দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২৫ at ৫:০৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চীনের কুনমিং শহরের আলীশান একটি হোটেলের ডুপ্লেক্স রুমে ঘুমাচ্ছি। ইচ্ছেমতো ঘুমাতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু লায়ন ফজলে করিম ভাই ফোন করে ঘুম ভাঙ্গালেন। বললেন, গাড়ি চলে এসেছে।

মনে পড়লো যে, আজ আমি স্বপ্নের স্টোন ফরেস্ট দেখতে যাবো। পাথরের ওই বনটি দেখার জন্যই আমাদের কুনমিং আসা। ক্যালেন্ডারের পাতায় স্টোন ফরেস্টের ছবি দেখার পর থেকেই বিভিন্ন সময় মনে পড়ে স্টোন ফরেস্টের কথা, মন থেকে ছবিটি বাদ দিতে পারছিলাম না।

আমাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে যেই ড্রাইভার এনেছিল সেই ড্রাইভার বিলকেই তিনদিনের জন্য নিয়েছেন করিম ভাই। ফিরতি পথে আমাদেরকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিলেই তার ছুটি। ড্রাইভার বিলই আমাদেরকে স্টোন ফরেস্টে নিয়ে যাবে। আমি মনে মনে খুশী হলাম যে, বিল বেশ ভালো বাংলা জানে। এতো ভাষাগত সমস্যা বলে আর কিছুই থাকবে না। বিল আমাদের গাইড হিসেবেও কাজ করবে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা তৈরি হয়ে গেলাম। স্টোন ফরেস্ট অভিমুখে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। কুনমিং শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত স্টোন ফরেস্ট। যা বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময়। এটি প্রকৃতিগতভাবে গঠিত একটি বিশাল পাথুরে বন, যেখানে সুউচ্চ চুনাপাথরের স্তম্ভগুলো সত্যিকারের গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে, যা দূর থেকে একটি পাথরের জঙ্গলের মতো দেখায়। আমি ছবি দেখেছি। নেটে কিছু লেখা পড়েছি। আজ সেটি স্বচক্ষে দেখবো।

বিল বললো , ট্রাফিক কম থাকলে দুই ঘন্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাবো। ট্রাফিক বেশি থাকলে কিছু বেশি লাগতে পারে।

কুনমিংয়ের উঁচুনিচু রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম আমরা। দুইপাশে সারি সারি আধুনিক ভবন, রঙিন বিলবোর্ড আর ব্যস্ত নগরজীবনের ছাপ।

শহর থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই গাড়ি এঙপ্রেসওয়েতে উঠে গেল। টোল রোড। দারুণ একটি রাস্তা। চীনের অন্যান্য এঙপ্রেসওয়ের মতোই প্রশস্ত, নখের পিঠের মতো মসৃন। গাড়ি চলছিল, বিমানের চেয়ে বেশি আয়েশ নিয়ে বসে আছি আমরা। এঙপ্রেসওয়েতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করলো। শহরের ব্যস্ততা পেরিয়ে সারি সারি পাহাড়ের সবুজ প্রকৃতি মন ভরিয়ে দিচ্ছিলো। রাস্তার পাশেই ছোট ছোট পাহাড়, যেগুলোর অনেকগুলো চা বাগানে ঢাকা। ইউনানের চা বিশ্ববিখ্যাত, তাই পথের ধারে চা বাগানের উজ্জ্বল সবুজাভ দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। দূরেও পাহাড় দেখা যাচ্ছিলো, উঁচু উুঁচ পাহাড়। দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ে হেলান দিয়ে আকাশ যেনো আয়েশ করছিলো।

এসি বন্ধ করে গাড়ির কাচ নামিয়ে দিতে চললাম। এমন প্রকৃতিতে আয়নার ভিতরে বসে থাকার কোন মানে হয় না। বাতাসে মিশে থাকে সতেজতার এক অন্যরকম সুবাস। পাহাড়, চা বাগান ও ছোট ছোট গ্রাম আমাকে যেনো হাতছানি দিতে লাগলো।

৩০৪০ কিলোমিটার যাওয়ার পর আমরা প্রবেশ করলাম ইউনানের বিশেষ এক ভূপ্রকৃতির মধ্যে। এখানে পাহাড়গুলো দেখতে অন্যরকম, উঁচু নয়, বরং টিলা। ঢেউ খেলানো সমতল ভূমিও রয়েছে। পাহাড়ের পাথুরে গঠন ও কিছু কিছু জায়গায় লাল মাটি দেখা যাচ্ছিলো। গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথে। আমি গুনগুন করে উঠলাম। বিল বললো, এই অঞ্চলটিকে ‘রেড ল্যান্ডস অব ইউনান’ বা ‘লাল ভূমি’ বলা হয়। লালচে রঙের মাটির উপর সূর্যের আলো অপূর্ব এক সৌন্দর্য চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো।

রাস্তার দু’পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, সরিষা ক্ষেত ভরে আছে ফুলে। চোখে সর্যে ফুল দেখতে আমার বেশ ভালোই লাগছিল। বাঁশের জঙ্গলগুলো আমাকে নস্টালজিক করছিলো। যেনো আমাদের বাড়ির পুকুরপাড়! রাস্তার পাশে ছোট নদী বা খালে লোকজন মাছ ধরছিল। যাত্রা শুরুর পর থেকেই মনোমুগ্ধকর সব দৃশ্য ছিল আমাদের সঙ্গী। কুনমিংয়ের মেঘমুক্ত নীল আকাশের নিচে সড়কের দুই পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, দূরে পাহাড়ের সারি, আর মাঝে মাঝে জেগে থাকা অচেনা সব গুহার ছায়া যেন এক নতুন দুনিয়ায় নিয়ে চলছিল।

বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর খেয়াল করে দেখলাম যে, পথের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে পাহাড়ের চেহারাও। ধীরে ধীরে প্রকৃতির রহস্যময় এক সৌন্দর্য চোখে পড়ছিল।

ড্রাইভার বললো আমরা শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার চলে এসেছি। এখন আমাদেরকে হাইওয়ে থেকে এক্সিট নিতে হবে। যেতে হবে আরো অন্তত ১৫ কিলোমিটার। স্টোন ফরেস্ট অঞ্চলে রাস্তার দু’পাশে বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ, যেগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো প্রকৃতির নিজের খেয়ালে কোন বিশেষ শিল্পকর্ম করে রেখেছে।

এই অংশে রাস্তা একটু সর্পিল, এঁকে বেঁকে সামনে এগিয়েছে। পথের দুই ধারে পাহাড়, ক্ষেতখামার, বাড়িঘর এবং দোকানপাট। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনে। পাহাড়ি এলাকার ঠাণ্ডা বাতাস বেশ টের পাচ্ছিলাম। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বাড়িঘরগুলো অনেকটা সুইজারল্যান্ডের মতো লাগছিল।

স্টোন ফরেস্টে পৌঁছার আগে একটি স্থানে রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি দোকানপাঠ এবং বাড়িঘর দেখা গেলো। আমাদের ড্রাইভার বিল বললো, এখানে মুসলিম রেস্টুরেন্ট আছে। আপনারা চাইলে লাঞ্চ করে নিতে পারেন। লায়ন ফজলে করিম ভাই আমার দিকে তাকালেন। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। রেস্তোরায় ঢুকে বেশ ভালো লাগলো। বেশ বসসড় রেস্তোরাটি একেবারে তকতকে ঝকঝকে। দোকানি একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ। মাথায় টুপি দিয়ে ক্যাশে বসে আছেন। দাঁড়ি এবং টুপিতে ভদ্রলোক যে মুসলিম তা বেশ বুঝা যাচ্ছিলো। রান্না ঘরের দায়িত্বে ওনার স্ত্রী। আমাদেরকে দেখে মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। কি কি খাবো জানতে চাইলেন। নিজেই আমাদের নিয়ে গেলেন ফ্রিজের কাছে। ফ্রিজ খুলে সবকিছু দেখালেন। আমরা মুরগী, মাছ এবং সবজির অর্ডার করলাম। সাথে ডাল। আধাঘন্টা সময় চেয়ে নিয়ে তিনি অপর দুজন সহকারীকে নিয়ে খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

