দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কী ঝমকালো এক অনুষ্ঠান! দুই হাজারেরও বেশি মানুষ একটি হলরুমে, অথচ কোন বিশৃংখলা নেই। নেই কোন হৈ হুল্লুড়। অনুষ্ঠান চলছিল, সঞ্চালনায় থাকা যুবকযুবতী এক একটি ইভেন্ট একেকভাবে উপস্থাপন করছিলেন। অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের সামলে নেয়ার দায়িত্বেও খুব বেশি লোকজন নেই, গুটিকয়েক চীনা যুবকযুবতী অতি সাবলিলভাবে সবকিছু সামলে নিচ্ছিলেন। লেটেস্ট ডিজাইনের এয়ারফোনই তাদের যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের প্রধান মাধ্যম। প্রযুক্তির দুনিয়া দাপিয়ে বেড়ানো চীনের অন্যতম বিখ্যাত কোম্পানি জ্যাক টেকনোলজিস যে প্রযুক্তিকেই ভর করেই তাদের বিশাল অনুষ্ঠান সামলে নেবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার যে এতো ব্যাপক হবে তা আমার ধারণাতে ছিল না।

জ্যাকের উৎপাদিত সাধারণ সেলাই মেশিনের শক্তি পরীক্ষা করাতে অভিনব এক আয়োজন মঞ্চস্থ হলো। জ্যাক কোম্পানির পাঁচটি সেলাই মেশিন মঞ্চে আনা হলো, পাঁচজন অপারেটর মেশিন চালাতে বসলেন। পাঁচটি মেশিন থেকে বের করে আনা একটি কাপড়ে যুক্ত করে দেয়া হলো পাইলটবিহীন আস্ত একটি হেলিকপ্টার। কয়েকজনে ঠেলে ঠুলে চকচকে নতুন হেলিকপ্টারটিকে বিশাল মঞ্চে নিয়ে আসলো। দুই হাজারের বেশি অতিথি প্রত্যক্ষ করলেন যে, সেলাই মেশিন চালু করার পর সেলাইয়ের সাথে ফিতাটি যত মেশিনের কাছে আসছিল, ঠিক একইতালে হেলিকপ্টারটিকেও টেনে মেশিনের দিকে নিয়ে আসছিল। প্রযুক্তির শক্তি!

আরো নানা আয়োজন হলো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান এবং নাচ দেখানো হলো। প্রতিটি টেবিল রকমারি খাবারে ভরে রয়েছে। যার যা ইচ্ছে নিয়ে খাচ্ছেন।

একটু পরেই ডিনার সার্ভ শুরু হলো। একেবারে সবকিছুই যেনো হচ্ছিলো ঘড়ির কাটা ধরে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর মনে হলো আরো কিছুক্ষণ চললে ভালো হতো। বুঝতে পারলাম যে, তারা অনুষ্ঠানের নামে অতিথিদের বিরক্ত করেনি। নির্ধারিত সময়েই সবকিছু হয়ে যাচ্ছে। ডিনার সার্ভ করার সময়ক্ষণও যেনো আগে থেকে ঠিকঠাক করা ছিল। এতো বড় একটি অনুষ্ঠান, এতো শত অতিথি, এতো টেবিল কিন্তু খাবার সার্ভ হওয়ার পর দেখলাম যে, সব টেবিলই প্রায় একই সময়ে খাবার পৌঁছে গেল। একটির পর একটি ডিস আসতে লাগলো। ডিনারের নামে এক এলাহী আয়োজনের সাক্ষী হলাম। কত ধরনের খাবার যে সার্ভ করা হচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এর আগে লালনীলসাদা পানীয়ের যেনো বন্যা বয়ে গেলো। কত ডিজাইনের বোতল যে টেবিলে টেবিলে শোভা পাচ্ছিলো!! একটি বিষয় বেশ চোখে পড়লো যে, জ্যাকের মালিক মি. জ্যাক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রতিটি টেবিলে প্রতিজন মানুষের কাছে গেলেন, কৌশল বিনিময় করলেন। কোন কোন টেবিলে নিজেই একটু আধটু পানীয় অতিথির গ্লাসে ঢেলে দিলেন। সবকিছু ছিমছাম অথচ কী অসাধারণ!

ডিনার শেষে মি. জ্যাকের সাথে দেখা করলাম। চমৎকার একটি আয়োজনের সাক্ষী করায় ওনাকে ধন্যবাদ দিলাম। দাওয়াত দিলাম চট্টগ্রামে। আহ্বান জানালাম চট্টগ্রামে বিনিয়োগেরও। তাকে এটাও জানালাম যে, চট্টগ্রাম বিনিয়োগের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বিনিয়োগ করে কোন বিদেশী কোম্পানি কখনো লালবাতি জ্বালায়নি। আমি ইয়ংওয়ানের কথাও তাকে শুনিয়ে দিলাম। নিজের চট্টগ্রাম সফরের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি চট্টগ্রামের ব্যাপারটি মাথায় আছে বলেও জানালেন।

অনুষ্ঠান শেষে রুমে ফিরে আসলাম। লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবীও রুমে ফিরলেন। তাদের সন্তান সূর্য আমাকে বাইরে ঘুরতে যাবো কিনা জানতে চাইলো। ইচ্ছে করছে না বলার পর সূর্যও রুমের দিকে পা বাড়ালো।

গুয়াংজুর সিক্স স্টার রিসোর্টের দারুণ রুমটিতে আজই আমার শেষ রাত। ছয়তারকা হোটেলে রাত কাটানোর সুযোগ জীবনে আর কখনো আসবে কিনা জানি না, তবে শেষটা ভালোভাবেই উপভোগ করতে চাইলাম। আমি তুলতুলে নরোম বিছানায় গা এলিয়ে পরের দিনের সিডিউলটি নিয়ে নাড়াছাড়া করতে লাগলাম।

চীনে যাওয়ার ব্যাপারে ফাইন্যাল করার আগেই লায়ন ফজলে করিম ভাইকে বলেছিলাম যে, এবারের ভ্রমণে আমি কুনমিং দেখতে চাই। কুনমিংয়ের বিখ্যাত স্টোন ফরেস্ট না দেখে চীন ছাড়লে আমার মন ভরবে না। করিম ভাই কথা রেখেছেন। কুনমিংয়ে যাওয়া এবং তিনদিন থাকার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছেন।

আমাদের ফ্লাইট দুপুরে। গুয়াংজু থেকে কুনমিং। দুপুরের দিকে ফ্লাইট হওয়ার কারণে সকালে তাড়াহুড়ো হবে না। এটা যে কত বড় স্বস্তির তা বলে বুঝানো অসম্ভব। সকালে রয়ে সয়ে ঘুম থেকে জাগলে হবে। মোবাইলে এলার্ম দেয়ার দরকার নেই। ছয়তারকা হোটেলের ব্যুফে ব্রেকফাস্ট, রয়ে সয়ে নাস্তা করা যাবে। আসলেই, ভাবতেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছিলো।

সকালে রয়ে সয়ে সবকিছু করে যাত্রা করলাম আমরা। এখন আর আমরা জ্যাকের অতিথি নয়, তবুও বিমানবন্দরে পৌঁছার জন্য একটি গাড়ির যোগান তারা দিয়েছে। অবশ্য এই কয়দিন আমাদের প্রটোকলে থাকা ফ্রাঞ্চি ও শাসা হোটেল থেকে আমাদের চেকআউটসহ সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দিলেন। গাড়ির দরোজা পর্যন্ত এসে আমাদের বিদায় দিলেন। কী অপূর্ব মায়াই না মেয়ে দুইটি ছড়িয়ে গেলো কয়েকদিন ধরে।

গুয়াংজু শহরের নানা পথ মাড়িয়ে আমরা বাইয়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। এই বিমানবন্দরের বর্ণনা আগেও দিয়েছি। অনন্য সুন্দর একটি বিমানবন্দর, বিশাল। আধুনিক স্থাপত্যের শৈল্পিক ছোঁয়া চোখে পড়ে। বিশাল টার্মিনাল, ঝকঝকে ফ্লোর, আর সারি সারি কাউন্টারের ব্যস্ততা যেন এক সুশৃঙ্খল কর্মযজ্ঞ। চারদিকে বিমানযাত্রীদের ছুটোছুটি, আর ঘোষণার স্বর যেন এক অনন্য সুরের সিম্ফোনি তৈরি করেছে।

লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের ছেলে সূর্য আমাদের সাথে যাচ্ছে না। ডালিয়া ভাবীসহ আমরা তিনজনই এখন কুনমিংয়ের যাত্রী। আমরা চেকইন শেষ করে বোর্ডিং গেটের দিকে এগোই। আমাদের গন্তব্য কুনমিং, ইউনান প্রদেশের রাজধানী, যা ‘বসন্তের শহর’ নামে পরিচিত। যার স্টোন ফরেস্ট পৃথিবীর বিখ্যাত একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে ইতোমধ্যে লাখো কোটি মানুষের মন জয় করেছে।

আমাদের ফ্লাইট ছিল চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং। বোর্ডিং করার সময় আমার মোলায়েম অস্ত্রটি তাক করেছিলাম। তরুণীকে আলতো করে বলেছিলাম, উইন্ডো প্লিজ। কাজ হয়েছে। বোয়িংয়ে নিজেদের সিটে বসে জানালায় চোখ রাখলাম। আমাদের বোয়িংটি ছুটতে শুরু করেছে। রানওয়ে ধরে ছুটছিল বিশাল উড়োজাহাজ। ধীরে ধীরে গতির সঙ্গে দুলতে দুলতে এক সময় মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে গেলাম।

আমার চোখ জানালায়। চীনে আর কখনো আসা হবে কিনা জানি না, সবকিছু দেখে যেতে চাচ্ছিলাম। নিচের দৃশ্য দ্রুত বদলে যেতে লাগল। বিশাল শহর গুয়াংজু ধীরে ধীরে ছোট হতে লাগল। বিখ্যাত পার্ল রিভারের উপর দিয়ে উড়তে উড়তে চোখে পড়ল বিশাল সব উঁচু ভবন আর সবুজ পার্ক। মুহূর্তের মধ্যেই আমরা মেঘের রাজ্যে প্রবেশ করলাম। আমি মনে মনে গুয়াংজুকে বিদায় জানালাম।

বিমান চলছিল। কিন্তু একসময় আর বিমানের এগুনোটা ভিতর থেকে বুঝা যায় না। শুধু মেঘের রাজ্যে ভেসে থাকা। আমিও ভেসে ছিলাম। কিন্তু সামনের মনিটরে বিমানের গতিপথ দেখতে গিয়ে টের পাচ্ছিলাম যে, আমরা গুয়াংডং প্রদেশ পেরিয়ে ইউনানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। নিচে চোখ ফেলতেই কী অপরূপ এক রূপ যে চোখে পড়লো তা লিখে বুঝানো অসম্ভব। প্রকৃতি যেনো তার সব সৌন্দর্য মেলে ধরতে শুরু করলো। নিচে পাহাড়ি নদী, সবুজ বন, আর মাঝে মাঝে মেঘের ছায়া যেন এক স্বপ্নময় দৃশ্য তৈরি করল। বিশেষ করে ইউনানের দিকে যেতেই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলো অপূর্ব লাগছিল।

আমাদের প্রায় দুই ঘন্টার ফ্লাইট। তেরোশ’ কিলোমিটারের মতো পথ। ইতোমধ্যে আমাদেরকে কফি দিয়ে দেয়া হয়েছে। ডোমেস্টিক ফ্লাইট হলেও সার্ভিসটি বেশ ভালোই লাগছিল। বিমানবালাদের আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি চোখে পড়েনি।

পাইলট ঘোষণা দিলেন যে আমরা কুনমিংয়ের আকাশে প্রবেশ করেছি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, ছোট ছোট গ্রাম, সবুজ চা বাগান, আর দূরের পাহাড়শ্রেণী যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।

দারুণ এক ল্যান্ডিং। যেনো আলতো করে কারো কোলে বসিয়ে দেয়া হলো বিশাল বোয়িং। কুনমিং চাংশুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভালোয় ভালোয় অবতরণ করায় আমার অন্তরে পানি এলো। যেভাবে পাহাড় পর্বত দেখে আসছিলাম তাতে আমার ভুটান এয়ারপোর্টের কথাই মনে পড়ছিল।

বিমানবন্দরের স্থাপত্য অত্যন্ত চমৎকার। কাঠের মতো নকশা করা ছাদ ও সোনালি রঙের স্ট্রাকচার একে অন্যরকম বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। আমরা ডোমেস্টিকের যাত্রী। ফর্মালিটি বলতে কিছুই নেই। শুধু লাগেজ বেল্ট থেকে নিজের ব্যাগ তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসা।

বাইরে বের হতেই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আমাকে যেন আলিঙ্গন করল। গুয়াংজুর ভ্যাপসা গরমের তুলনায় কুনমিং সত্যিই ‘চিরবসন্তের শহর’। নাতিশীতোষ্ণ ও মনোমুগ্ধকর। এয়ারপোর্ট থেকে বেরুতেই করিম ভাইয়ের নাম লেখা প্ল্যকার্ড নিয়ে একজন ড্রাইভারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি একাই আমাদের তিনজনের লাগেজ নিয়ে টানাটানি শুরু করলেন। বললাম, আপনি আগে হাঁটুন, গাড়ির কাছে নিয়ে চলেন। আমরা ট্রলি নিয়ে আসি, সমস্যা নেই। বেশ বসসড় একটি প্রাইভেট গাড়িতে চড়লাম। চীনা গাড়ি, জীপ টাইপের। সেভেন সিটার। পেছনের দুই সিট ভাঁজ করে রেখে আমাদের লাগেজগুলো তুলে নেয়া হলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। চীর বসন্তের এক জনপদে শুরু হলো আমাদের পথচলা। (চলবে)

লেখক : দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুনভাবে জেগে ওঠা …
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বের চাল উৎপাদন এবং গ্রামীণ বাংলাদেশের তৃতীয় স্থান