নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে গত সোমবার নগরে বরণ করা হয়েছে নতুন বছরকে। ফেলে আসা বছরের সমস্ত হতাশা, গ্লানি, দুঃখ এবং না পাওয়ার যন্ত্রণা ভুলে পহেলা বৈশাখ নতুন বঙ্গাব্দকে বরণে এদিন উৎসবে মেতে উঠেন নগরবাসী। সকাল থেকে নানা বয়সী লোকজনের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থল সিআরবি শিরীষতলা, শিল্পকলা একাডেমি, চারুকলা ইনস্টিটিউট, জুলাই স্মৃতি উদ্যানসহ (জাতিসংঘ পার্ক) বিভিন্ন প্রাঙ্গণ। নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরার প্রেরণা সৃষ্টিকারী পহেলা বৈশাখের আয়োজন থেকে মানবিক এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ এবং বিভেদ–বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ডাক দেওয়া হয়েছে।
এবার বর্ষবরণে চারুকলা ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি এবং অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে নববর্ষ বরণে পৃথক আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। নূর আহম্মদ সড়কে নগর বিএনপিও শোভাযাত্রা বের করে। সবগুলো শোভাযাত্রা উচ্ছ্বসিত লোকজনের সরব উপস্থিতিতে পূর্ণ ছিল। গত ৪৬ বছর ধরে নগরের ডিসি হিলে বর্ষবরণের আয়োজন থাকলেও এবার কোনো অনুষ্ঠান হয়নি সেখানে। গত শনিবার রাতে মঞ্চে হামলা–ভাঙচুরের ঘটনায় সেই আয়োজন বাতিল করা হয়।
সিআরবি শিরীষতলা : ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে সিআরবি শিরীষতলায় সকাল ৭টায় শুরু হয় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। নববর্ষ উদযাপন পরিষদের দিনব্যাপী এ আয়োজনে আয়োজনে উদীচী চট্টগ্রাম, সঙ্গীত ভবন, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, বাংলাদেশ রেলওয়ে সাংস্কৃতিক ফোরাম, স্বরলিপি সাংস্কৃতিক ফোরাম, সৃজামী, অদিতি সঙ্গীত নিকেতনসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা সম্মিলিত গান পরিবেশন করেন। বোধন আবৃত্তি পরিষদ, শব্দনোঙ্গর, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসসহ কয়েকটি সংগঠনের শিল্পীরা বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করেন। নৃত্য পরিবেশন করেন ওড়িশি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, নৃত্যনীড়, রাগেশ্রীসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা। সকালে লোকজন কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে সিআরবিতে ভিড় বাড়তে থাকে।
নববর্ষ উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ফারুক তাহের সাংবাদিকদের বলেন, পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। সকল মত–পথের ঊর্ধ্বে উঠে এদিনটি আমাদের এক হয়ে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরার প্রেরণা দেয়। আমরা একেকজন একেক ধর্মের অনুসারী হতে পারি। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফালগুন, পৌষ পার্বণ, নবান্ন এগুলো আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতি।
জেলা শিল্পকলা একাডেমি : চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ছিল নানা আয়োজন। সকাল ৮টায় শুরু হওয়া আয়োজনের মধ্যে ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আনন্দ শোভাযাত্রা উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। অনুষ্ঠানে জেলা শিশু একাডেমিতে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) ওয়াহিদুল হক চৌধুরী ও সিএমপির উপ–কমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি) নেছার উদ্দিন আহমেদ। সঞ্চালনা করেন চান্দগাঁও ভূমি সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইউসুফ হাসান। বক্তব্য রাখেন জেলা আনসার–ভিডিপি কমান্ডার মো. আবু সোলায়মান ও জেলা মহিলা বিষয়ক উপ–পরিচালক আতিয়া চৌধুরী।
