সত্যজিৎ : মানুষের কাছাকাছি এক মানুষ

আনোয়ার হোসেন পিন্টু | শুক্রবার , ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

সত্যজিৎ রায়ের শেষ স্পর্শ ‘উত্তরণ’। পুত্র সন্দীপ রায় নির্মাণ করলেও ছবির কাহিনী আর চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন নিজে। ছবিটি সত্যজিতের করা হয়ে ওঠেনি। তার আগেই মহাপৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে তিনি চলে গেলেন। তবু তিনি যাওয়ার আগের মুহূর্তেও আমাদের শুনিয়ে গেছেন উত্তরণের কথা। তাঁর লেখনির মধ্যে দিয়ে, ছবির মধ্যে দিয়ে তিনি বারংবার বলতে চেয়েছেন সভা নয়, বক্তৃতা নয়, মাটির কাছে যাও, সাধারণ মানুষের দিকে ফিরে তাকাও। যাও সেই মানুষের কাছে যে মানুষ বাঁচতে চায়, কিন্তু বাঁচার মত বাঁচতে পারছে না। যাও সেই মানুষের কাছে যে মানুষের ভেতর ঘুমিয়ে আছে একটি নিটোল সুন্দর মন। সামান্য সহানুভূতিতে, সামান্য ভালোবাসায়, স্নেহে যে মনে ওঠে আলোড়ন। যে যেমন অন্যকে ভালোবাসতে চায়। আঁকড়ে ধরতে চায় পড়শিকে, স্বজনকে।

সত্যজিতের সারা জীবনের কাজ আছে এই উত্তরণে। যে উত্তরণ মানুষকে দেখাতে পারে এগিয়ে যাওয়ার পথ, মানুষকে দেখাতে পারে অন্যকে ভালোবাসার পথ।

পথের পাঁচালী’ থেকে শুরু হয়েছিল সেই মহান মানুষটির পথ চলা। পথ চলার শুরতেই পথের মানুষ থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলেন এই নবীণ পথিকের দিকে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র চিত্ররূপ কি হবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকেরই। আরও বড় কথা, এ ছবির যিনি পরিচালক তিনি এ পথে একেবারেই নতুন। কিন্তু মানুষের চমক লেগেছিল ছবির মুক্তির দিন এগিয়ে আসতেই। পথে বেরিয়ে মানুষের চোখে পড়েছিল বিরাট হোর্ডিং। সর্বজয়া ও দুর্গা অসীম স্নেহে তাকিয়ে আছে ছোট্ট অপুর দিকে। আর তার সঙ্গে অদ্ভুত অক্ষরে লেখা দু’টি শব্দ ‘পথের পাঁচালী’। যে মানুষ দু’দিন আগেও প্রশ্ন তুলেছিলেন, কি হবে নতুন পরিচালকের এই ছবিতিনিও একবার নিজের অজান্তে বলে ফেলেছিলেন বাহ্‌্‌এমন সুষমামণ্ডিত শিল্প তো আগে কখনও দেখিনি। দেখিনি তো সিনেমার এমনতর বিজ্ঞাপন! তবে কি এলো কোনো নতুন মানুষ, যে আমাদের শোনাবে অন্য কথা। যে শোনাবে মানুষের কথা, সংসারের চারপাঁচটা খুঁটিনাটির কথা। যার সঙ্গে যোগ আছে জীবনের, যার সঙ্গে যোগ আছে বাস্তবের।

