শিপিং এজেন্ট ও বার্থ অপারেটরদের বিরোধে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে ধস নামার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে থেমে থেমে চলা ‘গো স্লো’র প্রেক্ষিতে বন্দরে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে সংকট দেখা দিচ্ছে। কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে এবার মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্ত হলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। শিপিং এজেন্ট ও বার্থ অপারেটরদের ‘অনবোর্ড’ হ্যান্ডলিং চার্জ ঠিক করে দিতে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে জরুরি পত্র দেওয়া হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে জেনারেল কার্গো বার্থের ৬টি জেটিতে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে অঘোষিত ‘গো স্লো’ চলছে বেশ কয়েক মাস ধরে। বার্থ অপারেটর ও শিপিং এজেন্টদের মধ্যে পারিশ্রমিক বাড়ানোর বিরোধের জের ধরে শুরু হয় ‘গো স্লো’। এতে বন্দরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাওয়া ছাড়াও আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও দুই পক্ষের বিরোধ না মেটায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থের ৬টি জেটিতে কন্টেনার জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়। ছয়টি বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠান এসব জেটিতে বার্থিং নেওয়া জাহাজের কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে। প্রতিটি বার্থে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে দুই ভাগে কাজ হয়। কন্টেনার হুক পয়েন্ট থেকে জাহাজে ওঠানো–নামানোর (অনবোট হ্যান্ডলিং) কাজ করা হয় শিপিং এজেন্টদের পক্ষ থেকে। হুক পয়েন্ট থেকে ইয়ার্ড পর্যন্ত কাজ করা হয় বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষে। অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের পাশাপাশি বার্থ অপারেটরের কর্মচারীরা কার্গো শিপমেন্ট, ইমপোর্ট বা এঙপোর্ট পারশিমন, ডিপো থেকে কন্টেনার কল, ভারী পণ্য বোঝাই কন্টেনার আগে জাহাজিকরণসহ বেশ কিছু বাড়তি কাজ করে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়মে অনবোট কন্টেনার হ্যান্ডলিং চলে আসছে। বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের জন্য মাশুল পরিশোধ করে শিপিং এজেন্ট বা ভ্যাসেল অপারেটর। অপরদিকে হুক পয়েন্ট থেকে ইয়ার্ডে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের মাশুল পরিশোধ করে চট্টগ্রাম বন্দর। দুটি মাশুল নির্ধারিত।
বার্থ অপারেটরদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময়কালে যে দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সেই দরে তাদেরকে এখনো কাজ করতে হচ্ছে। গত ১৮ বছরে বহুমুখী খরচ বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু অনবোট হ্যান্ডলিংয়ে বার্থ অপারেটরদের মাশুল বাড়েনি। তারা বলেন, অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের জন্য যে মাশুল দেওয়া হয় তাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর ৪০ শতাংশ শ্রমিকের খরচ এবং বাকি ৬০ শতাংশ বার্থ অপারেটরের মালিকের। যা দিয়ে বার্থ অপারেটরের ইকুইপমেন্টসহ বিভিন্ন খরচ মেটানো হয়। শিপিং এজেন্টরা কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ৪০ শতাংশের ওপর প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বাড়ালেও বাকি ৬০ শতাংশের ওপর বাড়ায়নি। ২০০৭ সালের আগে তারা যেখানে প্রতি কন্টেনার অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা পেতেন সেখানে বর্তমানে পাচ্ছেন ৫৫৯ টাকা ৫১ পয়সা করে। এতে করে প্রতিটি বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ বৈঠকও করেন। কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও মাশুল বাড়ানো কার্যকর হয়নি বলে জানিয়েছে বার্থ অপারেটর্স, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর্স অ্যান্ড টার্মিনাল ওনার্স এসোসিয়েশন।
এসোসিয়েশনের নেতা ফজলে ইকরাম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা অনেকদিন ধরে মাশুল বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসছি। কিন্তু তারা কথা শুনছেন না। বেশ কয়েকবার মিটিং হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা কন্টেনারপ্রতি ৫ ডলার বাড়ানোর অনুরোধ করেছি। যাতে আমরা কোনোরকমে টিকে থাকতে পারি।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বার্থ অপারেটরদের দাবি ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন আজাদীকে। তিনি বলেন, আমরা একটি বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানের কাছেই সেবা নিতে বাধ্য। বিষয়টি অনেকটা জিম্মি হয়ে থাকার মতো। অথচ যদি আগের মতো আমাদের স্টিভিডোরস আমরা নিয়োগ দিতে পারতাম তাহলে আমাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতো, দর কষাকষি হতো। স্বচ্ছতা থাকত, থাকত জবাবদিহিতা। এখন আমাদের কোনো কিছুই নেই। নির্দিষ্ট করে দেওয়া একটি রেটে টাকা প্রদান করে আমরা সার্ভিস নিচ্ছি। টাকা দিই আমরা, অথচ আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিষয়টি এভাবে না হয়ে যদি আমাদের কাজের অংশটি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকত তাহলে প্রতিযোগিতামূলক দরে আমরা আরো অনেক কমে কাজ করাতে পারতাম।
বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিরোধের সুরাহা না হওয়ায় অবশেষে মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্ত হয়েছে বন্দর। গতকাল বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে পাঠানো এক জরুরিপত্রে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের বিদ্যমান ইস্যুতে একটি দর ঠিক করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। তিনি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর কথা স্বীকার করেছেন।