শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিটে ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে দাম বৃদ্ধির এ ঘোষণা দেয়। ১৪ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত অবগত হয়েছি। কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ৩৩% প্লাস–মাইনাস আমরা বাড়ানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেক্ষেত্রে ক্যাপটিভ (বিদ্যুৎ উৎপাদনে) যেটা বর্তমানে ৩১.৫০ টাকা, এটি হবে ৪২ টাকা। শিল্পখাতে বর্তমানে যেটা রয়েছে ৩০ টাকা, এটি হবে ৪০ টাকা। নতুন শিল্পের পাশাপাশি এখন যারা অনুমোদিত লোডের বেশি গ্যাস ব্যবহার করছেন, সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকেও ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে বিল দিতে হবে। নতুন এই দর চলতি এপ্রিল মাসের বিল থেকেই কার্যকর হবে বলে জানান জালাল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সমস্ত কোম্পানি যারা পেট্রোবাংলা, পিডিবির অধীনে লাইসেন্সি, তাদের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করব। সেই দক্ষ জনবলের আমাদের ঘাটতি রয়েছে। এজন্য হয়ত আমরা তৃতীয় পক্ষের কাউকে হায়ার করব।’
গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে এবার শিল্প খাতের জন্য একেবারে যেন মহাবিপদ সংকেত নেমে এসেছে– এমন কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, এমনিতে নানামুখী সংকটে দেশের শিল্প খাতের যখন চিড়েচ্যাপটা অবস্থা, তখন সরকারের এমন সিদ্ধান্তে শিল্পোদ্যোক্তারা একরকম দিশেহারা। অকাট্য যুক্তি থাকলেও বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াতে রাজি নন, উলটো দাম কমানোসহ কমিশন পেতে চান। এর মধ্যে সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত নতুন ট্যারিফ প্ল্যান নিয়েও উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার পারদ তুঙ্গে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নিতে পারছে না। ভুক্তভোগী শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের অনেকে জানিয়েছেন, নতুন করে বিনিয়োগ করা তো দূরের কথা, বিদ্যমান বিনিয়োগ ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ার প্রভাব শুরু হবে অচিরেই। শিল্প কারখানা গ্যাস কিনবে ৩৩% অতিরিক্ত মূল্যে, আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেহেতু খরচ বাড়বে, সেই বিদ্যুৎও কিনতে হবে বাড়তি দামে। তাহলে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে ৫০% এর ওপরে। বিশেষ করে পোশাক শিল্পখাতে এর বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা দেখা দেবে। ইতোমধ্যে আয় ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে না পেরে দুই শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার। রপ্তানিযোগ্য পোশাকের দাম বাড়লে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে ক্রেতা হারাবে আর সেই জায়গা দখলে নেবে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম। আই এম এফের শর্ত মানতে গিয়ে সরকার নিজেদের গলায় নিজেরা ছুরি চালিয়ে দিলো।’
শিল্পমালিকরা বলছেন, সরকার মুখে মুখে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে করছে ঠিক তার উলটো। যেমন: আইএমএফ–এর পরামর্শে ইতোমধ্যে এনবিআর শিল্পের করছাড় সুবিধা কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে এলডিসি উত্তরণ–পরবর্তী সময়ের প্রস্তুতির অংশ হিসাবে ফিনিশড পণ্যের শুল্কহার কমিয়ে আনতে চাইছে। করছাড় না থাকলে এবং ফিনিশড পণ্যের শুল্ক কমানো হলে দেশে কখনোই শিল্পায়ন হবে না। এতে নতুন কর্মসংস্থানও হবে না। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না হলে সর্বোপরি দেশের রাজস্ব আদায়ও কমবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ শুল্ক পরিকল্পনা, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ এবং ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কারণে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প ব্যাপক চাপে রয়েছে, তার ওপর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করায় উদ্যোক্তারা নতুন শিল্প স্থাপনে নিরুৎসাহিত হবেন। তাছাড়া যেভাবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা অযৌক্তিক। দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বিইআরসি। এমনকি গ্যাসের এ দাম বৃদ্ধির ফলে সরকার কত টাকা বাড়তি আয় করবে, তাও জানে না কমিশন। ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম পত্রিকান্তরে বলেছেন, গণশুনানিতে আমরা হিসাব করে দেখিয়েছিলাম দাম না বাড়িয়ে উলটো কমানো যায়। বিগত সরকার এ সেক্টরে যেসব লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেগুলো কমালেই দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।
মোট কথা হলো, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। তাই অর্থনীতির স্বার্থে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।