পথশিশুদের সঙ্গে দুই উপদেষ্টার মধ্যাহ্ন ভোজ

সিএমপির ব্যতিক্রমী আয়োজন । সিএমপির উদ্যোগে পাশে থাকবে দৈনিক আজাদী : এম এ মালেক

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

পথশিশুদের নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরী পুলিশ (সিএমপি) আয়োজিত ব্যতিক্রমধর্মী এক বিশেষ প্রীতিভোজ ও আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, কষ্টে থাকা পথশিশুদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমরা যদি প্রত্যেকেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে এদের জন্য কিছু করি তাহলে সমাজে পথশিশু বলে কিছু থাকবে না। তারা বলেন, পথশিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা দেশের স্বার্থেই জরুরি।

গতকাল দুপুরে মেট্রোপলিটন শ্যুটিং ক্লাবে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক। বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বিভাগীয় কমিশনার ড. মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন, ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শামছুল আলম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। আলোচনাসভার আগে দুই উপদেষ্টা এবং অতিথিবৃন্দ পথশিশুদের সাথে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন। মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজের সভাপতিত্বে ‘একটি নিরাপদ আশ্রয় ও সুন্দর ভবিষ্যৎ সকল শিশুর অধিকার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে পথশিশুদের সমাজ ও রাষ্ট্রের মূলধারায় ফেরাতে করণীয় বিষয়ে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করতে গিয়ে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক বলেন, সমাজের একটি শ্রেণিকে বঞ্চিত রেখে সুন্দর সমাজ গঠন সম্ভব নয়। আজকের এ আয়োজনের কারণে তারা আমাদের সাথে মিশতে পেরেছে, মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে পেরেছে। আমরা চাই তাদেরকে হৃদয়ের উত্তাপে আপন করে নিতে। কারণ আমরা সবাই এদেশের মানুষ, মৌলিক অধিকার পাওয়ার অধিকার আমাদের সকলের। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অধিকার নিশ্চিতে সরকারও বদ্ধপরিকর। শিক্ষা, খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজের সাথে আরো বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে।

উপদেষ্টা ফারুক ই আজম কবিতার পংক্তি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি যারে পশ্চাতে রেখে এসেছি, সে আমারে পশ্চাতে টানিছে’। সমাজ যাদের হাতে নিরাপদ হবে, যাদের হাতে স্বাবলীল থাকবে, যাদের দ্বারা সমাজ প্রস্ফুটিত হবে তাদেরকে আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। তাদের জন্য না রেখেছি খেলাধূলার সুযোগ ও স্নেহভালবাসা, না রেখেছি জীবিকা সহায়ক আয়োজন। সমাজের এ পরিত্যাজ্যতা পথশিশুদের মনে সংক্ষুব্ধতা তৈরি করেছে বলে আমি মনে করি। যখন তারা প্রতিবাদী হয়েছে বা অপরাধের সাথে জড়িত হয়েছে, পুলিশ আইনশৃঙ্খলার প্রেক্ষাপট দেখিয়ে তাদের সংযত করার চেষ্টা করেছে। তাই আমি মনে করেছি, প্রথমে পুলিশকেই তাদের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছাতে হবে। তবেই তাদের প্রাথমিক ভীতিটা কেটে যাবে, তারা যে সমাজের মূলস্রোতে সম্পৃক্ত সেটা অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। তবেই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।

ফারুক ই আজম বলেন, হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের কাছাকাছি যেতে হবে। হুমকি দিয়ে শাসন করে তাদের হৃদয়ে জায়গা পাওয়া যাবে না। তিনি গত ঈদে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে চট্টগ্রামে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের বাসায় যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের কেউই বিত্তশালী নয়। কিন্তু দেশের জন্য তারা অকাতরেই তাদের জীবন দিয়েছে। তারা কেন এভাবে বুক পেতে দিয়েছিল, তাদের ক্ষোভটা ঠিক কোন জায়গায় ছিল সেটা অনুধাবন করতে হবে।

