মেলা: বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার

অমল বড়ুয়া | সোমবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ

আবহমান বাংলার কৃষ্টি সভ্যতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে উৎসব, পার্বণ ও মেলা। মেলা হচ্ছে মেলামেশা, মিলন; গণমানুষের মিলন, সম্প্রীতির মেলবন্ধন। ‘মেলা’ শব্দটি এসেছে মেলন থেকে, ‘মেলন’ হচ্ছে ‘স্থান’ বা ‘মেলা’। ‘মেলন’ অর্থ ‘সঙ্গ’, ‘সঙ্গম’। ‘মেলকে সঙ্গসঙ্গমৌ’ (অমরকোষ)= মিলন।’ গণমানুষের মিলন, সমপ্রীতির মেলবন্ধন। ‘বহু লোক একস্থানে মিলিত হয় বলিয়া ইহার নাম মেলা হয়েছে।’ বহুমাত্রিকতা ও সার্বজনীনতা মেলার প্রধান অঙ্গ। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নদীসকল যেমন সাগরে এসে মিশে, ঠিক তেমনি দেশজনপদের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ মেলায় এসে উৎসবে আনন্দে বিকিকিনিসওদার সমারোহে একই বৃত্তে মিলিত হয়। রাজাপ্রজা, ধনীদরিদ্র, কুলীনঅকুলীন, ধর্মবর্ণসম্প্রদায় সকলেই এক কাতারে এসে দাঁড়ায়, সমপুলকে অভিরমিত হয়, সত্যসুন্দরের আবাহনে নিরঞ্জন শুদ্ধতায় মিলনের অনিন্দ্য সেতুবন্ধন রচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ মেলার সাথে সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে ধর্ম ও লোকবিশ্বাস, ঋতুভিত্তিক কৃষিউৎপাদন ও বাণিজ্য, উৎসবপার্বণ, শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতি, ব্যক্তি ও জাতীয় দিবসের।

মেলার গোড়াপত্তন:

