কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার প্রধান অর্থনৈতিক উপাদান লবণ ও পান। উপজেলার অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষের পেশা লবণ ও পান চাষ। কিন্তু চলতি মৌসুমে একই সাথে লবণ ও পানের স্মরণকালের রেকর্ড দরপতন হয়েছে। এতে নিঃস্ব হয়ে গেছে লবণ ও পান চাষিরা। অর্থাভাবে ঘরে ঘরে চলছে হাহাকার। পুঁজি হাঁরিয়ে পথে বসে গেছে অধিকাংশ চাষি। সামনে বর্ষা মৌসুমে অপেক্ষা করছে এক চরম ভোগান্তি। বহু বছর পর লবণ ও পানের এমন অস্বাভাবিক দরপতন হওয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দুষছেন ভুক্তভোগী চাষিরা।
লবণ চাষিরা জানিয়েছেন, বর্তমানে মণপ্রতি লবণ বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। গত ৭/৮ বছরে এতো কম দামে লবণ বিক্রি হয়নি। সর্বশেষ গত মৌসুমে উৎপাদনকালে বিক্রি হয়েছিলো সর্বনিম্ন ২৫০ টাকা এবং বিগত বর্ষা মৌসুমে বিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। তবে চলতি মৌসুমের শুরুর দিকে দরপতন শুরু হয়। মৌসুমের প্রথম উৎপাদিত লবণ বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৮০ টাকায়। এরপর ২৫০ টাকা হয়ে কমতে কমতে এখন ১৭০ টাকায় ঠেকেছে। অথচ প্রতিমণ উৎপাদনে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫০ টাকা। তাতে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান দাম উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও কম! মৌসুমের আরো একমাস অবশিষ্ট থাকলেও বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় তাতে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে লাভ তো দূরের কথা পুঁজির অর্ধেক লোকসান হবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা। অন্যদিকে পানের পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম। বর্তমানে প্রতি বিরা পান সর্বোচ্চ বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। মৌসুমের শুরুতে বিক্রি হয়েছিলো সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকা। অথচ গত মৌসুমে সর্বোচ্চ ৬৫০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
চাষিরা জানিয়েছেন, মৌসুমে ১০ শতক জমিতে পান উৎপাদনের খরচ হয়েছে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু পান বিক্রি করে পাওয়া গেছে এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বৃষ্টিপাত হওয়ায় এখন পচন শুরু হবে। ফলে প্রায় অর্ধেক টাকা লোকসান হবে তা নিশ্চিত। মহেশখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জানান, মহেশখালীতে উপার্জনের প্রধান দুই খাত লবণ ও পান। বেশিরভাগ মানুষ দুইটি খাতে বিনিয়োগ করেন। অতীতে অন্যান্য সময় একটি দাম কম থাকলে অন্যটির দাম বাড়তি থাকতো। ফলে ক্ষতি পুষিয়ে টিকে থাকা যেতো। কিন্তু চলতি মৌসুমে পরিস্থিতি একেবারে উল্টো। দুটি অর্থকরি ফসলের চরম দরপতন হওয়ায় পুঁজি বিনিয়োগের জন্য ক্ষুদ্র সমিতির ঋণ ও ধারদেনা শোধ করতে পারেনি এবং বন্ধক রাখা স্বর্ণালংকারও মুক্ত করা যায়নি। এতে দিশেহারা হয়ে গেছেন চাষিরা। এছাড়া মৌসুম শেষে লবণ ও পান বিক্রির জমানো টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেয়াও বড় উপলক্ষ্য। কিন্ত চলতি মৌসুমে সবকিছুতে ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজার লবণ চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি এড. শাহাব উদ্দীন বলেন, লবণচাষের একজন শ্রমিকের দাম দেড় লাখ টাকার কাছাকাছি। এক কানি জমির বর্গাদাম ৫০ থেকে ৭০ হাজার। পলিথিন, সেলোমেশিনের তেল ও অন্যান্য খরচ মিলে একমণ লবণ উৎপাদনের খরচ পড়েছে প্রায় ৩৫০ টাকা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। সরকারের আন্তরিকতার অভাব ও তদারকি না থাকায় লবণ মিল মালিকদের একটি অসাধু সিন্ডিকেট চোরাইপথে অবৈধভাবে লবণ আমদানি করে দেশীয় লবণ শিল্প ধ্বংস করে দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়া বলেন, প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে সক্রিয় হয়ে উঠে লবণ শিল্পের দুশমন আমদানিকারী একটি অবৈধ সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। অতীতে এই সিন্ডিকেটকে রোধ করা গেলেও চলতি মৌসুমে আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেল–মানববন্ধন, সড়কে লবণ ঢেলে মানববন্ধন এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দেনদরবার করেও অবৈধ সিন্ডিকেটকে রোধ করতে পারিনি। সরকার আমাদের হাহাকার দেখেও কর্ণপাত করেনি। ফলে লবণ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কক্সবাজার বিসিক’র লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের উপ–মহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যামাত্রা ছিলো ২৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১৮ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। অবশিষ্ট দিনগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে লবণের দাম রয়েছে একেবারে তলানিতে। এতে চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাই আগামী মৌসুমের জন্য চাষিদের ঋণ বা প্রণোদনা দিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
কক্সবাজার কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক ড. বিমল কুমার প্রামাণিক বলেন, পানের দরপতনের বিষয়টি দাপ্তরিকভাবে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে। এই বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য সমপ্রতি কক্সবাজার সফরে এলে কৃষি উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পানচাষিদের প্রণোদনা ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন তিনি।