা বলা যাচ্ছে না। যে কোন সময় এসব জাহাজ বড় ধরণের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে বলেও তারা মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রণীত তালিকায় দেখা যায়, ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোর মধ্যে ৭টি রয়েছে আলফা অ্যাংকরেজে, একটি ব্র্যাভো অ্যাংকরেজে, একটি চার্লি অ্যাংকরেজ। বাকি জাহাজগুলো পতেঙ্গা ও পার্কি সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি এলাকায় ডুবে রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর আসা দেশিবিদেশি জাহাজগুলো বহির্নোঙরের আলফা, ব্র্যাভো এবং চার্লি অ্যাংকরেজেই নোঙর করে। একটি বড় জাহাজ যখন কয়েক টন ওজনের নোঙরটি পানিতে ফেলে তখন তা সাগর কিংবা নদীর তলদেশে অন্তত ১২ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত মাটির গভীরে চলে যায়। কোন ডুবে থাকা জাহাজের উপর যদি নোঙর পড়ে এবং তা আটকে যায় তাহলে বড় ধরণের সংকটের শঙ্কা থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ডুবে যাওয়া জাহাজের সাথে ধাক্কা লাগার নজির রয়েছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, ডুবে থাকা এসব রেক (জাহাজ) বন্দরের স্বাভাবিক জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা করছে না। দীর্ঘদিন ধরে ডুবে থাকা এসব জাহাজ মাটির ৩০ থেকে ৪০ মিটার পর্যন্ত নিচে চলে গেছে। এগুলো তোলার মতো সক্ষমতা বন্দর কিংবা দেশের নেই। তবে এসব রেক ডুবে থাকার বিষয়টি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে ওয়ার্ল্ড হাইড্রোগ্রাফি অর্গানাইজেশনকে জানাতে হয়। তারা ডুবে থাকা র‌্যাকগুলো ম্যাপে প্রদর্শন করে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২৪টি রেক ডুবে থাকার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে ম্যাপে রয়েছে। এখানে আসা যে কোনো জাহাজের ক্যাপ্টেন সেই ম্যাপ দেখে থাকেন। একটি বন্দরে এতোগুলো রেক ডুবে থাকলে সেই বন্দরকে নিরাপদ বন্দর হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। অনেক জাহাজ এই ধরণের বন্দরে আসতেও চায় না। আন্তর্জাতিকভাবে এটি আমাদের ইমেজ নষ্ট করছে বলেও বন্দরের ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলেছেন, এসব ডুবে যাওয়া জাহাজ এখন হয়তো তেমন বাধা তৈরি করছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। ২০২১ সালের ১৩ জুলাই হাতিয়ার কাছে ডুবে থাকা একটি পুরনো জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে এমভি হ্যাং গ্যাং১ নামে একটি লাইটারেজ জাহাজ ডুবে যায়। যদি কোন জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ এই ধরণের দুর্ঘটনার শিকার হয় তাহলে বড় ধরণের বিপর্যয় হবে বলেও তারা মন্তব্য করেন।

ডুবে থাকা জাহাজগুলো বন্দরের জন্য হুমকি ছাড়াও বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি ডুবে থাকা জাহাজকে কেন্দ্র করে পলি জমতে শুরু করে। তৈরি হয় ডুবো চর। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এসব ডুবোচর ড্রেজিং করতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রেকগুলো অপসারণ করা হলে এই খরচ অনেক কমে আসবে এবং চ্যানেল নিরাপদ হবে।

ডুবে থাকা ২৪ টি জাহাজের মধ্যে ১৫টির নাম পাওয়া গেছে। এগুলো হলো হচ্ছে, এমভি বেঙ্গল ব্রিজ, এমভি বিআইডব্লিউটিসি১০৬৩, এমভি কাদের, এমভি ফরচুন, এমভি লিটা, এমভি সি মাস্টার, এমভি সি সম্রাট, এমভি বিশভা কুসুম, এমভি হ্যাং গ্যাং, এমভি ফিরোজ ফারজানা, এমভি হ্যাং রো বঙ, এমভি কাওয়ানা, এমভি ইউনাইটেড স্টার, এমভি এসএস থেটিক এবং এমভি সুমাইয়া সাজিদ। বাকিগুলোর কোন নাম ধামও বন্দরের রেকর্ডে নেই।

সূত্র বলেছে, ডুবে থাকা জাহাজগুলো সময়মতো উদ্ধার না করায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এগুলো ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে তুলে নেয়া হলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতো না। এখন জাহাজগুলো উদ্ধারের মতো শক্তিশালী ক্রেনসহ আনুষাঙ্গিক ইকুইপমেন্ট বন্দরের নেই। চীনের কাছে এই প্রযুক্তি রয়েছে। চীন থেকে ওই প্রযুক্তি এবং ইকুইপমেন্ট এনে রেকগুলো উদ্ধার করার সুযোগ থাকলেও তা অনেক ব্যয়বহুল। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এতো বিপুল ব্যয় করে রেকগুলো উদ্ধার করবে কিনা তা নিয়েও সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ডুবন্ত জাহাজগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করা আছে। সেখানে লাল পতাকা দেয়া আছে। নাবিকদেরকে এসব স্থান এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দেয়া আছে। ডুবন্ত জাহাজগুলো বন্দরের জাহাজ চলাচলের জন্য কোন হুমকি নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এগুলো এতো আগে ডুবে গেছে যে, এগুলো মাটির তলদেশে চলে গেছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ডুবন্ত জাহাজগুলো এখন কোন সমস্যা করছে না। তবে ভবিষ্যতেও যে করবে না সেই গ্যারান্টি নেই। এগুলো যে কোন সময় বড় ধরণের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, যত দ্রুত এগুলো সেলভেজ করা হবে ততই আমাদের জন্য ভালো হবে।

সূত্র জানায়, গত বছরের আগস্ট মাসে কর্ণফুলী নদীতে প্রায় ১০০ বছর আগে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ সফলভাবে উত্তোলন করা হয়। একটি বেসরকারি সেলভেজ কোম্পানি ওই জাহাজটির বিভিন্ন অংশ উত্তোলন করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে জাহাজগুলো উদ্ধারের জন্য দায়িত্ব দিলে এগুলো উঠিয়ে আনা সম্ভব হতো বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের মতো আন্তর্জাতিক মানের একটি বন্দরের জন্য ডুবন্ত রেক থাকা কোনোভাবেই মর্যাদাকর নয়। নিরাপদ নৌপথ নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক মহলে বন্দরের ভাবমূর্তি বাড়ানো এবং সম্ভাব্য দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। নইলে একটি ছোট্ট অঘটন পুরো বন্দরের কার্যক্রম স্থবির করে দিতে পারে বলে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতেও পড়বে।

চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অনেকগুলো রেক বহু বছর আগের। এগুলো মাটির বহু গভীরে চলে গেছে। তবে জাহাজ চলাচল কিংবা কর্ণফুলীর পলি প্রবাহের জন্য যদি কোনটি হুমকি বলে আমরা মনে করি সেগুলো উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়। ইতোপূর্বেও একবার টেন্ডার করা হয়েছিল। ভবিষ্যতেও বন্দর কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ রেকগুলো উত্তোলনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশের নয় জেলায় বজ্রপাতে প্রাণ গেল ১৫ জনের
পরবর্তী নিবন্ধহজ-পূর্ববর্তী নির্দেশিকা প্রকাশ সৌদি আরবের