ব্র্যান্ডের ভবিষ্যৎ পথ : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, টেকসইতা ও নৈতিকতা

এম. এ. মুকিত চৌধুরী | সোমবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বাজার বদলে গেছে। গ্রাহক বদলে গেছে। এবং সে অনুযায়ী ব্র্যান্ডকেও নিজেদের বদলাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মার্কেটিং ও ব্র্যান্ড কমিউনিকেশনে এখন এক নতুন সন্ধিক্ষণ। একদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষ, অন্যদিকে সামাজিকপরিবেশগত দায়বদ্ধতার তাগিদ। এই দুই শক্তিকে একত্র করে ব্র্যান্ডের ভবিষ্যৎ পথ তৈরি হচ্ছে যেখানে Hyper-Personalization, Sustainability  এবং Ethical Marketing হাত ধরাধরি করে চলে।

কাস্টমার এখন সংখ্যায় নয়, বৈচিত্র্যে বোঝা হয়।

একসময় মার্কেটাররা ‘target audience’ বলতে বুঝত ১৮৩৫ বছর বয়সী শহুরে পুরুষ বা নারী। কিন্তু এখন আমরা বুঝি, একেকজন গ্রাহকের ইচ্ছে, প্রেরণা, চিন্তা, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা আলাদা।

এখানেই আসে অওচালিত Hyper-Personalization

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের বলছে “একই ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে সবার মন জয় করা যাবে না।” বরং একজন গ্রাহক যখন সকালবেলা মোবাইলে একটা বিজ্ঞাপন দেখছেন, আরেকজন রাতে কম্পিউটারে সেটাই দেখছেন, তখন তাদের দুইজনের জন্য প্রাসঙ্গিকতা, টোন ও টাইমিং আলাদা হতে হবে।

বাংলাদেশের ইকমার্স প্রতিষ্ঠান Daraz, রাইডশেয়ারিং অ্যাপ Pathao, এমনকি ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস bKash এখন AIভিত্তিক সুপারপারসোনালাইজড অফার চালু করেছে। যিনি মোবাইল রিচার্জ করেন বেশি, তাকে সেই অফার; যিনি ট্রান্সফার করেন বেশি, তার জন্য আরেক রকম কুপন।

এই ধরনের কৌশল শুধু কনভার্সন বাড়ায় না, একটি ব্র্যান্ড ও ব্যক্তির মাঝে সংবেদনশীল সম্পর্ক গড়ে তোলে।

ব্যক্তিগত স্পর্শে ব্র্যান্ড জয়:

AI এখন কেবল ডেটা বিশ্লেষণের টুল নয় এটি হয়ে উঠেছে ব্র্যান্ড ও গ্রাহকের মাঝে এক মানবিক সংযোগের মাধ্যম।

কীভাবে কাজ করে:

কাস্টমার বিহেভিয়ার ও প্রেফারেন্স বিশ্লেষণ করে, ডাইনামিক কনটেন্ট ও অফার সাজিয়ে দেয়, টাইমিং, প্ল্যাটফর্ম ও মেসেজিংকে অপ্টিমাইজ করে।

উদাহরণ বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে:

Daraz AI ব্যবহার করে কাস্টমাইজড প্রোডাক্ট সাজেশন দেয়। bKash তাদের প্রমোশনাল অফার ইউজারের ট্রানজেকশন হিস্টোরির উপর ভিত্তি করে সাজায়। Foodpanda বিভিন্ন রিজিওন ও ইউজার ট্রেন্ড অনুযায়ী রেস্টুরেন্ট সাজেশন ও ডিসকাউন্ট দেয়।

কিন্তু প্রযুক্তি দিয়ে কি বিশ্বাস কেনা যায়?

সেখানে এসে দাঁড়ায় Sustainability I Ethical Marketing এর প্রশ্ন।

AI বা কাস্টমাইজড বিজ্ঞাপন যতই ভালো হোক, যদি গ্রাহক বুঝে ফেলে যে কোম্পানিটি পযরষফ ষধনড়ৎ ব্যবহার করছে, প্লাস্টিক দূষণে যুক্ত, কিংবা পরিবেশঅবহেলা করছে তাহলে বিশ্বাস এক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।

Sustainability & Ethical Marketing: বিশ্বাস তৈরির শক্তি:

বর্তমান কাস্টমার শুধুই ডিসকাউন্ট দেখে না, তারা দেখে ব্র্যান্ডের নৈতিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, এবং পরিবেশের প্রতি সম্মান। এর মধ্যে যা যা পড়েপরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং ও সরবরাহ চেইন, সৎ ও স্বচ্ছ সোর্সিং, প্রকৃত সামাজিক ইস্যুতে ব্র্যান্ডের অবস্থান।

উদাহরণ: Aarong Earth: ন্যাচারাল ম্যাটেরিয়াল ও রিসাইক্লেবল প্যাকেজিং ব্যবহার

Pathao: স্কুটার ও বাইসাইকেল ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ডেলিভারি

Grameenphone: “Internet for All” উদ্যোগ, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকর

বিশ্বব্যাপী যেমন Patagonia বা The Body Shop তাদের দায়বদ্ধতাকে ব্র্যান্ডিংয়ের মূল অংশ বানিয়েছে, বাংলাদেশেও সেই প্রবণতা শুরু হয়েছে।

Aarong Earth এর কথা বললেই বোঝা যায়, কীভাবে প্রোডাক্ট, সোর্সিং, প্যাকেজিং ও মার্কেটিং সবকিছুতেই sustainability ঢোকানো যায়।

Grameen phone এর “Internet for All” বা Togu Mogu এর প্রাকৃতিক শিশু পণ্য মার্কেটিং এইগুলো শুধু ক্যাম্পেইন নয়, এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি

প্রযুক্তি ও মূল্যবোধ একে অপরের পরিপূরক

এখানেই Hyper-personalization ও Ethical Marketing এর মিল।

AI বলে: “তুমি তোমার কাস্টমারকে আলাদা করে চেনো।”

Ethical Marketing বলে: “তুমি তোমার কাস্টমারকে সম্মান করো।”

এখনকার গ্রাহক কেবল সস্তা অফার চান না, তারা চান এমন ব্র্যান্ড যাদের গল্পে সত্যতা আছে, যাদের পণ্যে স্বচ্ছতা আছে, আর যাদের প্রচারণায় কৃতজ্ঞতা আছে।

যখন একজন ব্র্যান্ড ক্লায়েন্টের নাম ধরে তাকে ব্যক্তিগত অফার পাঠায়, এবং সেই অফারটিই কোনো সমাজসেবামূলক বা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থাকে তখন গ্রাহক শুধু “ক্লিক” করেন না, মনে রাখেন।

একত্রে এই দুই পথ কীভাবে ব্র্যান্ডের শক্তি বাড়ায়?

AIএর মাধ্যমে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তাব দিন, Ethical ও sustainable মানদণ্ড বজায় রেখে সেই প্রস্তাব দিন।

এতে গ্রাহকের কাছে ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে বিশ্বাসযোগ্য, মানবিক ও প্রাসঙ্গিক

বাংলাদেশের ব্র্যান্ডের সামনে সুযোগ। Light Castleএর ২০২৩ সালের একটি জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের ৮২% তরুণ ক্রেতা মনে করেন পরিবেশবান্ধব ও নৈতিক ব্র্যান্ডের প্রতি তারা বেশি আস্থাশীল।

অন্যদিকে, HubSpot বলছে সুপারপারসোনালাইজড কনটেন্টের Engagement Rate সাধারণ কনটেন্টের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

Hyper-personalized ইমেইল মার্কেটিং এর CTR সাধারণ ইমেইলের তুলনায় ২.৪ গুণ বেশি (Hub Spot Data, Adapted)

Ethical Branding অনুসরণ করা ব্র্যান্ডগুলোর সোশ্যাল এনগেজমেন্ট প্রায় ৩ গুণ বেশি

এখান থেকে সহজেই বোঝা যায় বাংলাদেশি ব্র্যান্ডদের সামনে এখন রয়েছে এক double advantage।

তারা যদি একদিকে AI ও ডেটা ব্যবহার করে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে, এবং অন্যদিকে টেকসইতা ও নৈতিকতাকে ব্র্যান্ডের মূল দর্শনে পরিণত করতে পারে তাহলে তারা শুধু ব্যবসা নয়, বিশ্বাসও জিতবে।

ব্র্যান্ড হোক মানবিক ও কার্যকর একটা সময় ছিল, যেখানে ব্র্যান্ড মানে ছিল জিঙ্গেল, বিলবোর্ড আর ডিসকাউন্ট। এখন ব্র্যান্ড মানে “সংযোগ”। সংযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে, আবার মূল্যবোধের মাধ্যমে। তাই ব্র্যান্ডকে এখন ভাবতে হবে:

আমি কি শুধুই বিক্রি করছি, না কি আমি একটি চেতনা তৈরি করছি?” যদি উত্তর হয় দ্বিতীয়টি, তবে সেই ব্র্যান্ডই হবে আগামী দিনের লিডার।

লেখক: সিনিয়র ম্যানেজার, স্ট্র্যাটেজিক সেলস, এলিট পেইন্ট এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রীজ লিঃ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার বাবা ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া
পরবর্তী নিবন্ধজাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস প্রসঙ্গে