আলোচনা সভায় বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, নতুন প্রজন্ম যাতে হৃদয়ের আনন্দে নববর্ষ উদযাপন করতে পারে সে পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। নববর্ষের দিনটি সকলের কাছে আনন্দের বিষয় হয়ে থাকুক–এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, পহেলা বৈশাখ এমন একটা অনুষ্ঠান যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি বজায় থাকে। আনন্দ শোভাযাত্রার মাধ্যমে এ অনুষ্ঠানে সকলের উপস্থিতি প্রমাণ করে পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। তাই পুরনো বছরের দীনতা, গ্লানি মুছে দিয়ে নতুন বছরকে নতুনভাবে সাজিয়ে আমরা সকলে মিলে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ করব।
অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রথমে দলীয়ভাবে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়। দলীয় সংগীত ও দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন চট্টগ্রাম জেলা শিশু একাডেমি ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিক্ষার্থীরা।
আনন্দ শোভাযাত্রা : সকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। নগরের চট্টেশ্বরী মোড়–আলমাস মোড়–কাজির দেউড়ি মোড়–এস এস খালেদ রোড–প্রেস ক্লাব ইউটার্ন–সার্সন রোড হয়ে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে গিয়ে শেষ হয় শোভাযাত্রাটি। শিক্ষার্থীদের তৈরি জাতীয় মাছ ইলিশ এবং টেপা পুতুলের ঘোড়ার মোটিফের পাশাপাশি বাঘ, মহিষ ও খরগোশের মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেন সাবেক–বর্তমান শিক্ষার্থীরা। ছিলেন শিক্ষকরাও।
শোভাযাত্রায় মেয়র : সোমবার সকালে অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে আয়োজিত নববর্ষ বরণের আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। শোভাযাত্রায় অংশ নেন সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক–শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা–কর্মচারীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। শোভাযাত্রাটি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ হয়ে নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
এ সময় মেয়র বলেন, নতুন বছর হোক নতুনভাবে শহরকে গড়ার অপুপ্রেরণার। সবাই মিলে একটি ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি চট্টগ্রাম গড়তে হবে। এজন্য নগরবাসীর সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। চট্টগ্রাম শুধু একটি শহর নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য একটি স্বপ্নের নগরী; যা গড়তে হলে প্রত্যেকেরই দায়িত্ব নিতে হবে।
এতে অন্যান্যের মধ্যে অংশ নেন চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা ড. কিসিঞ্জার চাকমা, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, শিক্ষা কর্মকর্তা মোছাম্মৎ রাশেদা আক্তার, অপর্ণাচরণ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবু তালেব বেলাল, সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশিদ প্রমুখ।
জুলাই স্মৃতি উদ্যান : পাঁচলাইশ আবাসিক কল্যাণ সোসাইটির উদ্যোগে জুলাই স্মৃতি উদ্যান (জাতিসংঘ পার্ক) প্রাঙ্গণে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, নতুন বছর হোক গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও ভোটাধিকার রক্ষার বছর। আমরা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এই বছর যেন আমাদের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বছর হয়। তিনি বলেন, বৈশাখে যেমন হঠাৎ বৃষ্টি নামে, তেমনি ঋতুগুলোর সীমানা গুলিয়ে যাচ্ছে। আমরা যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছি, তেমনি হারাচ্ছি রাজনৈতিক ভারসাম্যও।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সিএমপির উপ–পুলিশ কমিশনার আমিরুল ইসলাম, সমাজসেবক রিয়াজুল আনোয়ার চৌধুরী সেন্টু, পাঁচলাইশ থানার ওসি মোহাম্মদ সোলায়মান, কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবু সাইদ সেলিম, সহ–সম্পাদক সৈয়দ নাজ্জাম আহমদ বাবু, এঙিকিউটিভ মেম্বার মো. নিজাম উদ্দিন, সৈয়দ নাসিম, মোহাম্মদ নজরুল আজাদ, মোহাম্মদ কায়সার, মোহাম্মদ নাদিম আহমদ, মহানগর বিএনপির সদস্য কামরুল ইসলাম, মো. লোকমান, নুরুদ্দিন আহমেদ রাজা ও বদিউল আলম বদি।