সে এক ঘোর অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিলো এই বাংলায়। সেই ঘন তমসা ভেদ করে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষার প্রহর গুণে গুণে কত দুঃখিনি মায়ের প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়েছিলো সে হিসেব আমরা রাখিনি। স্বাধীনতার জন্য জাতিকে অনেক চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। স্বামী হারিয়েছেন স্ত্রীকে, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, মাতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে, এমনি করে কত প্রাণ যে বলি হলো স্বাধীনতার বেদীমূলে, তার তো কোন লেখাজোখা নেই। স্বামীকে, পুত্রকে যুদ্ধে পাঠিয়ে স্ত্রীর, মায়ের প্রতীক্ষার প্রহর গোণা কখনো শেষ হয়নি, কত স্ত্রীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে; মায়ের অশ্রুতে ভেসে গেছে বাংলার মাঠ ঘাট প্রান্তর। চোখ শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। পিতার অশ্রু বোনের অশ্রুও তাঁর সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো।
চট্টগ্রামের আয়েশা খানম এমনি এক স্ত্রী, মাতা যাঁর স্বামী এবং বুকের তিনটি ধনকে তাঁর চোখের সামনে থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো বর্বর পাকিস্তানি হায়েনা সৈন্যরা; হাবিবুর রহমান দুলাল এমনি এক ভাই যাঁর পিতা ও তিন ভাইকে পাকি জানোয়ারারা চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছিলো তাঁদের শহরের বাসভবনের নিরাপদ গৃহকোণ থেকে। স্বাধীনতার পর দেখতে দেখতে পঞ্চাশটি বছর পেরিয়ে গেলো, কিন্তু তাঁর পিতা ও ভ্রাতাদের কোনো খোঁজ পেলেন না দুলাল। সারাদেশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন তিনি, কিন্তু হায় ব্যর্থ তাঁর সেই খোঁজাখুঁজি। পঞ্চাশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন তিনি, হয়তো একদিন ফিরে আসবেন নিরুদ্দিষ্ট পিতা ও ভ্রাতারা। স্বামী–পুত্রের ফিরে আসার পথ চেয়ে চেয়ে প্রিয়তমা পত্নী ও স্নেহময়ী জননী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
আয়েশা খানমের স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান খান (এম আর খান), তাঁর তিন শহীদ পুত্রের নাম হচ্ছে–শফিকুর রহমান খান, আজিজুর রহমান খান ও শমসের রহমান খান। এম আর খান চট্টগ্রামের একটি বিখ্যাত পরিবারের সন্তান। উনবিংশ শতাব্দির বিশিষ্ট জমিদার জান আলী খান চৌধুরী যাঁর নামে একটি রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে, তিনি এম আর খানের পিতামহ। মোহরার এ এল খান হাইস্কুল–খ্যাত জেলা রেজিস্ট্রার আবদুল লতিফ খান তাঁর পিতা, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পথিকৃৎ শিল্পপতি ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী এ কে খান তাঁর বড় ভাই; সাবেক মন্ত্রী জহির উদ্দিন খান, শিল্পপতি সালাউদ্দিন কাশেম খান তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র, সাবেক মন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী তাঁর ভাইঝি জামাই, সাবেক মন্ত্রী মোর্শেদ খান এবং সেকান্দর হায়াত খান ও হারুনুর রশিদ খান তাঁর নিকটাত্মীয়। এম আর খান সাহেব নিজেও বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাঁর বড় ভাই এ কে খান সাহেব ও জামাই সিদ্দিকী সাহেব এবং আত্মীয়। সেকান্দর হায়াত খান ও হারুন খানের যোগাযোগের কারণেই এম আর খান ও তাঁর প্রায় পুরো পরিবারটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ২৩ এপ্রিল, যেদিন তাঁদেরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বন্দুকের মুখে বাসা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, সেদিন তারা এ কে খান ও এম আর সিদ্দিকীর খোঁজেই এসেছিলো। তাদের খোঁজ বের করার জন্যই তাদেরকে সার্কিট হাউসে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। কোন কথা বের করতে না পেরে দু’দিন পর চারজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে অবশেষে গুলি করে নিস্তব্ধ করে দেয়। শফিকুর রহমান লন্ডনে পড়াশোনা করার পর মেসার্স কমার্শিয়াল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন। আজিজুর রহহমান খান মহসিন কলেজে পড়তেন ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং শমসের রহমান খান চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো।
এম আর খান থাকতেন প্যারেড ময়দানের উত্তর পূর্ব কোণায় তাঁর শহরের নিজস্ব বাসভবনে। সেই বাসভবন থেকে তাঁর তিন পুত্রসহ তাঁকে ৭১–এর ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করে কোথায় যে লাশগুলো গুম করে ফেলেছে, সেটাও জানতে দেয়নি মিসেস এম আর খান এবং তাঁর অন্য পুত্র কন্যাদের। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র হাবিবুর রহমান দুলাল ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও তৎকালীন ছাত্রনেতা ও পরবর্তীকালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইনামুল হক দানু এবং কমান্ডার এসএম মাহবুবুল আলমের গ্রুপে কাজ করতেন। দুলাল–এরও খোঁজ করেছিলো পাকিস্তানি সৈন্যরা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় তিনি সতর্ক ছিলেন এবং পাকবাহিনীর আগমনের আভাস পেয়ে তিনি বাড়ির সীমানা প্রাচীর ডিঙিয়ে পালিয়ে যান।
পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে এম আর খান ও তাঁর তিন পুত্র নিহত হওয়া সম্পর্কে স্বাধীনতার পর ইস্টার্ন এক্সামিনার পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে শহীদ মাহবুবুর রহমান খানের স্ত্রী আয়েশা খানম বলেন, তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে হজে গিয়েছিলেন। মার্চের ১২ তারিখে তিনি হজ থেকে ফিরে আসেন। এরপর ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ২৭ মার্চ তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে মোহরায় গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তখন সেখানে কালুরঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এদিকে ৩০ মার্চের পর চট্টগ্রাম শহরও পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়। ১১ এপ্রিল কালুরঘাট পাঞ্জাবিদের দখলে চলে যায়। ১৭ এপ্রিল মাহবুবুর রহমান খান তাঁর পরিবার নিয়ে আবার শহরের বাসায় চলে আসেন। এদিকে শহরে তখন কারফিউ চলছিলো। ২৩ এপ্রিল সাঈদ নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের বাসায় ঢুকে এ কে খান এবং এম আর সিদ্দিকীর খোঁজ করেন।
মাহবুবুর রহমান খান ঐ সময় বাসায় ছিলেন না। তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। মসজিদ থেকে বাসায় ফিরে তিনি পাকিস্তানি আর্মি আসার সংবাদ পান। ক্যাপ্টেন সাঈদ তাকে সার্কিট হাউসে যেতে বলে গিয়েছিলেন। পরদিন দুপুর দেড়টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা মাহবুবুর রহমান ও তাঁর তিন পুত্র–শফিকুর রহমান, আজিজুর রহমান এবং শমসের রহমান খানকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। ৬টা ৫০ মিনিটে দিকে তারা বাসায় ফিরে আসেন। কিন্তু এক কাপ চা খেতে না খেতেই পাকিস্তানি বাহিনী এসে আবার তাদেরকে বন্দুকের মুখে ধরে নিয়ে যায়।
ক্যাপ্টেন সাঈদ মাহবুবুর রহমান এবং তাঁর তিন সন্তানকে কোর্টে নিয়ে যায়। সেখানে জনৈক ব্রিগেডিয়ারের সাথে দেখা করানোর জন্য তাদের তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। কোর্ট থেকে ক্যাপ্টেন সাঈদ তাদেরকে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে নিয়ে যায় জনৈক মেজর হাকিমের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য। সেখানে তাদের সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাখা হয়। তারপর তাদের বাসায় ফিরিয়ে আনা হয়। পরে ক্যাপ্টেন সাঈদ শহীদ মাহবুবুর রহমান ও তাঁর তিন পুত্র শফিকুর রহমান খান, আজিজুর রহমান খান এবং শমসের রহমান খানকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে মেজর আনিস, ক্যাপ্টেন শহীদ, ক্যাপ্টেন মমতাজ এবং ক্যাপ্টেন সাঈদ এ কে খান ও এমআর সিদ্দিকীর খোঁজ দেওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে। আটক অবস্থায় অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে মাহবুবুর রহমান ও তাঁর তিন পুত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭২ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় তিন ভ্রাতার উপর নির্যাতন এবং তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করার করুণ কাহিনী প্রকাশিত হয়।
পরিবারের পক্ষ থেকে শহীদ এম আর খানের দ্বিতীয় পুত্র মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান খান দুলাল তাঁর পিতা মাহবুবুর রহমান খান এবং তিন ভাই শফিকুর রহমান খান, আজিজুর রহমান খান ও শমসের রহমান খানকে সারাদেশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাদের সন্ধান বের করতে সমর্থ হন নি।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতি সংগঠক