৭ এপ্রিল ২০২৫ সোমবার বিশিষ্ট রম্যসাহিত্যিক সত্যব্রত বড়ুয়া (আমাদের সত্যদা) চলে গেলেন সব কথার, সব জিজ্ঞাসার অবসান ঘটিয়ে। দেখতে গেলাম তাঁর প্রিয় বাসস্থান জ্যোতির্ময়’র ছাদে। এই ছাদটি ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। প্রয়োজনে রৌদ পোহাতেন, গভীর মনোযোগে বই পড়তেন এবং ডিসি হিল এর অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। অবশ্য মাঝে মাঝে বিরক্ত বোধ করতেন ডিসি হিলের অনুষ্ঠানের আধিক্যে, শব্দ দূষণের কারণে। এই নিয়ে মাঝে মাঝে কলমও ধরেছেন। আত্মীয় স্বজন পরিবেষ্টিত ফুলে ফুলে ঢাকা তাঁর নিথর দেহখানি দেখে খুব কষ্ট পেলাম। পরিণত বয়সেই তো গেলেন, তবুও মন ভারাক্রান্ত হলো। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান মনে পড়ল “যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা, নয়নের আঁধার রবে ধেয়ানের আলোক রেখা।” বহু মানুষের মাঝে আজ আপনি একা। সব লেনদেন চুকিয়ে, কর্ম সাঙ্গ করে শান্তির পারাপারে তরী ভাসালেন আপনি, রেখে গেলেন স্মৃতি। বাসায় ধমীয় গুরু ড. জিনবোধি ভিক্ষু ধর্ম দেশনা দিচ্ছিলেন আমিও স্মৃতিচারণ করলাম। ভান্তের ধমীযয় আলোচনায় কষ্ট কিছুটা লাঘব হলো। শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন না তিনি। বিগত কয়েক বছর ঘরের বাইরে আসতেন না। সর্বশেষ প্রেস ক্লাবের বড় হল ঘরে তাঁর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন। বক্তব্য রেখেছেন চিরাচরিত রম্য কথা দিয়ে। সভাস্থল রসসিক্ত হলো তাঁর সরস বক্তব্যে। শারীরিক অসুস্থতা তাঁর কণ্ঠ রোধ করতে পারেনি। প্রায় ফোনে কথা হত। সবার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেন। এমন পরম কল্যাণকামী মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। আত্মীয় পরিজনদের সাফল্যর কথা জানান দিতেন অত্যন্ত আনন্দের সাথে এতেই যেন তাঁর গৌরব। আজাদীতে প্রকাশিত আমার লেখার মনে হয় তিনিই প্রথম পাঠক। সবার আগেই ফোন করতেন।
তাঁদের পারিবারিক সমপ্রীতি, আত্মীক বন্ধন (যা আজকের সমাজে বিরল) আমাকে বিস্মিত এবং মুগ্ধ করত। কিছুদিন আগে তাঁর গ্রামের বাড়ি মহামুনি পাহাড়তলি গিয়েছিলাম মৈত্রী ফাউন্ডেশন একটি অনুষ্ঠানে তাঁর ভাইদের আগ্রহে। ঘরে ঢুকতে চোখে পড়ল দেওয়ালে টাঙ্গানো প্রয়াত পূর্বপুরুষদের ছবি। (যাঁদের মধ্যে অনেকের বিভিন্ন পর্যায় স্বনামখ্যাত।) অত্যন্ত যত্নে রাখা এ ছবিগুলো জানান দেয় প্রয়াতজনদের প্রতি পারিবারিক শ্রদ্ধাবোধ। জানলাম এ পরিকল্পনার পিছনে সত্যদার ঐকান্তিক উৎসাহের কথা।
সত্যদার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০৬ এ অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর এক সাহিত্য সভায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কথা বলছিলেন, সেদিনে বুঝতে পেরেছি তিনি একজন সাহিত্যপ্রেমিক মানুষ, পরিশীলিত জীবনবোধে ঋদ্ধ। অবসরে আছেন, লেখালেখিতে স্থিত হয়েছেন, রম্যসাহিত্যে হাত পাকিয়েছেন। নিয়মিত লিখেছেন, বই প্রকাশ করেছেন, দৈনিক আজাদী, দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ এর নিয়মিত তাঁর লেখা ছাপা হতো। প্রচুর বই তাঁর সংগ্রহে। পাঠ করতেন বিভিন্ন স্বাদের বই অক্ষয় উৎসাহে। তিনি একজন মানবিক, সংস্কৃতিবান মানুষ। সমাজের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার কারণে তাঁর লেখনি ধারণ। আমাদের চারপাশের নানান অসংগতি, মেকি আচার অনুষ্ঠান তাঁকে ক্লিষ্ট করেছে যা তিনি প্রকাশ করেছেন অবলীলায় ব্যঙ্গরস সিক্ত করে। তাঁর লেখনি জীবন ঘনিষ্ঠ আমাদের জটিল সমস্যা সংকুল জীবনে তাঁর রম্য রচনা আমাদের নির্ভেজাল আনন্দ যোগায়। তিনি মনে করতেন, শেকড় উৎপাটন করে সংস্কৃতির উৎকর্ষ হয় না। সংস্কৃতিতে সুপরিবর্তন আসতে হবে। চট্টগ্রামের অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাথে ছিল তাঁর প্রাণের যোগ। এ সংগঠনকে তিনি ভালোবাসতেন। প্রতি বছর তাঁদের ‘বাঙালি সংস্কৃতির মেলা’ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে তিনি শ্রম ও মেধা দিয়েছেন নিজ গুণে।
সত্যদার সাথে শেষ দেখা হলো ১৮.০২.২০২৫। অসুস্থতার কথা শুনে দেখতে গেলাম। কত খুশি হলেন, কত কথা বললেন, কত জনের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই ‘জয়তু বেলা’ আমাকে শুভেচ্ছা স্বরূপ উপহার দিলেন, বইয়ে নিজের নাম লিখে দিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুট নিয়ে এ বইটির শিরোনাম ‘‘জয়তু বেলা’’ রাখা হয়েছে। এ বইতে তিনি ৩৩টি প্রসঙ্গ অবতারণ করেছেন। আমি বইটির আলোচনা করব, এই আগ্রহ প্রকাশ করলেন। দুঃখ রয়ে গেলো আমি সময়মতো তাঁর জীবদ্দশায় লিখতে পারলাম না। এর আগে তাঁর আরও ৫টি রম্যগ্রন্থ ‘বাঁকা চোখে’ ‘যদি সুন্দর একখান মামা পেতাম’ ‘রম্য সম্ভার’ ‘ব্যাঙের সদ্দি’ ‘গাধা কাহিনী’ প্রকাশিত হয়েছে এবং সুধী মহলে সমাদৃত হয়েছে। আমার সৌভাগ্য তাঁর বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তাঁর আগ্রহে আমিও আলোচক থাকতাম। তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি বইয়ের ওপর আমার আলোচনা দৈনিক আজাদীতেও প্রকাশিত হয়েছে। একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামের ইতিহাস, সাহিত্য সংস্কৃতি, গবেষণা বিষয়ক সংগঠন চট্টগ্রাম একাডেমিরও তিনি একজন সক্রিয় জীবন সদস্য ছিলেন। নিজ গ্রাম মহামুনি পাহাড়তলীর কল্যাণে তিনি নিরন্তন ভাবতেন এবং গ্রামের উন্নয়নে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও প্রায় গ্রামে যেতেন। তাঁর কর্মকীর্তির জন্য বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে সম্মাননা জানিয়েছেন। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই এবং বিশ্বাস করি, তিনি তাঁর প্রিয়জনদের মাঝে থাকবেন নিরন্তর, সুধারস ঢালবেন। পরিশেষে বলি, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’’।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ।