প্রাক-বাজেট আলোচনায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ১১৪ প্রস্তাবনা

রাজস্ব আদায়ে যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হবে কর হার : এনবিআর চেয়ারম্যান

আজাদী প্রতিবেদন  | শুক্রবার , ১১ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, দেশের উন্নয়নে রাজস্ব আহরণের চাপ বাড়ছে। গত অর্থবছরে ৪৫ লাখ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। যার মধ্যে ৩০ লাখ করদাতা শূন্য রিটার্নধারী। বাকী ১৫ লাখ করদাতা থেকে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। এত কম সংখ্যক লোকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। যারা রিটার্ন দিচ্ছেন না, জরিপের মাধ্যমে তাদের নোটিশ দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে তাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হবে।

গতকাল দুপুরে নগরীর আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রাকবাজেট আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভায় ২০২৫২৬ অর্থবছরের বাজেটকে ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব করতে আয়কর বিষয়ক ১৯টি, ভ্যাট বিষয়ক ৪০টি ও শুল্ক বিষয়ক ৫৫টি সহ মোট ১১৪টি প্রস্তাবনা দেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এবারের বাজেট হবে সিগনিফিকেন্ট, ব্যবসাবান্ধব বাজেট। বাজেট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে, এবার তেমনটি হবে না। আগামী বাজেটে ঘাটতি থাকবে, কিন্তু যাতে মূল্যস্ফীতি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে। রাজস্ব আদায়ে যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হবে কর হার।

তিনি আরো বলেন, ভ্যাটট্যাঙ প্রদান আরও সহজ করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন অনিয়ম হওয়ায় কিছুটা জটিল হয়েছে। তবে সহজ করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। আগে তো ট্যাঙের জন্য সোনালী ব্যাংকে, বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই। এখন কোথাও যাওয়া লাগে না, কোনো ব্যাংকে যাওয়া লাগে না। আপনি ইচ্ছে করলে ব্যাংকে গিয়েও দিতে পারেন, আবার অনলাইনে বসেও ট্যাঙ দিয়ে দিতে পারেন। ট্যাঙ দিয়ে চালানটা নিয়ে গেলেই সার্ভিসটা পাওয়া যাবে, এই ব্যবস্থা যদি করতে পারি, তাহলে টাকা কালেকশনের ঝামেলাটা আর থাকবে না। পৃথিবীর সকল জায়গায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা হওয়াটা উচিৎ ডিরেক্ট, ইনডিরেক্ট হলেই নানা ঝামেলা হয়।

তিনি বলেন, অটোমেশনে অনেকে আসতে চায় না। তবে এবার অনলাইনে আয়করে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। ১৫ লাখ ৩০ হাজার অনলাইন রিটার্ন পেয়েছি। বন্ডে ব্যাপক সমস্যা আছে। আমরা পুরোপুরি অটোমেশন করতে চাই। কাউকে সরকারি অফিসে যেতে হবে না। নতুন জুতো পরলে প্রথমে পায়ে সমস্যা হয়, পরে ঠিক হয়ে যায়। ভ্যাটের রিটার্ন ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দেব। অনলাইনে দিলে সিল আনার পদ্ধতি বাতিল করেছি। ভ্যাট ও আয়করে অডিট সিলেকশনে ব্যক্তি জড়িত থাকবে না। তাহলে কেউ প্রতারণা করতে পারবে না। রিফান্ড দেওয়ানেওয়ার মধ্যে হয়রানি আছে। আমরা এটা অটোমেশন করতে চাই।

আবদুর রহমান খান বলেন, যারা ব্যবসা বাণিজ্য করছেন, দেশের জন্য কর্মসংস্থান করছেন তারা রিয়েল হিরো। সরকার তো মাত্র ১৫ লাখ মানুষকে চাকরি দিয়েছে। বাকি চাকরি বেসরকারি খাতে। আমাদের সবাই মিলে দেশকে সুশৃঙ্খল করতে হবে। বড় বড় ভুল শুধরে নিতে হবে। দফায় দফায় জীবন দিতে হয়এমন জাতি কম আছে। জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

সভায় স্বাগত বক্তব্যে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা বলেন, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো থিওরি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশও সত্যিকারের একটি কল্যাণমূলক ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তবে নতুন সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচিত হবে। এজন্য আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে বিকল্প উপায় বের করতে হবে। আমদানি পর্যায়ে করহার পুনর্বিন্যাস, কিংবা দেশীয় শিল্প সুরক্ষার জন্য নানাবিধ প্রণোদনার বিকল্প উপায় বের করতে হবে। ট্যাঙ সিস্টেমের সময়োপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে ট্যাঙ জিডিপি অনুপাতও কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নীত করার আহ্বান জানান তিনি। চেম্বার প্রশাসক সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৪ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা সময়ের দাবি উল্লেখ করে পরবর্তী ধাপগুলো পুনর্বটন করার মাধ্যমে মধ্যম আয়ের করদাতাদের মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ সহনীয় এবং ব্যক্তিগত ট্যাঙ লায়বিলিটি কমিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি করদাতাদের রিটার্নে উৎসাহিত করা গেলে করদাতার সংখ্যা যেমন বাড়বে তেমনি রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলে উল্লেখ করেন।

মেট্রোপলিটন চেম্বার সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, শেয়ার বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে। শেয়ারের উপর ৪০ শতাংশ এবং ডিভিডেন্ডের উপর ২৫ শতাংশ দিলে কী থাকে উদ্যোক্তাদের। তিনি এই করহার কমানো এবং প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর করহার কমানোরও আহ্বান জানান।

উইমেন চেম্বারের সভাপতি আবিদা মোস্তফা বলেন, দেশের এসএমই খাতে ভূমিকা রাখছেন নারী উদ্যোক্তারা। তাই আগামী বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের এসএমই খাতে সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি সরওয়ার জামাল নিজাম বলেন, দেশের ৪৭ শতাংশ বিজনেস ও ফিনান্সিয়াল একটিভিটিজ হয় চট্টগ্রামে। এটা অনুধাবন করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার করেছেন। এক টাকায় চেম্বারকে এ জায়গা দিয়েছিলেন। জনগণের ওপর যাতে করের চাপ না হয়।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এরশাদ উল্লাহ বলেন, গত ১৫ বছর এ চেম্বারে গঠনমূলক কিছু হয়নি। আমি মনে করি, আগামী বাজেট গণমুখী হবে। চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রস্তাবনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এইচএসকোড নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। এগুলো সমাধান করতে হবে।

বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এবার বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা বেশি। আরএমজি সেক্টর প্রত্যাশা করে রপ্তানিবান্ধব বাজেট। আমরা রপ্তানি করে দেশ সমৃদ্ধ করতে চাই, কর্মসংস্থান করতে চাই। আইন সহজ না করলে, জটিল প্রক্রিয়ায় রপ্তানি বাড়বে কীভাবে। অডিট নিয়ে ঘুরতে হলে ব্যবসা করবো কখন। ভ্যাট থেকে রপ্তানি খাতকে বাদ দিতে হবে।

সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সহসভাপতি বেলাল আহমেদ, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক হাসানুজ্জামান চৌধুরী (জোসেফ) ও আমজাদ হোসেন চৌধুরী, পান রপ্তানিকারক এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. একরামুল করিম চৌধুরী, কঙবাজার চেম্বার সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা, রাঙামাটি চেম্বার সভাপতি মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ মামুন, চট্টগ্রাম ট্যাঙেস বার এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আবু তাহের, চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শওকত আলী, চট্টগ্রাম ফ্রেশ ফ্রুটস ভেজিট্যাবলস এঙপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব রানা, বাংলাদেশ ফার্ণিচার শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মাকসুদুর রহমান, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি সালেহ আহমেদ সুলেমান, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট এন্ড বিজনেসেস ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কামরুল হুদা, চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এঙেসরিজ এসোসিয়েশনের মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, বিএসআরএম জিএম শেখর রঞ্জন কর ও সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা সাব্বির আহমেদ শামীম প্রমুখ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসিনা ও পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
পরবর্তী নিবন্ধপরীক্ষায় বসতে পারেনি ১৩ পরীক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভাঙচুর, সড়ক অবরোধ