নতুন শুরুর যে প্রত্যাশায় মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ, সে প্রত্যাশার বেলুন ফুটো করে দিয়েছে জিম্বাবুয়ে। কাজে আসেনি কোন হুমকি–ধামকি। মুজারাবানির জবাব হতে পারেনি নাহিদ রানা। বরাবরের মতোই হতাশাজনক ব্যাটিং করল বাংলাদেশ। যার পরিণতি জিম্বাবুয়ের কাছে হার। সিলেট টেস্টে বাংলাদেশকে ৩ উইকেটে হারিয়ে দুই টেস্টের সিরিজে ১–০ তে এগিয়ে গেল জিম্বাবুয়ে। নিজেদের মাঠে সিরিজ জিততে শক্তিশালী দল নিয়ে মাঠে নামলেও জিম্বাবুয়ের কাছে হারতে হলো স্বাগতিকদের। জিম্বাবুয়ে যে সিরিজটাকে বেশ সিরিয়াসভাবেই নিয়েছিল তার প্রমাণ তারা মাঠের লড়াইয়ে দিয়েছে। ব্যাটে আর বলে বাংলাদেশকে হারিয়েছে নিখুঁত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
পুরো ম্যাচে সফল বলতে একজন মেহেদী হাসান মিরাজই। কিন্তু একা লড়াই করেতো আর ম্যাচ জেতানো যায় না। জেতাতেও পারেননি। দশ উইকেট নিয়েও হতাশায় মুখ লুকাতে হলো এই অলরাউন্ডারকে। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয়বারেও ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচে রোমাঞ্চ জাগান মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পেল না তার প্রচেষ্টা। চার দিনেই স্বাগতিকদের হারিয়ে দিলো জিম্বাবুয়ে।
বাংলাদেশের জন্য এই হার যতটা হতাশার; জিম্বাবুয়ের জন্য ঠিক ততটাই আনন্দের উপলক্ষ্য এই জয়। কারণ টেস্ট ক্রিকেটে চার বছরের বেশি সময় পর জয়ের স্বাদ পেল তারা। এর আগে আবুধাবিতে ২০২১ সালের মার্চে আফগানিস্তানকে সবশেষ হারিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশের বিপক্ষে সাড়ে ছয় বছর পর জিতল তারা। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সিলেটের মাঠে প্রথম টেস্টে ১৫১ রানে জিতেছিল জিম্বাবুয়ে। মাঝের সময়ে তিন টেস্টে কোনো লড়াই করতেই পারেনি তারা। এবার আবার নিজেদের সেরা ছন্দে ফিরল জিম্বাবুয়ে। ১৭৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করে রেকর্ড গড়ে জিতেছে জিম্বাবুয়ে। টেস্ট ক্রিকেটে রান তাড়ায় জয়ে এটিই জিম্বাবুয়ের রেকর্ড। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬২ রানের লক্ষ্যে ৭ উইকেটে জিতেছিল তারা। সব মিলিয়ে রান তাড়ায় জিম্বাবুয়ের ষষ্ঠ জয় এটি। জিম্বাবুয়ের কাছেও পরাজয়ে ঘরের মাঠে দৈন্যদশা অব্যাহত রইল বাংলাদেশের। গত বছর দুই সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়াসহ দেশের মাটিতে টানা ছয় টেস্ট হারল শান্তর দল।
সিলেটে বুধবারের সকাল ছিল মেঘাচ্ছন্ন। আগের রাতে টানা বৃষ্টির কারণে ভেজা আউট ফিল্ডে খেলা শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট পর। শান্তকে দিনের প্রথম বলটিই ইয়র্কার করেন ব্লেসিং মুজারাবানি। সেটি সামলে নেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। পরের বল বাউন্সার করেন জিম্বাবুয়ের দীর্ঘদেহী পেসার। তেমন বিপজ্জনক ছিল না। অহেতুক পুল করতে গিয়ে ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে বসেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। বড় লক্ষ্য দেওয়ার আশা নিয়ে খেলতে নেমে দিনের শুরুতেই চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। আগের দিনের ৬০ রানের সঙ্গে আর কিছুই যোগ করতে পারেননি শান্ত। অধিনায়কের বিদায়ের পর নামা সহঅধিনায়কও দায়িত্ব নিতে পারেননি। শুরু থেকেই যেন পাল্টা আক্রমণের পথ ধরেন মেহেদী হাসান মিরাজ। মুজারাবানির পরপর দুই ওভারে চার–ছক্কা মারেন তিনি। বদলা নিতেও সময় নেননি জিম্বাবুয়ের পেসার। অফ স্টাম্পের বাইরের ব্যাক অফ লেংথ বলে খোঁচা মেরে গালিতে ক্যাচ দেন মিরাজ। ক্যারিয়ারে তৃতীয় ৫ উইকেট পূর্ণ হয় মুজারাবানির। পরের ওভারে তাইজুল ইসলামকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের চাপ বাড়ান ভিক্টর নিয়াউচি।
অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত সতীর্থদের আসা–যাওয়া দেখছিলেন জাকের আলি। অষ্টম উইকেটে হাসান মাহমুদকে নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন এই উইকেটরক্ষক–ব্যাটসম্যান। দুজন মিলে ৯১ বলে যোগ করেন ৩৫ রান। নিয়াউচির বলে পুল করে বাউন্ডারি মেরে চার ম্যাচের ক্যারিয়ারে চতুর্থ ফিফটি পূর্ণ করেন জাকের। টেস্টে প্রথম চার ম্যাচের প্রতিটিতে পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস খেলা বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান তিনি। প্রথম তিন ম্যাচে ফিফটি করে রেকর্ডটি এত দিন ছিল জাকির হাসানের। পরের ওভারে ভাঙে হাসানের প্রতিরোধ ৫৮ বল খেলে ১২ রান করে ফিরেন হাসান। পরে সৈয়দ খালেদ আহমেদ প্রথম বলেই ধরেন ড্রেসিং রুমের পথ। ৯ উইকেট পড়ে যাওয়ায় আগ্রাসী ব্যাটিং করে রান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন জাকের। কিন্তু মুজারাবানির বলে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হন ৫৮ রান করা জাকের। প্রথম ইনিংসে ৩টির পর দ্বিতীয়বার ৬ উইকেট নিয়ে ১১ টেস্টে ৫০ উইকেট পূর্ণ করেন মুজারাবানি। জিম্বাবুয়ের হয়ে যা দ্রুততম।
১৭৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে স্বাগতিক বোলারদের ওপর চড়াও হন জিম্বাবুয়ের দুই ওপেনার। ওয়ানডের গতিতে রান করতে থাকেন তারা। দ্বাদশ ওভারে পূর্ণ হয় তাদের জুটির পঞ্চাশ রান। ৯৫ রানে জিম্বাবুয়ের উদ্বোধনী জুটি ভাঙে। ৭৫ বলে ৪৭ রান করা কারানকে ফিরিয়ে এ জুটি ভাঙেন মিরাজ। অন্য প্রান্তে ৬৫ বলে ম্যাচে নিজের দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি পুরণ করেন বেনেট। তবে দ্রুতই নিক ওয়েলচকে ফেরান তাইজুল। শেষ সেশনে নাটকীয়তার জন্ম দেন মিরাজ। তার আচমকা টার্নের সঙ্গে লাফিয়ে ওঠা বলে হকচকিয়ে যান শন উইলিয়ামস। ৯ রান করে ধরেন ড্রেসিং রুমের পথ। মিরাজের পরের ওভারে বড় শট খেলতে গিয়ে টাইমিং করতে পারেননি বেনেট। লং অনে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ৫৪ রান করে। পরে তাইজুলের বলে কট বিহাইন্ড হন ক্রেইগ আরভাইন। এখানেও বড় ভূমিকা মিরাজের। অনেকটা জোর করেই শান্তকে দিয়ে সফল রিভিউ নেওয়ান তিনি। পরের ওভারে নিয়াশা মায়াভোকে বোল্ড করে ম্যাচে উত্তেজনা বাড়ান মিরাজ।
৪ উইকেট হাতে রেখে তখনও জয় থেকে ২৯ রানে দূরে ছিল জিম্বাবুয়ে। কিন্তু আট নম্বরে নেমে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। সেই মাসাকাদজাকেও ফেরান মিরাজ। তাকে বোল্ড করে ৫ উইকেট পূর্ণ করেন মিরাজ। তখনও বাকি ছিল ১৩ রান। তাই আশা দেখছিল বাংলাদেশ। এর মাঝেই এক দফা বৃষ্টি ও পরে আলোকস্বল্পতার কারণে খেলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তবে ফ্লাডলাইট জ্বালিয়েই চলতে থাকে খেলা। আর তাতেই দারুণ এক জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে জিম্বাবুয়ে। ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছেন ব্লেসিং মুজারাবানি।