কাশ্মীর সীমান্তের নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে পাকিস্তান–ভারত দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সমপ্রতি জঙ্গী হামলায় ২৬ পর্যটকের প্রাণহানির ঘটনার পর সৃষ্ট উত্তেজনায় এ ঘটনা ঘটে, তবে এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের সীমান্তবাহিনীর অনুমাননির্ভর গুলির জবাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীও পাল্টা গুলি চালায় বলে জানিয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। সীমান্তে ভারতের অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করা এবং দেশটির নৌবাহিনীর মিসাইল বিধ্বংসের পরীক্ষার খবরেও মিলছে গণমাধ্যমে। এদিকে বিদ্যমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ভারত–পাকিস্তান দুই দেশকেই ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফান ডুজারিক বলেন, মহাসচিব এই পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে আমরা উভয় সরকারের কাছে জোর অনুরোধ জানাই। একইসঙ্গে বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং যা আমরা দেখছি তা যেন আরও খারাপের দিকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করারও অনুরোধ করি।
এক প্রশ্নের উত্তরে মুখপাত্র জানান, জাতিসংঘ মহাসচিব ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগ করেননি। ডুজারিক বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যেকোনো ইস্যু শান্তিপূর্ণভাবে ও পারস্পরিক অর্থবহ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব ও উচিত বলে আমরা বিশ্বাস করি। ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি স্থগিত করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডুজারিক বলেন, আমার মনে হয়, আমরা যে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর অনুরোধ করছি এবং পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে বা অস্থির অঞ্চলে আরও উত্তেজনা বাড়াতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি, এটিও সেই আহ্বানের আওতায় থাকবে।
সিনেটে প্রস্তাব পাস : পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার সঙ্গে পাকিস্তানকে জড়ানোর বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে গতকাল শুক্রবার সর্বসম্মতিক্রমে পাকিস্তানের উচ্চকক্ষ সিনেটে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার প্রস্তাবটি সিনেটে উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে তিনি বলেন, পানি–সন্ত্রাসবাদ বা সামরিক উসকানিসহ যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে পাকিস্তান পুরোপুরি প্রস্তুত।
প্রস্তাবে ‘ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল সংগঠিত পেহেলগাম হামলার সঙ্গে পাকিস্তানকে জড়িত করার সব অসার ও ভিত্তিহীন প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।’ প্রস্তাবে নিন্দা জানিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের মর্যাদাহানি করতে ভারত সরকার পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অপপ্রচারের এই ধরন পরিচিত। সংকীর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যই সন্ত্রাসবাদের ঘটনাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে গত মঙ্গলবার বন্দুকধারীদের হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত ও ১৭ জন আহত হন। নিহত ব্যক্তিদের একজন নেপালের, বাকিরা ভারতের নাগরিক। নিহত ব্যক্তিদের সবাই পুরুষ। অধিকাংশই ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা।
হামলার পরদিন গত বুধবার ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করে ভারত। পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে দেশটি। এসব পদক্ষেপের মধ্যে সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা এবং কূটনীতিক সম্পর্ক হ্রাস অন্যতম। পরদিন বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লির সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তকে যুদ্ধের উসকানি (অ্যাক্ট অব ওয়ার) বলে উল্লেখ করেছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) ওই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে ভারতের উড়োজাহাজের জন্য নিজেদের আকাশসীমা ও ওয়াগা সীমান্তচৌকি বন্ধ করা, ভারতীয় নাগরিকদের দেওয়া সব সার্ক ভিসা বাতিল অন্যতম।
গতকাল পাকিস্তানের সিনেটে পাস হওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের জনগণ শান্তির বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কাউকে দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্বার্থ লঙ্ঘন করতে দেবে না। প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে, ‘পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের মাটিতে সন্ত্রাসবাদ এবং নিশানা করে গুপ্তহত্যা চালানোর জন্য’ ভারতকে জবাবদিহি করতে হবে।
প্রস্তাবটি শেষ হয় এভাবে–পাকিস্তান ‘কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার আদায়ের জন্য তাদের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি পাকিস্তানের অটল নৈতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন ও প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছে’ পাকিস্তান।
প্রস্তাব উত্থাপনের সময় ইসহাক দার বলেন, যদি কেউ পাকিস্তানে রাজনৈতিক হঠকারিতার কথা ভাবে, (তাদের মনে রাখা দরকার) আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত রয়েছে।
সিনেটর শেরি রেহমান বলেন, সিনেটে আমি আগেও বলেছি, মোদি প্রথম মেয়াদেই পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এবং পানি–সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তানের সাবেক এই জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, প্রতিটি যুদ্ধের সময় এই চুক্তি টিকে ছিল। কোনো যুদ্ধে এই চুক্তিকে স্পর্শ করা হয়নি। কিন্তু এখন তারা এই চুক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আমরা এটি হতে দেব না।