মেলার ইতিহাস মানব ইতিহাসের মতই প্রাচীন। মেলার সূচনা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই। প্রারম্ভিক সময়ে, মেলাগুলি ছিল বাণিজ্যিক প্রকৃতির; যা ছিল ব্যবসায়ীদের পণ্য কেনাবেচা করার স্থান। এতে করে, ‘মেলা’ শব্দটি একটি সমাবেশ বা বাজার বোঝাতে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ‘বাইবেলে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে মেলার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই কারণে অনেক পণ্ডিত মনে করেন, মেলা শব্দটি ল্যাটিন ‘ফেরিয়া’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ পবিত্র দিন। যার উৎস প্রাচীন ফরাসি ‘ভবরৎব’ শব্দ থেকে, আর এই ‘ভবরৎব’ শব্দটি ল্যাটিন ‘ভবৎরধ’ শব্দ থেকে উদ্ভুত, যার অর্থ ‘ছুটির দিন, বাজার মেলা।’ ‘ ‘মেলা’ শব্দটির ব্যবহার মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল, যা পণ্য ও বিনোদনের জন্য অনুষ্ঠিত বার্ষিক সমাবেশকে বোঝায়। বাংলায় মেলা এবং ইংরেজিতে ‘ভধরৎ’ শব্দটি প্রাচীনতম, যার ব্যবহার প্রাচীন ইংরেজি যুগ ১১৫০ সালের পূর্ব থেকেই দেখা যায়।’ ভারতউপমহাদেশে মেলা হাজার বছরের পুরোনো লোকঐতিহ্যরূপে স্বীকৃত যার সূচনা প্রাচীনকাল থেকেই, যা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। যেমন বুদ্ধের জন্মদিবস উদযাপন উপলক্ষে প্রতিবছর ‘রথটানা’ হতো আর রথটানাকে কেন্দ্র করে ‘রথমেলা’ হতো। সময়টা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০২৫০ অব্দ। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ অব্দের পূর্ব থেকেই কৃষিউৎপাদনভিত্তিক ‘হলকর্ষণ উৎসবে’র আখ্যান পাওয়া যায়। এই ‘হলকর্ষণ’ উৎসবকে রাজকীয়ভাবে উদযাপন করা হতো। আর এই হলকর্ষণকে কেন্দ্র করে মেলা বসত। যার বর্ণনা আছে গৌতম বুদ্ধের জীবনীকথায়। ‘ভারতে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও শিলালিপিতে বার্ষিক মাঘমেলার উল্লেখ পাওয়া যায়।’ ‘ভারতগবেষক কামা ম্যাকলিনের মতে, প্রাচীন মাঘমেলার আধুনিক সংস্করণ হলো কুম্ভমেলা। দার্শনিক শঙ্করাচার্য অষ্টম শতাব্দীতে ভারতে এই আধুনিক কুম্ভমেলার প্রচলন করেন।’ আদিকাল থেকেই মেলার প্রচলন ছিল প্রাচীন রোম, পারস্য ও চীনে। আরবেও বিভিন্ন মেলার কাহিনী ইতিহাসে পাওয়া যায়। ইউরোপের প্রাচীনতম মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম জার্মানীর ব্রেমেন ফ্রি ফেয়ার, ১০৩৫ সালে সম্রাট দ্বিতীয় কনরাড যার শুভসূচনা করেন। ভারতবর্ষে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার যুগে প্রসিদ্ধ ও সমৃদ্ধ নগরসমূহে দেশবিদেশ ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য বাণিজ্যের জন্যে নিয়ে আসতেন এবং শহরের কেন্দ্রে পসরা সাজিয়ে কেনাবেচা করতেন। প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ বিশেষ করে পালিধর্মগ্রন্থ জাতক ও সংস্কৃত পুরাণে তার আখ্যান পাওয়া যায়। আর এই বেচাকেনার বাজার থেকে মেলার ধারণা জন্মলাভ করে। ভারতবর্ষে প্রথম নগরায়ন হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ নাগাদ, পশ্চিম ভারতে বিশেষত সিন্ধু নদের উপত্যকায়। দ্বিতীয় নগরায়ন হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ নাগাদ, উত্তর ভারতে বিশেষত গঙ্গানদীর উপত্যকায়। প্রাচীন ভারতে হরপ্পা সভ্যতায় যে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা প্রথম নগরায়ন। আবার মহাজনপদের যে নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা দ্বিতীয় নগরায়ন। এতে করে বলা যায়, ভারতবাংলায় মেলার ইতিহাস খুবই প্রাচীন যার গোড়াপত্তন খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে। আর প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাংলার আনাচেকানাচে আয়োজিত মেলার মাধ্যমেই ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ ও বিকশিত হচ্ছে বাংলার গৌরবময় কৃষ্টিশিল্পসংস্কৃতি ও ইতিহাসঐতিহ্য এবং সুদৃঢ় হচ্ছে সম্প্রীতির মেলবন্ধন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন– ‘এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান করে। এই উৎসবে পল্লী আপনার সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ্য।

মেলার অনুষঙ্গ:

মেলায় প্রতিভাত হয়ে ওঠে বাঙালির আপন কৃষ্টি, শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সৌষ্ঠব। এককালে গ্রামকেন্দ্রিক এই মেলা বর্তমানে আধুনিক শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করছে আর নাগরিক ব্যস্ততায় এই মেলা অনির্বচনীয় বিনোদন আর অপার আনন্দ লাভ ও সৌখিন শিল্পচর্চার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। মেলায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের সরস প্রদর্শনীর দেখা মেলে। আর এই মেলায় প্রচলিত সাংস্কৃতিক বিনোদনের মধ্যে অন্যতম হলো যাত্রাপালা, কবিগান, পালাগান, পুঁথিগান, চর্যাগীতি, কীর্তন, পুতুল নাচ, যাদু, অপেরা ও নাটক। এছাড়াও মেলার প্রধান আকর্ষণ হিসেবে সবার নজরে থাকে সার্কাস, নাগরদোলা, চড়কি কিংবা বায়োস্কোপ। মেলায় বসে জারিসারি ভাটিয়ালীবাউল গানের আসর। আর মেলার এই আয়োজন দেখার জন্য দুরদুরান্ত থেকে ছুটে আসে হাজারো নারীপুুরুষ। হাজারো মানুষের বিরামহীন কথামালা,গান, ঢাকঢোল আর বাঁশির সুরে মুখর হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গন। সাধারণত উন্মুক্ত স্থানে বিশেষ করে বিদ্যালয়মহাবিদ্যালয়ের মাঠে, গ্রামের মন্দির, খালি জমিতে, নদীর তীর বা বড় বৃক্ষের নিচে অথবা বড় কোনো ময়দানকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। মেলায় শুধু গাননাটক হয় এমন নয়, এখানে বিভিন্ন ধরণের গ্রামীণ খেলাধুলার প্রতিযোগিতাও থাকে। এই সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোথুম্রবাজি খেলা (গ্রাম্য তান্ত্রিকদের খেলা), ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, হাডুডু খেলা, নৌকা বাইচ ইত্যাদি। আর মেলায় বিকিকিনি হয় গ্রামীণ মৃৎশিল্প, কারুপণ্য, কুটির শিল্পের পণ্য, কাঠের তৈরি আসবাব সামগ্রী, পোড়া মাটি ও চীনা মাটির তৈজসপত্র, অর্নামেন্টস, মাটি, লোহা, তামা, পিতল, স্টিল, কাচ, কাঠ, বাঁশ ও বেতের জিনিস, প্রসাধনী, ঘর সাজানোর দ্রব্যাদি, শিশুখেলনা, পিঠাপুলি, দইমিষ্টিরসমালাই, বাদামবুটচনাচুর, গজাতিল, আইসক্রিম ইত্যাকার পণ্য। মেলায় কিশোরীদের প্রধান আকর্ষণ থাকে চুড়ি, ফিতে, চুলের ক্লিপ, আলতা, কাজল কেনায়। গৃহিণীদের চাহিদা থাকেদা, বঁটি, খুন্তি, চালুনি, কুলো, শীতল পাটি, মাদুর, টুকরি, হাড়িপাতিল ইত্যাদি গৃহস্থালিকর্মের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ে। বর্ণবৈচিত্রময় নতুন শাড়ি, জামা, ফ্রক পরে আলতা, মেহেদি রাঙা বাহারি নকশা হাতে এঁকে কিশোরীযুবতী ও বধুরা সেজেগুজে মেলায় আসে। শিশুকিশোরযুবক ও তরুণরা নতুন শার্ট, পাঞ্জাবি ও বাহারি পোষাক পরে মেলার আকর্ষণকে বাড়িয়ে তুলে।

মেলার অর্থনীতি:

মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ, ভাববিনিময় ও মিলনের জন্য, আপন কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে জানার জন্য মেলা গুরুত্বপূর্ণ। আবার মেলার অর্থনৈতিক ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। মেলায় প্রচুর জিনিস বেচাকেনা হয়। স্থানীয় মানুষজনের তৈরি জিনিস যেমন মেলায় বিক্রি হয় তেমনি বিভিন্ন জায়গা থেকেও উৎপাদিত জিনিস মেলায় বিক্রি হয়। মেলায় আগত দর্শনার্থীদের কাছে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের সুনাম বৃদ্ধি পায়। ফলে লাভবান হয় আমাদের ক্ষুদ্রশিল্প। এক একটি মেলায় কোটি টাকার লেনদেন হয়। এতে অর্থনৈতিক দিকেরও অনেকটা উন্নতি হয়। জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান বাহক বাণিজ্য। আর এই বাণিজ্যের উন্নয়ন ও সমপ্রসারণে মেলার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান আছে। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রি বিশেষ করে হস্তশিল্পজাত পণ্যসমূহ বিক্রি করে প্রান্তিক উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা জীবিকা নির্বাহ করে এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে। তাছাড়া বর্তমানে অনেক বিদেশি পর্যটক গ্রামীণ মেলাসমূহে ভ্রমণ করে থাকেন, এর ফলে দেশিয় পণ্যের সাথে বিদেশিরা পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়, যা স্থানীয় পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ সৃষ্টি করে। এতে করে কুটির ও হস্তশিল্প পণ্য রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

মেলার বৈচিত্রতা:

মেলার এই সংস্কৃতিতে থাকে সব ধর্মবর্ণসম্প্রদায়ের মানুষের সমন্বয়। সংস্কৃতি ও পণ্যের বৈচিত্রের মতো মেলারও আছে বৈচিত্র। যেমনপৌষপার্বণের মেলা, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, বসন্তের মেলা, ধর্মভিত্তিক মেলা, ব্যক্তিনির্ভর মেলা (সাধুসন্তদের স্মরণে; শিল্পসংস্কৃতির প্রধান ব্যক্তি যেমন লালন মেলা) ও জাতীয় মেলা (বিজয় মেলা, বইমেলা, বৃক্ষমেলা) ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় পৌনে দুইহাজার মেলা বসে। প্রাচীনত্ব ও স্থায়িত্বের বিচারে বাংলাদেশের মেলাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেসূর্যমেলা, চৈত্রসংক্রান্তির ব্রতের মেলা, চড়কমেলা, শিবের গাজনের মেলা, বরুণবারুণী স্নানের মেলা, রথমেলা, পৌষমেলা, মাঘীপূর্ণিমার মেলা, রাসমেলা, পুণ্যাহৃ মেলা, ফাল্গুনিপূর্ণিমার মেলা, আশ্বিণীপূর্ণিমার মেলা, দোলপূর্ণিমার মেলা, বসন্ত মেলা, মহররমের মেলা, বড়দিনের মেলা (এ মেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হচ্ছে গোপালগঞ্জের মকসুদপুর থানার অন্তর্গত কালীগ্রামের মেলা), মহামুনি মেলা, চক্রশালা মেলা, মহাবোধি মেলা, ঠেগরপুনির মেলা এবং বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা অন্যতম। সাধুফকির প্রবর্তিত বিভিন্ন মেলার মধ্যে রয়েছে লালন সাঁইয়ের আখড়া বাড়িতে অনুষ্ঠিত দোলপূর্ণিমার মেলা, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির হরিঠাকুরের মেলা, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতানের মেলা, চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারের মেলা, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরীর মেলা, সিলেটে বাউল শাহ আবদুল করিমের মেলা, ছেঁউড়িয়ার লালনমেলা, সুনামগঞ্জের হাসনমেলা, শিলাইদহের রবীন্দ্রমেলা, দরিরামপুরের নজরুল মেলা ও সাগরদাঁড়ির মধুমেলা। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে কিছু মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোবাংলা একাডেমি একুশে বইমেলা, মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন জেলাশহরে আয়োজিত বিজয়মেলা, বাণিজ্যমেলা, কুটিরশিল্প মেলা, তাঁতবস্ত্র মেলা, শিল্পমেলা, বস্ত্রমেলা, বৃক্ষমেলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলা, শিক্ষামেলা, কর মেলা ইত্যাদি। এই মেলাগুলো কেবল নামে বৈচিত্র তা নয়, এগুলোর প্রকৃতি, অনুষঙ্গ, উদ্দেশ্যআদর্শ ও রীতিনীতিতেও আছে দারুণ বৈচিত্রতা।

আমাদের মেলা আমাদের উজ্জল উত্তরাধিকার:

মেলা’ বাঙালির লোকসংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। বাঙালির মেলা জাতির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। বাঙালির লোকসংস্কৃতির মেলার মধ্যে প্রথমেই আসে ‘বৈশাখী মেলা’র নাম। বাংলা বর্ষপঞ্জির বছর শুরুর প্রথম দিনটি হলো পহেলা বৈশাখ। বছরের প্রথম এই দিনটিতে রাজার পক্ষে জমিদাররা রাজস্ব আদায় করতো। প্রজারা বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে মিষ্টি খেয়ে যেত। ব্যবসায়ীরা লাভক্ষতির পুরনো হিসাবের খাতা চুকিয়ে নতুন খাতার সূচনা করতো। যাকে আমরাহালখাতা নামে জানি। ‘হাল’ অর্থ নতুন বা চলতি। আর বছরের প্রথমদিনটি অর্থাৎ পহেলা বৈশাখকে নতুন হিসাব সংরক্ষণের অনুষ্ঠানিকতা হিসেবেও গণ্য করা হতো। এই উপলক্ষে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ঘরদুয়ার নানাবিধ পুষ্পপল্লবে সুসজ্জিত করে আত্মীয়বন্ধু, পাড়াপ্রতিবেশি ও অংশিজনদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। কৃষিপ্রধান এ দেশে সে সময় ‘আমানি উৎসব’ অর্থাৎ ‘পান্তাভাত খেয়ে’ কৃষিজীবি মানুষেরা পহেলা বৈশাখে হালচাষে যেতেন। যা কালক্রমে বাঙালির সামাজিক লৌকিকতার অবিচ্ছেদ্য উৎসবে পরিণত হয়ে ওঠে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলার বিভিন্ন জনপদে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে উদযাপিত উৎসব ও মেলার মধ্যে সার্বজনীনতার দিক থেকে পহেলা বৈশাখ সবচেয়ে জনপ্রিয়। পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষ্যে দেশব্যাপী পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয় এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৈশাখী মেলা বসে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের বড় উৎসব ও মেলার নাম হচ্ছে– ‘বৈসাবি’। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীগোষ্ঠীচাকমা, ত্রিপুরা, মারমা, রাখাইনদের বর্ষবরণ উৎসব বৈসুক, সাংগ্রাইন ও বিজুএর আদ্যাক্ষর নিয়েই এ উৎসবকে ‘বৈসাবি’ নামে অভিহিত করা হয়েছে’। বাংলাদেশে প্রচলিত মেলাসমূহের মধ্যে বেশিরভাগ মেলাই ধর্মকেন্দ্রিক। পূর্ণিমা তিথি, পূজাব্রতকে কেন্দ্র করে যেমন মেলা বসে, ঠিক তেমনি ওরস, মহররম, ঈদ বা বড় দিনকে কেন্দ্র করেও মেলা বসে। ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বাঙালি শুদ্ধতম অনুরণন পোষণ করলেও বাঙলার সংস্কৃতি নিখাদ সার্বজনীনতায় উর্বর, ঋদ্ধ ও চিরপ্রবহমান। মেলা বাঙালির শিল্পসংস্কৃতির ধারক ও বাহক আর ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রোজ্জল উত্তরাধিকার। মেলা সংযোগ সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের অমলিন মেলবন্ধন রচনা করে মানুষে মানুষে মন ও মননে হৃদ্যতার বীজ বুনে শান্তি সৌহার্দ ও মানবিকতার বিস্তৃত দিগন্তকে উন্মোচিত করে। মেলা শুধু শিল্পসংস্কৃতি নয়, বরং জীবন ও জীবিকাকেও বিকশিত করে চলেছে সেই আদিকাল থেকে। মেলা আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতিনিধিত্ব করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসামাজিক সচেতনতায় একটি বক্তব্যধর্মী গান
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে এসএসসি ’৯২ ব্যাচের ঈদ পুনর্মিলনী