সার্বিক উন্নয়নে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে

| মঙ্গলবার , ৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের এক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এক দশকে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেড়েছে গড়ে দেড় শতাংশ হারে। যদিও একই সময়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ২ শতাংশ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, যেকোনো দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরা হয় ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, নতুন কর্মসংস্থান বেড়েছে তার তুলনায় একেবারেই সামান্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর দেশে বিপুলসংখ্যক তরুণ কর্মক্ষম হয়ে উঠলেও তাদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়নি। এমনকি বিভিন্ন খাতের সবচেয়ে উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান বা ফ্রন্টিয়ার ফার্মগুলোও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং অর্থনৈতিকরাজনৈতিক নানা দুর্বিপাকে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। এতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ও নতুন কর্মসংস্থানের গড় প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে কর্মহীনতা বৃদ্ধির গড় হার।

বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকৃত জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে (৬ দশমিক ৪ শতাংশ) বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি। এমনকি দারিদ্র্যের হার নব্বইয়ের দশকের ৩০ শতাংশের বেশি হার থেকে কমিয়ে এনে ২০২২ সালে ৫ শতাংশ দেখানো হয়েছে। এসব পরিসংখ্যান কাজে লাগিয়ে ২০২৬ সালে বাংলাদেশকে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু এসব পরিসংখ্যানের প্রতিফলন দেশে নতুন কর্মসৃজনের তথ্যে দেখা যাচ্ছে না।

ব্রেটন উডস সংস্থাটির গত মাসে প্রকাশিত ‘ফ্রন্টিয়ার ফার্মস অ্যান্ড জব ক্রিয়েশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন পর্যালোচনা উঠে আসে। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হার বেড়েছে গড়ে দেড় শতাংশ করে। যদিও নতুন কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল মাত্র দশমিক ২ শতাংশ।

বিগত বছরগুলোতে দেশে তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকলেও সংকুচিত হয়েছে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। এতে দেশে তরুণ বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে পৌঁছেছে ১৬ শতাংশে।

পেশা নির্বাচনে সামাজিক অগ্রাধিকারে পরিবর্তনকে তরুণ বেকারত্বের হার বৃদ্ধির বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে বছরে নতুন যে ২৪২৫ লাখ শ্রমশক্তি বাজারে আসে, তাদের প্রায় একতৃতীয়াংশ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট; বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ থেকে পাস করা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্ব খুবই বেশি। কারণ তারা গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর কৃষি, কারখানাসহ নিম্ন আয়ের কাজ করতে চায় না। আগে মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট ছিল; এখন তা ১০ শতাংশ। গ্র্যাজুয়েশন করে তারা অন্যান্য কাজে আগ্রহী হচ্ছে না। আমাদের কৃষি ও শিল্প কারখানায় গ্র্যাজুয়েটের চাহিদার চেয়ে ননগ্র্যাজুয়েটদের চাহিদা বেশি। ফলে এখানে পেশা নির্বাচনে সামাজিক অগ্রাধিকারে পরিবর্তন আসছে, যা তরুণ ও সামগ্রিক বেকারত্বের একটা বড় কারণ।’

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় একতৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশিরভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বেই কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল, তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছে। সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনোটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এ জনগোষ্ঠী সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে। তাঁদের মতে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন কর্মপরিবেশের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরিও জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে