দেশে চলছে বিনিয়োগের খরা। এ খরা দূর করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করছে এমন বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সেবা এক ছাদের নিচে সরবরাহে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশের বিনিয়োগকারীদের দেশে বিনিয়োগে আহ্বান জানানো হয়েছে। সে আলোকে দেশে আয়োজন করা হয়েছে ‘বিনিয়োগ সম্মেলন’। এখানে অংশ নিয়েছেন হাজারের ওপরে বিদেশি বিনিয়োগকারী। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এ সম্মেলন নিয়ে আশাবাদী। তবে তারা বলেছেন, দেশে অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত না হলে সম্মেলনের সুফল আসবে না। বিশেষভাবে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে তবেই বিনিয়োগ বাড়বে। একই মত জানিয়েছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান সদ্য সম্মান সূচক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া কিহাক সাংয়ের নেতৃত্বে কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে বালাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রধান উপদেষ্টা বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য শ্রম, শিল্প, জ্বালানি ও বিনিয়োগনীতিতে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কথা তুলে ধরে সর্বপ্রকার সহায়তার আশ্বাস দেন।
বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকে আশ্বস্ত করেছেন এর কয়েকদিনের মধ্যে বিনিয়োগের অন্যতম উপাদান গ্যাসের দাম বাড়ল। ফলে শিল্প খাত ধ্বংসের আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। বছর খানেক ধরে ডলার সংকটের ফাঁদে আটকে আছে দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য। খরচ বেড়েছে আকাশ ছোঁয়া। নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে। ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ হতে গ্যাসের দাম কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে, গণশুনানীতেও দাম না বাড়িয়ে ‘সিস্টেম লস’ কমিয়ে দাম কমানোর কথা বলা হয়েছে। এসব আমলে না এনে সরকার উল্টোপথে হাঁটল। গ্যাসের দাম এক ঝটকায় ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দিল। শিল্প খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এটা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ’। দাম বাড়ানোর কারণে শিল্প–বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। খরচ বাড়ার আশঙ্কায় পুরোনো শিল্পেও আশানুরূপভাবে বিনিয়োগ বাড়বে না। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে গোটা শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েব, যা অর্থনীতির গতি কমবে।’
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটর কমিশন কর্তৃক ‘গ্যাসের শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ শ্রেণিতে নতুন প্রতিশ্রুত ও বিদ্যমান (অনুমোদিত লোডের অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারকারী) গ্রাহকের ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যহার সংক্রান্ত’ যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে সেটিতেও রয়েছে অসামাঞ্জস্য!
১৩ এপ্রিল গ্যাসের নতুন মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণার পর হতে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সংগঠন, অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ হতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে বিনিয়োগে খারাপ প্রভাব গড়বে।’ দুই বছর ধরে নতুন শিল্প স্থাপন করেও গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি। ‘অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান’ শিল্প বর্ধিত করেও বর্ধিত সরঞ্জাম অলস হয়ে পড়ে আছে। সরকার ঘোষিত শিল্পাঞ্চলগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিগত দুই বছর নতুন ও বর্ধিত সরঞ্জাম পুনঃ বিন্যাস কোন আবেদনই অনুমোদিত হয়নি।
বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশগুলোর ব্যবসায়িক সংগঠন ইউরোচ্যাম বিইআরসি এর নতুন ঘোষিত গ্যাসের দাম বৈষম্যমূলক, অন্যায় এবং বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশের বেসরকারি খাত ভিত্তিক থিংকট্যাংক বিজনেন্স ইনিশিয়েটিভ লিভিং ডেভলপমেন্ট (বিল্ড) উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এমন সময় এসেছে যখন বৈশ্বিক কাঁচা বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যমান মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, রপ্তানি বাজারে অস্থিরতা, বিদ্যুৎ ঘাটতি, জ্বালানির অনির্ভরযোগ্যতা, যুক্তরাষ্ট্রের ভারসাম্যমূলক শুল্কারোপ ইত্যাদি চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করছে এমন পরিস্থিতিতে নতুন বৈদেশিক বিনিয়োগের অপেক্ষায় থাকা শিল্প খাত এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেকটাই নিরুৎসাহী হবে।’
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারী সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, নতুন গ্রাহক প্রতিশ্রুত গ্রাহক ও বিদ্যমান গ্রাহকদের জন্য আলাদাভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা বৈষম্যমূলক এ মূল্যবৃদ্ধি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য অশনি সংকেত।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটর কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমদ বলেন, ‘বিইআরসি আইনি আওতার মধ্যে থেকেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বিনিয়োগ কমার বিষয়টা এখনই বলা যাবে না। বিনিয়োগে প্রভাব বাড়বে কিনা তা নজরে রাখা হবে। নতুন যারা আসবেন, তারা যদি দেখেন তাদের পোষাবে তাহলে তারা আসবেন। তারা বিকল্প জ্বালানিও ব্যবহার করতে পারেন।’
গ্যাসের দাম ফলে সম্প্রতি বিনিয়োগ সম্মেলনের যে আহ্বান তা আকর্ষণ হারাবে, বিনিয়োগের পরিবেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নতুন শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কমবে এবং বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করবে। রপ্তানিমুখী শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ এ খাতগুলি মূলত গ্যাস নির্ভর। ছোট ও মাঝারি শিল্প বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে দুর্বল করে তুলবে।
দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প ও ইপিজেড এবং বেজার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিক গ্যাস সংযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বিগত দুই বছরের অধিক সময় ধরে গ্যাস সংযোগের জন্য নতুন বর্ধিত এবং সরঞ্জাম পুনঃবিন্যাসসহ সকল প্রকার আবেদনের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যতই সংস্কার করা হোক না কেন ক্ষমতার, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব দেওয়া না হলে ক্ষমতার এবং বিকেন্দ্রিয়করণ করা না হলে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। হয়রানি লেগেই থাকবে। উর্ধ্বতন কর্তাদের অনেক অনেক দায়িত্ব, বিনিয়োগকারীদের জন্য তাদের এত সময় কোথায়? তবুও কেউ দায়িত্ব ছাড়তে চায় না। ক্ষমতা আকড়ে ধরে রাখতে চায়! আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হতে পরিত্রাণ দুষ্কর। সংস্কার প্রয়োজন এখানেই।
সম্প্রতি জ্বালনি উপদেষ্টা রপ্তানিমুখী শিল্প ও ইপিজেড এলাকায় শিল্পগুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সুখবর! কিন্তু এ নির্দেশনা প্রজ্ঞাপন আকারে আগেও ছিল, বাস্তবায়নের সমস্যা!
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে তখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করবে ভবিষ্যতে বিনিয়োগওে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। সরকার যখন ইনভেষ্টমেন্ট সামিটের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কথা ভাবছে। তখন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে পণ্য মূল্যও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে ভোক্তারা মূল্যবৃদ্ধির বাড়তি চাপে পড়তে পারে।’
সম্প্রতি চট্টগ্রামে কমেছে এলএনজি সরবরাহ। করা হচ্ছে রেশনিং, বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্ব। চট্টগ্রামে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪শ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ দেওয়া হয় দৈনিক ২৮০ থেকে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট।
চট্টগ্রামের গ্যাস চাহিদার পুরোটাই মেটানো হয় আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে। শিল্প নগরী, বাণিজ্য নগরী, বন্দর নগরী হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ পুরোটাই আমদানিকৃত এলএনজির উপর নির্ভরশীল। সিলেট বা কুমিল্লা অঞ্চলের দেশিয় উৎপাদনকৃত গ্যাস চট্টগ্রামে আনার সুযোগ কারিগরিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে যখন আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহে বিঘ্ন দেখা দেয় তখন দেশিয় গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় চট্টগ্রামে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় যা বিগত সময়ে আমরা দেখেছি। এখানেও চট্টগ্রামের সাথে গ্যাস সরবরাহে বৈষম্যমূলক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রাম বিদ্বেষী ষড়যন্ত্র সব সময় কার্যকরি দেখা যায়। অর্থনীতিকে গতিশীল করা, নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন এবং শিল্প খাতকে সচল রাখার স্বার্থে গ্যাসের দাম কমানো এবং কারিগরি দিক বিবেচনায় সিদ্ধান্তগ্রহণ ও গ্রাহক হয়রানি বন্ধ ও শিল্প উদ্যোক্তাদের দ্রুততম সময়ে সেবা প্রদানে নিশ্চয়তা ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চিয়তা প্রভৃতি বিবেচনায় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ে দাবি। আশা করি দেশের স্বার্থে দেশের অগ্রগতির স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থ বিবেচনায় এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন।