একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী নয়, প্রস্তাবের বিপক্ষে বিএনপি

৭০ অনুচ্ছেদে এমপিদের আংশিক স্বাধীনতায় রাজি রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের সঙ্গে একমত নয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ২১ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

এক ব্যক্তি একইসঙ্গে যাতে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হতে না পারেন সেই সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। কমিশনের এমন প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। এক ব্যক্তি টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; এই বিষয়ে বিএনপি একমত পোষণ করেছে। তবে একবার গ্যাপ দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে কোনো সমস্যা নেই বলে অভিমত দলটির। গতকাল রোববার দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে মধ্যাহ্ন বিরতিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে মত ও দ্বিমতের বিষয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থা চায় বিএনপি। রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের সঙ্গে একমত নয় দলটি। এতদিন পরে রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

এছাড়া সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারে বিএনপি একমত হয়েছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত করতে একমত বিএনপি। মৌলিক অধিকারে সব না এনে যা নিশ্চিত করার সামর্থ্য রয়েছে, ততটুকু করার আহ্বান জানিয়েছি। খবর বাংলানিউজ ও বিডিনিউজের।

৭০ অনুচ্ছেদে এমপিদের আংশিক স্বাধীনতায় রাজি : ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে আংশিক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে বিএনপি, যেখানে বলা হয়েছে, অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে আমরা শুনেছি আস্থা বিল এবং অর্থ বিলের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই একমত। রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে এবং সরকারের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার স্বার্থে আমরা চারটা বিষয় এখানে উল্লেখ করেছিঅর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন, এই চারটা বিষয় বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে তাদের বক্তব্য এবং ভোট প্রদান করতে পারবে। তাতে তাদের সংসদ সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে না।

বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। সেখানে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে। এই বিধানের কারণে খোদ সংসদেই গণতন্ত্র চর্চা ব্যাহত হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করে আসছেন রাজনীতির বিশ্লেষকরা। সেজন্য ৭০ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বিলোপের দাবিও জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংঠন।

১০০ নারী আসন সংরক্ষণের পক্ষে বিএনপি : সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা বলেছি, নারীদের (সংরক্ষিত) আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০তে উন্নীত করার সুপারিশের ব্যাপারে আমরা একমত। কিন্তু সেটা বিদ্যমান পদ্ধতিতেই মনোনয়ন হবে; সেটা আমাদের প্রস্তাবে বলেছি।

নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২১ করার প্রস্তাবে বিএনপি দ্বিমত পোষণ করেছে বলে জানান সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, সকল (সংসদীয়) স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে বিরোধী দল থেকে নেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। আমরা বলেছি, এটা সংসদের প্র্যাকটিস ও সংসদের ওপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে আমরা এভাবে একমত হয়েছি যে, কিছু কিছু স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে, যেমন পাবলিক আন্ডারটেকেন কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি, এই জাতীয় কিছু কমিটিতে বিরোধী দলের মধ্যে থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করা যায়; এই বিষয়ে একমত হয়েছি।

সালাহউদ্দিন জানান, সংসদের উচ্চ কক্ষে আসন সংখ্যা ১০০ তে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছে বিএনপি। উচ্চ কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, কারা আসবে, আনুপাতিক হারে আসবে কিনা সে বিষয়ে বিএনপি বলেছে যে, আগে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সংশোধনীটা সংসদে গৃহীত হোক, দ্বিকক্ষ গঠন হলে পরে সংসদে আলাপ করে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করা ভালো হবে।

আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি প্রসঙ্গে : সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো প্রাথমিকভাবে সংসদে উপস্থাপনের কথা বলেছে কমিশন। আমরা বলেছি, এটা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। তাহলে কোনো চুক্তি রাষ্ট্র যেমন বাণিজ্যিক চুক্তি আছে, বাইলেটারাল চুক্তি, বিনিয়োগ চুক্তি আছে, যেগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নরমাল প্র্যাকটিস করা হয়। চুক্তির পরে সংসদে উপস্থাপনের যে বিধান, যেটা আমরা যেন প্রয়োগ করি। এক্ষেত্রে আমরা বলেছি যে, ডিফেন্স যেসব চুক্তি হয়ে থাকে যেগুলোকে আমরা বলি যে, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তি সেগুলো ক্লোজড সেশনে করাটাই উত্তম।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়বে? : সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা বলেছি যে, রাষ্ট্রপতিকে কী কী বিষয়ে ক্ষমতায়িত করে আইন প্রণয়ন করা যায় সেসব কিছু বিষয়ে এবং নিয়োগের কিছু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। সেগুলো নতুন আইন প্রণয়ন করে সংসদ প্রণীত করা যাবে। সেক্ষেত্রে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স এবং রাষ্ট্রপতির আরো ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে।

তবে ন্যাশনাল কন্টিস্টিটিউশন কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, এটা একটা নতুন ধারণা বাংলাদেশের পলিটিক্যাল কালচারে বা সংসদীয় কালচারে, যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উভয় কক্ষের স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতিসহ আরও কয়েকজনের কথা বলা আছে। এই বডিটার হাতে রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষমতা যেমন সব কমিশন, তিন বাহিনী প্রধান থেকে শুরু করে পিএসসি, দুদকসহ আরও যেসব সাংবিধানিক পদ আছেএগুলো আমরা একমত নই। কারণ আমরা মনে করি, তাতে রাষ্ট্রের এক্সিকিউটিভ ফাংশনটাকে এত বেশি লিমিট করা হবে যে এক্সিকিউটিভ বা প্রধানমন্ত্রী যে নামেই ডাকি, তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা দায় হয়ে যাবে। অথচ দায়িত্বটা থাকবে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের কাছে এবং সংসদে কাছে, অথচ তার কাছে তেমন কোনো পাওয়ার দেওয়া থাকল না। বিএনপি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর রাখা পক্ষেই মত দিয়েছে বলে জানান তিনি।

কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার? : সালাহউদ্দিন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত নয়, তারপরও নির্বাচন আয়োজনের সময় তারা প্রয়োজনের খাতিরেই ৯০ দিনের জন্য অনির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব দিতে চান। দিস ইজ ডকট্রিন অব নেসেসিটি। আমাদের পলিটিক্যাল হিস্ট্রিতে ও কালচারে দেখা গেছে উইথআউট কেয়ারটেকার গভার্নমেন্ট আমরা কোনো ইলেকশনই অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু করতে পারি না। যতদিন পর্যন্ত আমরা সেই কালচারে উন্নীত হতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকারের বিধানটা রাখা উচিত। এই ভোটের জন্য আমরা ১৫ বছর আন্দোলনও করেছি।

আমাদের মতামত, দ্বিমত কমিশনকে বলেছি : নজরুল ইসলাম খান বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনা করছি। আলোচনা অব্যাহত আছে, মোটামুটি ভালো এগুচ্ছে। বেশ কিছু বিষয়ে কাছাকাছি এসেছি, বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের দ্বিমত আমরা বলেছি।

গতকাল সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএনপির প্রতিনিধিদল। সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রথম দিনেই ব্যাটে-বলে হতশ্রী বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধমোবাইল চুরির অভিযোগে গণপিটুনি ও ছুরিকাঘাত যুবকের মৃত্যু