চট্টগ্রাম দাবিদার

এরপরও কেন হচ্ছে না ‘হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ’

হাবীবুর রহমান | সোমবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

রপ্তানি বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ এবং আমদানি বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ সংঘটিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। রাজস্ব আয়ের ৬০ ভাগ আসে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্য থেকে। জিডিপিতে চট্টগ্রামের অবদান ১২ শতাংশ। দেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে এই চট্টগ্রামের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর আইনগত অধিকার নিশ্চিতে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ চট্টগ্রামে এখনো স্থাপন করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা এটিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে বলছেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিচার প্রার্থীদের এখন একটাই প্রাণের দাবি, সেটি হচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করা হোক। আইনজীবীরা বলছেন, চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনে আইনগত কোনো সমস্যা নেই। বরং আইনগত যৌক্তিকতা রয়েছে। সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী অফিস থাকবে। তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে অন্য যে স্থান বা স্থান সমূহ নির্ধারণ করবেন, সেই স্থান বা স্থান সমূহে হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে পারবে।’

চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ কেন প্রয়োজন, চট্টগ্রামবাসী কেন এর দাবিদার : চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম নামের একটি সংগঠন। চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন কেন প্রয়োজন এবং চট্টগ্রামবাসী কেন এর দাবিদার, সে বিষয়ে সংগঠনটির সাথে যুক্তরা বলছেনচট্টগ্রাম বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিভাগ, যার আয়তন ৩৩,৯০৪ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। এই বিভাগে জেলা রয়েছে ১১টি, উপজেলা ১০৩টি, থানা ১২০টি, পৌরসভা ৬২টি, ইউনিয়ন পরিষদ ৯৪৯টি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে অবস্থিত। এছাড়াও এখানে রয়েছে দেশের বৃহত্তম ইস্পাত নির্মাণ কারখানা, জাহাজ নির্মাণ কারখানাসহ অগণিত কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বহু একক ও বহুজাতিক কোম্পানি। বাংলাদেশের সর্ব বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ চট্টগ্রামে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে চট্টগ্রামের ব্যবসাবাণিজ্য সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখছে। ওয়ার্ল্ড সিটি মেয়র পরিসংখ্যান ২০২০ এর সমীক্ষা মতে চট্টগ্রাম এশিয়ার ৭ম ও বিশ্বের ১০ম দ্রুততম ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল নগরী। সে সমীক্ষায় চীনের বেইহাট ১ম ও ঢাকা ১৯তম স্থানে রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি গুরুত্ব বিবেচনায় চট্টগ্রাম প্রধান ও প্রথম। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ এবং আমদানি বাণিজ্য ৮০ শতাংশ সংঘটিত হয়। দেশের রাজস্ব আয়ের ৬০ ভাগ আসে চট্টগ্রাম ব্যবসা বাণিজ্য থেকে। আর জিডিপিতে চট্টগ্রামের অবদান ১২ শতাংশ। এই বিভাগে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ৩৩০টি, ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪,৩২৫টি, পাটকল ২৪টি, সরকারি বস্ত্রকল ৫টি, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ১০টি, টেক্সটাইল ৬৫০টি, ইপিজেড ৩টি (সরকারি ১টি) জাহাজ ভাঙা শিল্প ৮০টি, বহুজাতি কোম্পানি ১২টি, এছাড়াও রয়েছে আরো অনেক ছোট কারখানা, কোম্পানি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের দীর্ঘ ইতিহাসে চট্টগ্রাম যেমন সিংহভাগ স্থান দখল করে আছে, তেমনি দেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে এই চট্টগ্রামের অবদান অনস্বীকার্য। এসব কারণেই চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন প্রয়োজন এবং একই কারণে চট্টগ্রামবাসী এটির দাবিদার।

চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনে যৌক্তিকতা : হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন পরিষদ, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাশেম কামাল বলেছেন, চট্টগ্রাম বাসীর এই প্রাণের যৌক্তিক দাবির সাথে চট্টগ্রাম হাইকোর্ট বেঞ্চ বাস্তবায়ন পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে। প্রথম কারণচট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ চট্টগ্রামবাসীর আইনতগত ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি। উক্ত দাবি বাস্তবসম্মত, আবশ্যিক ও ন্যায়ত সঠিক, যথার্থ ও আইন সঙ্গত। দ্বিতীয় কারণচট্টগ্রাম বিভাগ ২০০৩ সালে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবে ঘোষিত হয়। এছাড়াও সর্ববৃহৎ বিভাগ, সর্ব বৃহৎ সমুদ্র বন্দরসহ ব্যবসাবাণিজ্য সর্বোচ্চ অবদান চট্টগ্রামে হওয়ার পরেও চট্টগ্রামের বিচার প্রার্থী জনগণ সর্বোচ্চ আইনের আশ্রয় লাভে সাংবিধানিক সম অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। তৃতীয় কারণহাইকোর্টের কেবলমাত্র স্থায়ী বেঞ্চ ঢাকায় অবস্থিত হওয়ায় চট্টগ্রামের বিচার প্রার্থীরা সঠিক ও যথাযথ ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হয়। কারণ হলো অনাকাঙ্খিত অতিরিক্ত খরচ, প্রতারক (দালাল) দ্বারা লক্ষ লক্ষ টাকা হারানো, সারাদেশের মামলায় একমাত্র হাইকোর্ট ভারাক্রান্ত হওয়ায় মামলায় দীর্ঘসূত্রতা, সামান্য বিষয়ে বা ইস্যুতে মামলার জন্য আইনজীবী নিয়োগে অনাকাংখিত খরচ প্রদান ও ন্যায় বিচার অনিশ্চয়তা। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছেহাইকোর্ট ঢাকায় স্থাপনের সময় দেশের জনগণ ছিল ৫ কোটি। আর বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটির অধিক। সুতরাং সার্কিট বেঞ্চ জনসংখ্যার তুলনায় যুগোপযোগী যৌক্তিক দাবি। চতুর্থ কারণ হচ্ছে, হাইকোর্টে কেবল শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর সংক্রান্তে ২৫ হাজার মামলা বিচারাধীন। যাতে সরকারের প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা শুল্ক, রাজস্ব ও ভ্যাট মামলা জটে আটকে আছে। বিচারাধীন উক্ত মামলাগুলোর মধ্যে ৭০ শতাংশ মামলা চট্টগ্রাম বন্দর ও বাণিজ্য সংক্রান্ত। তিনি বলেন, একটি মাত্র হাইকোর্ট ঢাকায় হওয়ায় মামলার খরচ স্বাভাবিকের তুলনায় ৩/৪ গুণ বেশি হয়। এছাড়াও প্রতারণার খপ্পরে পড়ে হারাতে হয় ১০/২০ গুণ অতিরিক্ত টাকা।

বিশ্বের কোন দেশে কী ব্যবস্থা : দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ও বাংলাদেশের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর ও বাণিজ্য বাজার চট্টগ্রামে অবস্থিত। কিন্তু বন্দর সংশ্লিষ্ট এডমিরালটি আইন সংক্রান্তে ও কোম্পানি আইন সংক্রান্তে এখতিয়ার সম্বলিত হচ্ছে একমাত্র হাইকোর্ট। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ পর্যালোচনায় দেখা যায়, যেই রাষ্ট্রের মূল বন্দর যেই শহরে অবস্থিত সেই শহরের মধ্যেই এডমিরালটি ও কোম্পানি আইন এখতিয়ার সম্পন্ন সংশ্লিষ্ট আদালত বা হাইকোর্ট সার্কিট বেঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ চীনের সাংহাই, দক্ষিণ কোরিয়ার কুসান, ভারতের মুম্বাই, নেদারল্যান্ডের রটাডাম, জার্মানির হামবুর্গ পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পোর্ট হার্ডলেড উল্লেখযোগ্য। সেই হিসাবে এডমিরালটি ও কোম্পানি আইন এখতিয়ার সম্বলিত সার্কিট হাইকোর্ট বেঞ্চ কিংবা আদালত চট্টগ্রামে স্থাপিত হওয়ার আবশ্যকতা থাকলেও তা সর্বদা উপেক্ষিত হয়েছে। বিশ্বের যে সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সার্কিট বেঞ্চ স্থাপিত হয় ও সফলতা পেয়েছে, সে সম্পর্কে পরিষদ জানায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ থাকলেও আন্দামান নিকোবর ও জলপাইগুড়িতে সার্কিট বেঞ্চ স্থাপিত হয়। সারাদেশে ২৪টি সার্কিট স্থায়ী বেঞ্চের সাথে ৬টি সার্কিট বেঞ্চ স্থাপিত আছে। এরমধ্যে কয়েকটি সার্কিট বেঞ্চকে স্থায়ী বেঞ্চে পরিণত করা হয়।

পাকিস্তানে হাইকোর্টের ৫টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। মূল বেঞ্চ ইসলামাবাদে, অপর ৪টি বেঞ্চ লাহোর, করাচি, পেশোয়ার ও কুট্টাতে স্থাপিত হয়। লাহোর হাইকোর্টের ৩টি সার্কিট বেঞ্চ, করাচিতে হাইকোর্টের ৩টি বেঞ্চ, পেশোয়ারে ৪টি বেঞ্চ এবং কুট্টাতে ৪টি বেঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে মূল বেঞ্চের পাশাপাশি ৬টি সার্কিট বেঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও ৬০০ জনের অধিক সার্কিট বিচারক আছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে স্পেশালিস্ট সাব ডিভিশন অব হাইকোর্ট, ক্রাউন কোর্টে বিচার কার্য পরিচালনা করেন। অস্ট্রেলিয়ার মোট জনগণ ২.৫০ কোটি। এরপরও দেশটিতে স্থায়ী বেঞ্চের পাশাপাশি ২টি করে সার্কিট বেঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডে রয়েছে ১টি।

সার্বিক বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশন দেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণে চট্টগ্রামসহ সাবেক বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন, যা যুগোপযোগী ও দেশের মানুষের জন্য সার্বিক কল্যাণকর।

আরেক সাবেক সভাপতি এনামুল হক বলেন, চট্টগ্রামের বৃহত্তর উন্নয়নের স্বার্থে বর্তমান সরকারের আমলেই হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন করা অতীব জরুরি। বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, আন্তর্জাতিক রিপোর্ট মতে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী, ফলে ঢাকাকে রক্ষায় প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। একইসাথে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের উন্নতিকল্পেও এটি সহায়ক। ঢাকায় গমন ও অবস্থান ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র জনগণ রিটসহ অন্যান্য প্রতিকার পেতে ঢাকা যেতে পারছে না। ফলে সাধারণ জনগণের বিচারপ্রাপ্তি ব্যাহত হচ্ছে।

হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চের দাবিদার চট্টগ্রাম হওয়া সত্বেও কেন তা হচ্ছে সে বিষয়ে ভাবতে হবে বলেও জানান তিনি। হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন পরিষদ, চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এস এম বদরুল আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। ২০০৩ সালে ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবে ঘোষিত হয় চট্টগ্রাম। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হতে শুরু করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে চট্টগ্রামের জনগণের অবদান অনস্বীকার্য। এসব কারণে চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসিনাকে চুপ রাখতে বলায় কী বলেছিলেন মোদী, জানালেন ড. ইউনূস
পরবর্তী নিবন্ধটস হেরে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