দারুণ রান্না। বিশাল এক থালা ভর্তি করে দেয়া হয়েছে সালাদ, লেবুও কেটে দিয়েছেন। অপ্রত্যাশিতভাবে চমৎকার আয়োজনে লাঞ্চ সেরে আমরা পুলকিত হয়ে উঠলাম। দোকানি আমাদেরকে নিজেদের তৈরি মিষ্টিও খাওয়ালেন। আমি চা খেতে চাইলাম। রেস্তোরায় চা বিক্রি না করলেও ভদ্রমহিলা আমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করলেন। দুধ দেয়া ঘন চা। লাঞ্চের পরে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমার দীর্ঘ জার্ণির ক্লান্তি নিমিষেই মিলিয়ে গেলো।

আমরা আবারো চলতে শুরু করলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়ি থেমে গেলো। ড্রাইভার হাসিমুখে বললো, ‘এটাই স্টোন ফরেস্ট, স্থানীয়রা বলেন শিলিন!’

বিল আমাদেরকে পার্কিং এরিয়া থেকে টিকেট কাউন্টারের দিকে নিয়ে গেলো। করিম ভাই থেকে টাকা নিয়ে সে নিজেই ছুটে গিয়ে টিকেট করলো। বেশ সুন্দর একটি গেট পার হয়ে আমরা স্টোন ফরেস্ট এলাকায় প্রবেশ করলাম। কী অনন্য সুন্দর এবং সাজানো গোছানো একটি এলাকা। সবুজের চাদরে ঢাকা পুরো জমিন। দারুণ সাঁট দেয়া অচিন গাছগুলো যেনো মন ধরে টানছিল। থোকায় থোকায় ফুল ফুটে রয়েছে অনেকগুলো গাছে। চারদিক দেখে মনে হচ্ছিলো সাজানো গোছানো একটি পার্ক। রাস্তার দিকে তাকিয়ে মন ভরে যাচ্ছিলো। গেট থেকে ভিতরের দিকে বেশ বড়সড় চার লেনের একটি রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার দুইপাশে যতদূর চোখ যাচ্ছিলো গাছগাছালীতে ভরে রয়েছে। এমন সুন্দর, মসৃন এবং পরিচ্ছন্ন রাস্তা আমি জীবনে খুব বেশি দেখেছি বলে মনে করতে পারছিলাম না। পাথরের বন দেখতে এসে এমন সবুজে ভরা সাজানো গোছানো পার্ক দেখে আমি মনে মনে হতাশ হচ্ছিলাম। বিল আমাদেরকে ভুল জায়গায় নিয়ে আসেনি তো! কিন্তু গেটে তো স্টোন ফরেস্ট লেখা রয়েছে। এটা কী স্টোন ফরেস্টের নমূনা!

আমাদেরকে পর্যটকবহনকারী বিশেষ ধরনের গাড়িতে তোলা হলো। সুন্দরী চীনা নারী গাড়ি চালাচ্ছিলো। মনে হলো ইলেক্ট্রিক বা ব্যাটারি চালিত গাড়ি, কোন শব্দ নেই। করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবীসহ আমরা আরো বেশ কয়েকজন পর্যটকের সাথে গাড়িতে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো।

খনিকটা আসার পরই চোখে পড়লো পাথর, বিশাল বিশাল সব পাথর হেথায় হোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবুজ জমিনে ধুসর পাথর। আরো কিছু এগুনোর পর বিশাল একটি জলাশয়ের দেখা পেলাম। বিল বললো, এটার নাম লং লেক। লেকের ভিতরেও দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো পাথর। হ্যাঁ, এই পাথরই আমি কোন একটি ক্যালেন্ডারে দেখেছিলাম। লেকের পাড়জুড়ে গাছগাছালী, বাগান। আর পানিতে পাথরের স্তুম্ভ, বিশ্বাস করুণ, অপরূপ লাগছিলো। পাথরের বনের ভিতরে এমন নান্দনিক একটি লেক কোত্থেকে আসলো! মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরগুলোর হুবহু প্রতিবিম্ভ দেখা যাচ্ছে লেকের পানিতে। সূর্যের আলোতে পাথরগুলো চিকচিক করছে, ঝলমল করছে পানি। চারদিকে গাছগাছালী, আলোছায়ার খেলা! কী যে সুন্দর! আমার শরীর মনে অন্যরকমের এক রোমাঞ্চ খেলা করতে শুরু করলো! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅব্যক্ত অনুভূতি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