তিনি নগরীর পথশিশুদের জন্য এমন একটি আয়োজন করায় সিএমপি কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আজকের এই মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন আমাদের জন্য প্রাত্যহিক আয়োজন। কিন্তু এই পথশিশুদের জন্য হয়তো এটা বছরে একবার হয়। হয়তো কারো জীবনে এটিই প্রথম এমন মধ্যাহ্ন ভোজ। এদেরকে কাছে টেনে নিতে হবে। এদেরকে সমাজের মূল ধারায় আনতে শিক্ষা স্বাস্থ্য এবং খেলাধুলাসহ সব ধরনের আয়োজন রাখতে হবে। তিনি সিএমপির এই উদ্যোগের সাথে সরকারের সব ধরনের সহায়তা থাকবে বলেও আশ্বস্ত করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, যে দেশ শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে পারে না, সে দেশকে আমরা সফল বলতে পারি না। আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ হতে হবে শিশুদের জন্য। তিনি বলেন, দরিদ্র শিশুদের বিনামূল্যে সরকারি স্কুলে শিক্ষা, বসবাসের জায়গা করে দেয়া, সুস্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং তাদের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি এলাকার কমিউনিটির মাধ্যমে সবাইকে সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে পৃথিবী জানবে বাচ্চারা নিরাপদ, বাচ্চারা সুস্থ এবং বাচ্চারা গড়ে উঠেছে একটি দায়িত্বশীল পরিমণ্ডলে।

উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেটা শিশুদের জন্য নিরাপদ হয়। আজকের সিএমপির এই উদ্যোগ শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার পথে বড় ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি গত আট মাসের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, বহু বিল্ডিং দেখেছি, কিন্তু বিল্ডিংয়ে বিল্ডিংয়ে আবার মানবতার অভাব দেখেছি, হাহাকার শুনেছি। তাই এখানে শুধু একটি বিল্ডিং করে দিলে হবে না, শিশুদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য অন্যান্য কাজও করতে হবে।

মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজের সভাপতিত্বে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন, ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শামছুল আলম, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি

আহসান হাবীব পলাশ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বক্তৃতা করেন। এডিসি (পিআর) স্পিনা রাণীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন পথশিশু নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনেক স্কুল কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। এ পথশিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন খুব অনায়াসে করতে পারে। তিনি পথশিশুদের ব্যাপারে সিএমপি যে উদ্যোগ নেবে তার সাথে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সবসময় একসাথে কাজ করবে বলেও উল্লেখ করেন।

নিজের কারাজীবনের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে বলেন, আমাকে রাজনৈতিক কারণে বেশ কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছে। ওখানে অনেক শিশুকিশোর বন্দী রয়েছে। যাদের সাথে আমি কথা বলেছি। তাদের সাইকোলজি বুঝার চেষ্টা করেছি। একজন চিকিৎসক হিসেবে তাদের অবস্থা অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। তাদের প্রায় সকলেই নানা ধরনের চর্ম রোগে আক্রান্ত। তাদের অনেকে বাইরের জীবন থেকে কারাগার ভালো বলে মনে করে।

দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, চট্টগ্রামের সব ভালো কাজের সাথে দৈনিক আজাদী সবসময়ই থাকে। দৈনিক আজাদীর পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত অন্তত বিশ বছর ধরে দশটি বৃত্তি প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অন্ধ শিক্ষার্থীকে মাসিক বৃত্তি প্রদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিএমপির এই উদ্যোগেও দৈনিক আজাদী পাশে থাকবে। সিএমপি যে ক’জন শিশুর লেখাপড়ার দায়িত্ব দৈনিক আজাদীকে দিতে চায়, আমরা আনন্দের সাথে সেই দায়িত্ব নেবো।

সভাপতির বক্তব্যে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, পথশিশু বলে সমাজে কোনো শব্দ থাকবে না। প্রতিটি শিশুরই নিরাপদ আশ্রয় ও সুন্দর ভবিষ্যতের অধিকার আছে। তিনি অনাথ, গৃহহীন ও অসহায় শিশুদের খাদ্য, শিক্ষা ও বাসস্থানের দায়িত্ব সকলের বলে উল্লেখ করেন। তিনি পথশিশুদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সমাজের বিত্তবান ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন। পরে পথশিশুদের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবির স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন অবদান রাখবে সুনীল অর্থনীতিতে
পরবর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন এখন সম্ভব নয়