ছবি দেখেও মানুষ হয়েছিলেন মুগ্ধ। টাইটেল থেকে দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে উঠেছিল বাংলাদেশের গ্রামের ভেতরের এক অনাবিষ্কৃত পৃথিবী। ফুটে উঠেছিল সেইসব মানুষের ছবি, যাদের আমরা লক্ষ্য করি, কিন্তু দেখি না। ফুটে উঠেছিল সেইসব মানুষের ছোটখাটো সুখদুঃখ, হাসিকান্নার পরশ। বিমোহিত হয়েছিল মানুষ। ছবি দেখতে দেখতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল মন। মনে হয়েছিল এতো তাদেরই চেনা গণ্ডি, চেনা মানুষ। দুর্গা তো তাদের বাড়িরই মেয়েটি। যে বর্ষাবাদলে আম কুড়োতে যায়। অপু তো তাদেরই ছেলেটি, যে দিদির ন্যাওটা। ইন্দির ঠাকুরণ কি তাদের পিসিমা নয়? সরভাজা নিয়ে কি তার কিংবা তাদের গ্রামের পথে হাঁটে না কোন মিঠাইওয়ালা? এত চেনা, এত কাছের তবু ছিল কত অচেনা! মনে হয়েছিল তাদেরএমন করে তো আগে কেউ বলেনি।

সার্থক রূপান্তরই হচ্ছে সিনেমার মূল কথা। কোনো আইডিয়া, কোনো গল্পউপন্যাস, কবিতা যাই হোক না কেন সেটার সার্থক রূপান্তর। এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে সেটাকে নিয়ে যাওয়া। সেটার জন্য চাই সচেতনতা। আর এই জিনিসটাই সত্যজিৎকে করেছে অন্য চলচ্চিত্রকারের চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র।

সত্যজিৎ স্বতন্ত্র। কাজের ক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র। তবে স্বাতন্ত্র্যের বেড়ায় তিনি নিজেকে বেঁধে রাখেননি। তিনি ছবি করেননি কেবলমাত্র বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর জন্য, তিনি ছবি করেছেন মানুষের জন্য। ছবিতে বলেছেন সাধারণ মানুষেরই কথা। তিনি জানতেন, কাদের জন্য তিনি ছবি করছেন। বলেছেন সাধারণ মানুষের গল্প। সাধারণ মানুষের উত্তরণের গল্প। সে জন্য তাঁর হাত ধরেই হয়েছে বাংলা ছবির উত্তরণ। চিন্তাচেতনার উত্তরণ। মানসিকতার উত্তরণ। মানুষ ছবি দেখতে এসে ফেলেছে মুক্তির নিঃশ্বাস। যেন এক নতুন পথের অগ্রদূত তিনি। আগন্তুক তিনি। কাজের মধ্যে দিয়েই তিনি যেন বার বার বলেছেন আমি এসেছি। উত্তরণের বাণী নিয়ে। সেই আগন্তুক তাই কোন্‌্‌ ফাঁকে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন আমাদের মনে।

আজ তেত্রিশ বছর হল সেই মহান মানুষটি আর আমাদের মাঝে নেই। অথচ আজকের দিনে তাঁর থাকার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। চারদিকে তাকালে আঁতকে উঠতে হয় ছদ্ম ইন্টেলেকচুয়ালিটির মাত্রা দেখে। আঁতকে উঠতে হয় মানুষেমানুষে ভেদাভেদ দেখে। চোখ তুলে তাকালে দেখা যায় সংস্কৃতির অঙ্গনে ঢুকে পড়েছে অপসংস্কৃতির বেনোজল। সিনেমার নামে অপসিনেমা, সঙ্গীতের নামে অপসঙ্গীত দিনের পর দিন গ্রাস করছে আমাদের চেতনা। কোনো এক অদ্ভুত অন্যরকম দিনের দিকে আমরা ক্রমশ এগিয়ে চলেছি, যেদিন স্বল্প পোশাক আর উদ্দাম নৃত্যই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি।

এমন দিনে তাঁর প্রয়োজনই ছিল সবেচেয়ে বেশি। প্রয়োজন ছিল সেই মানুষের, যিনি অবলীলায় বলতে পারেনসেমিনার নয়, বক্তৃতা নয়, যাও মাটি ও মানুষের কাছাকাছি।

আমাদের চেতনা দিয়ে তাঁকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করার এই তো সময়। আমরা কি সবাই মিলে বলতে পারি না, আমাদের যেতে হবে মানুষের কাছাকাছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুযতারনামা
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে লিপ্তদের দল থেকে বহিষ্কারের দাবি