রঙ্গে ভরা বঙ্গ উৎসব

ছন্দা চক্রবর্ত্তী | সোমবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

কথায় বলে বারো মাসে তের পার্বণ। আর পার্বণ মানেই তো উৎসব এর উৎস। উৎসব মানেই ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভূবণে’। চারদিকের কঠিন বাস্তবতায় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাধারণ জনগণ আনন্দ খুঁজে নেন। রবীন্দ্রনাথ উৎসব এর সংজ্ঞায়নে বলেছেন, ‘উৎসবের দিনে আমরা যে সত্যের নামে বহুতর লোকে সম্মিলিত হই, তাহা আনন্দ, তাহা প্রেম। উৎসবে পরষ্পরকে পরষ্পরের কোনো প্রয়োজন নাই, —সকল প্রয়োজনের অধিক যাহা, উৎসব তাহাই লইয়া। এইজন্য উৎসবের একটা প্রধান লক্ষণ প্রাচুর্য। উৎসব দিনে আমরা প্রতিদিন এর কার্পণ্য পরিহার করি, প্রতিদিন যেমন হিসাব করিয়া চলি, আজ তাহা অকাতরে জলাঞ্জলি দিতে হয়। উৎসবের দিন দৈন্যের দিন নয়, আজ ঐশ্বর্যের দিন।’

মানুষ নিজের নিত্য নৈমিত্তিক কাজের মধ্যে ক্ষুদ্র হয়, কিন্তু উৎসব এর দিনে মানুষ পরষ্পরের সঙ্গে একত্রে মিলিত হয়ে বৃহৎ হয়ে যায়। যে কোনো ছোটো বড় উৎসবের দিনে মানুষ যেহেতু সমস্ত ক্ষুদ্রতা, হীনতা, অসততার গণ্ডিকে অতিক্রম করে নিতে পারে, তাই সেই বিশেষ দিনকে আনন্দের দিন হিসেবে গণ্য করে। উৎসবে সবসময় একটি শুভবোধ থাকে, একটা মঙ্গলজনক ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ। একটি সৎ উদ্দেশ্যকে ঘিরেই উৎসবের আয়োজন হয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেন, ‘সত্যকে অস্বীকার করিয়া ভণ্ডামি দিয়া কখনোও মঙ্গল উৎসবের কল্যাণ প্রদীপ জ্বলিবে না।’ তাই তো যেকোনো ধরনের কল্যাণমূলক আনন্দময় অনুষ্ঠানকেই উৎসব বলে। উৎসব মানুষের মনের সকল দুশ্চিন্তা, হতাশা দূর করে প্রাণবন্ত করে তোলে, উৎসব এলে ধনী গরীব, দু:খীসুখী, হিন্দুমুসলিম, বৌদ্ধখ্রিস্টান সবার মধ্যে একতাবোধ ও সাম্যতার আনন্দ দেখা দেয়। বাংলাদেশের মানুষ আর্থিক, পারিপার্শ্বিক বা পরিবেশ গত টানাপোড়েনের ভিতর থাকলেও যে কোনো উৎসবকে সাদরে নিয়ে উৎসবে মেতে থাকতে পছন্দ করে। বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত খাঁটি কথাটিই বলেছেন। ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা’।

বাঙালি জাতির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যই হলো হৈহুল্লোড় করা, আড্ডাপ্রিয় এবং ভোজনরসিকও বটে। তাই যে কোনো উৎসবে এইসব গুণের প্রকাশ পায়। বাংলাদেশে নানা ধরনের উৎসব দেখা যায়, যেমনধর্মীয়, সামাজিক, জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক। ধর্মীয় উৎসব এর মধ্যে ঈদুল ফিতর, দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, কোরবানির ঈদ, বুদ্ধ পুর্ণিমা, বড়দিন, বৈসাবী পূজা উৎসব হিসাবে উল্লেখযোগ্য প্রাধান্য পায়। সামাজিক উৎসব এর মাধ্যমে মানুষ আনন্দ খুঁজে নেয়। এ বছর অন্তর্র্বতী সরকারের সময়ের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কর্তৃক আয়োজিত ঈদ উৎসব পালনে ঈদর‌্যালী সবার মাঝে আলাদা আনন্দের উৎস হিসেবে যোগ হয়েছে। জাতীয় দিবস সমূহে জাতীয় উৎসব পালনেও বাংলাদেশের মানুষ আনন্দ করে থাকে। যেমন, ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উৎসব হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে। ইদানীং কয়েক বছর থেকে বাঙালি জাতির নববর্ষ উদযাপন তথা ‘পয়লা বৈশাখ’ সরকারিভাবে পালন করা হয়ে থাকে। জাতীয় দিবস সমূহের মতো পয়লা বৈশাখ এখন সাড়ম্বরে পালিত হয়।

পয়লা বৈশাখ এর এই উৎসব পরিণত হয়েছে সব থেকে বড় উৎসবে। কারণ এই একটি মাত্র উৎসবে ধর্মবর্ণধনীদরিদ্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ একসঙ্গে একই অনুভবে একাত্ম হয়ে উৎসবে সামিল হন। উদযাপন করেন বাংলাদেশের তথা বাংলার গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। বছরের প্রথম দিনটিকে আনন্দঘন উৎসব আয়োজন এর মধ্যে দিয়ে উদযাপন করার রীতি রেওয়াজ বহু প্রাচীন, পৃথিবীর বহু দেশে প্রচলিত আছে। আমাদের দেশে পয়লা বৈশাখ এর উৎসব মূলত সাংস্কৃতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় জমজমাট আয়োজন নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে থাকে। যত দিন যায়, বছর ঘুরে আসে, নতুন বছর নতুনভাবে আলাদা আনন্দমুখর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে, চট্টগ্রাম শহরের ডিসি হিল, শিরীষ তলা, আমবাগান আরো নানা স্থান পয়লা বৈশাখের ভোর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন সাঁই, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের গান ও গানের সাথে নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে সুরে সুরে আকাশ ভরিয়ে তোলেন। এসব গানে থাকে, পুরানো বর্ষের ব্যর্থতা গ্লানি পরিত্যাগ করে নতুন বছরের নতুন সম্ভাবনায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা। প্রায় সবখানে বেশি শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ এর–‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’।

গ্রামের চেয়ে শহরে পয়লা বৈশাখ উদযাপন বেশ আনন্দঘন পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিছু কিছু গ্রামে পয়লা বৈশাখের আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসে এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চড়ক পূজা বা ক্ষেত্রপাল পূজা করে থাকে এই উপলক্ষে মেলা বসে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে নানা স্থানে বৈশাখী মেলা বসে। মেলায় ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান যা বাংলার ঘরে ঘরে নিত্য ব্যবহার্য, এসব সামগ্রীর প্রচুর পসরা সাজিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা বৈশাখী মেলা কে অন্যান্য মেলা থেকে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। গ্রামে বা শহরে মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলার প্রতিটি ঘরে এই বৈশাখী মেলা থেকে কিছু না কিছু কিনে থাকে। এই উৎসবকে ঘিরে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ঘরে ঘরে সাজ, সাজ রব উঠে। উৎসব এর সাথে আনন্দের যোগ আছে, তাই আনন্দকে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য, পুরানো বছরে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে, সাধ্যমতো নতুন কাপড়, নতুন আসবাবপত্রেরও আগমন ঘটে কোনো কোনো ঘরে। কেউ কেউ ঘরদোর ফুলপাতার মালা দিয়ে সাজিয়ে তোলে। এই সাজসাজ রবের সমর্থন পাই রবীন্দ্রনাথ এর কথায়, তিনি বলেছেন, উৎসব এর দিন সৌন্দর্য এর দিন। এইদিনকে আমরা ফুল পাতা দ্বারা সাজাই, দীপমালার দ্বারা উজ্জ্বল করি, সংগীতের দ্বারা মধুর করিয়া তুলি।’ বৈশাখ আমাদের কাছে উৎসব এর পসরা নিয়ে হাজির হয়, গ্রাম, শহর সবখানে এই উৎসব এর আমেজের সাথে মেলার পসরা তো আছেই, আছে ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তাইলিশ খাওয়া, অবশ্য এখন ইলিশ মাছের দাম হাতের নাগালের বাইরে, তবু্‌ও কোথাও কোথাও এর দেখা ও স্বাদ মিলবে। রসনা প্রিয় বাঙালি এর স্বাদ নিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে থাকে, তবে এবছর সরকারের পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখে ইলিশ কেনা বা খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উৎসব এর রসনাবিলাস জনিত আরো একটি দিক রয়েছে এতদঅঞ্চলে সেটাকে বলা হয় পাঁচন রান্না এবং খাওয়া। বর্ষবিদায় এর দিন প্রকৃতি জাত সব ধরনের শাকসবজি মিলিয়ে যেখানে প্রচলিত ব্যবহৃত সব্জির সাথে অপ্রচলিত উদ্ভিজ্জ কান্ড, শাখা পাতা, ফুল, ফল দিয়ে অসাধারণ সুস্বাদু পাঁচন রান্না করা হয়। এই পাঁচন খাওয়ার উদ্দেশ্য হলো নতুন বছরের জন্য স্বাস্থ্যকে ইমিউন সিস্টেমে ঋদ্ধ করা যাতে প্রত্যেকে রোগব্যাধি থেকে প্রকৃতিগতভাবে মুক্ত থাকতে পারে। বিশ্বাস করা হয় যে স্রষ্টার সৃষ্টিজাত প্রতিটি উপাদান মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়। তাই তো এই ইমিউন সমৃদ্ধ শাক সব্জির মিলিত রান্না।

পয়লা বৈশাখ উদযাপন উৎসব এর প্রধান আকর্ষণ মঙ্গলশোভা যাত্রা। ১৯৮৬ সাল থেকে সংস্কৃতিকর্মীদের শুভ ভাবনা থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হয়ে আজকের মঙ্গলশোভাযাত্রা। এই মঙ্গলশোভাযাত্রাকে বর্ণিল করে তোলার জন্য দেশীয় লোকজ উপাদানের তৈরি পুতুল, হাতি, ঘোড়া হরেক রকমের বিচিত্র অনুসঙ্গ এই মঙ্গলশোভা যাত্রার আকর্ষণীয় সৌন্দর্য। মঙ্গলশোভা যাত্রার আজকের অবস্থা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, মৌলবাদীদের চোখ রাঙানি ও অনেক শুভবোধযুক্ত সংস্কৃতি কর্মীর প্রাণত্যাগ এর মাধ্যমে অর্জিত ফসল। ভালো লাগার বিষয় হলো, এই নববর্ষ উদযাপন এর মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেসকো এর মাধ্যমে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন একদিকে বিশ্বজনীন, এবং অপরদিকে এটি বর্ষবরণের নানা আয়োজন বাংলা সংস্কৃতির স্বকীয়তার প্রতীক। মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল উদ্দেশ্য আমাদের লোকশিল্প, আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরে রাখা। মঙ্গল শোভাযাত্রার সুসজ্জিত মিছিলে যে উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা হিন্দুমুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবার ঐতিহ্যগত সম্পদ। এটি আমাদের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার একটা উপায়।

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহনূর ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিজিটাল দুনিয়ার অদৃশ্য শক্তি
পরবর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে বিদ্যুতের তার থেকে উদ্ধার লজ্জাবতী বানরটি বনে ফিরল