গাজায় অব্যাহত হামলায় ‘দমবন্ধ’ পরিস্থিতি

পাহাড় বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে শিশুদের ওপর ১৫ চিকিৎসাকর্মী হত্যার ভিডিও ফাঁস, ইসরায়েলের দায় স্বীকার

| সোমবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

গাজায় প্রাণঘাতী ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের। গত ১২ ঘণ্টায় যে হামলা চালানো হয়েছে তার অধিকাংশই খান ইউনিসে। সেখানে শিশু ও নারীসহ কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছেন।

ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী আবাসিক বাড়ি ও অস্থায়ী তাঁবুতে হামলা চালিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো মানুষ আটকা পড়ে আছে। তাই সেখানে মরদেহ ও জীবিতদের উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কেবল খান ইউনিসেই নয়, গাজা শহরের জেইতুন পাড়াতেও রাতভর হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে ইসরায়েলিরা কিছু আবাসিক বাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে এবং কমপক্ষে দুইজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। দক্ষিণ গাজার রাফাহ ও বেইত লাহিয়াতেও ক্রমাগত বোমা হামলা চলছে। পরিস্থিতি প্রতিদিনই আরও খারাপ হচ্ছে। পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য যে কোনো ধরনের খাবার খুঁজছে ফিলিস্তিনিরা। গত এক মাসে গাজায় একটিও ট্রাক প্রবেশ করেনি। তাই খাবার নেই, জ্বালানি নেই, রান্নার গ্যাস নেই। এমনকি ওষুধও নেই, আশ্রয় বা তাঁবুও নেই।

গাজার পরিস্থিতি শ্বাসরুদ্ধকর। পরিবারগুলোকে এক গ্যালন পানি ভর্তি করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। গরম খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। আসন্ন দিনগুলোতে বিদ্যমান রান্নারঘরগুলোও বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ প্রয়োজনীয় মজুত শেষ হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ও তাদের সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য সংগ্রাম করছে। স্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ডাক্তাররা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও চিকিৎসা সরবরাহ না থাকায় মানুষের চিকিৎসা করা খুবই কঠিন।

পাহাড় বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র : খান ইউনিস শহরে গতকাল রোববার ভোরে একটি আবাসিক ভবনে বোমা হামলা করে ইসরায়েল। এতে অন্তত নয়জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান ভবনটির বাসিন্দা জামাল আলমধৌন। তিনি আলজাজিরাকে জানিয়েছেন, কীভাবে মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছেন এবং তার চোখের সামনে কীভাবে নারী ও শিশুরা প্রাণ হারিয়েছেন। জামাল বলেন, আমরা তখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলামহঠাৎ সব ঘর গুঁড়িয়ে গেলো; ছাদ ধসে পড়লো নিরীহ নারী ও শিশুদের মাথার ওপর। এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, যেগুলো পর্বতকে ছাই করে দিতে পারেতা ছোঁড়া হচ্ছে শিশুদের ওপর। তিনি আরও জানান, আমরা আটটি মরদেহ টেনে বের করেছিসবই নারী ও শিশু। একজনও পুরুষ ছিল না।

১৫ চিকিৎসাকর্মী হত্যা : অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গত ২৩ মার্চ ১৫ জন জরুরি সেবাকর্মী (প্যারামেডিক) হত্যার ঘটনায় মুখ খুলেছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। ঘটনার দিন রাফাহর কাছে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (পিআরসিএস) একটি অ্যাম্বুলেন্স, জাতিসংঘের একটি গাড়ি এবং গাজার সিভিল ডিফেন্সের একটি অগ্নিনির্বাপক ট্রাকের বহরে গুলি চালায় ইসরায়েলি সৈন্যরা।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী শুরুতে দাবি করেছিল, অন্ধকারে হেডলাইট বা ফ্ল্যাশিং লাইট ছাড়া গাড়ি বহরটির গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তারা গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু নিহত প্যারামেডিকদের একজনের তোলা মোবাইল ফোনের ফুটেজে দেখা গেছে, আহতদের সাহায্য করার জন্য ডাকাডাকির সময় যানবাহনগুলোতে ঠিকই আলো জ্বালানো ছিল।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছিল, নিহতদের মধ্যে অন্তত ছয়জন হামাসের সঙ্গে যুক্ত। যদিও নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে কোন প্রমাণ দেয়নি তারা। সেই সঙ্গে আইডিএফ স্বীকার করেছে, সৈন্যরা গুলি চালানোর সময় গাড়িবহরে থাকা মানুষেরা নিরস্ত্র ছিলেন।

নিউইয়র্ক টাইমসের শেয়ার করা ভিডিওটিতে দেখা যায়, গাড়িগুলো রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর ভোর হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি ছোড়া শুরু হয়। ফুটেজটি পাঁচ মিনিটের বেশি চলতে থাকে এবং রাদওয়ান নামে আহত একজন প্যারামেডিককে তার শেষ প্রার্থনা করতে শোনা যায়। তারপর ইসরায়েলি সৈন্যদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, সেসময় তারা গাড়িগুলোর কাছে এগিয়ে আসছিল।

শনিবার সন্ধ্যায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের ব্রিফ করে বলেন, সৈন্যরা আগে তিনজন হামাস সদস্য বহনকারী একটি গাড়িতে গুলি চালিয়েছিল। যখন অ্যাম্বুলেন্সগুলো মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে এলাকার কাছে পৌঁছায়, তখন বিমান নজরদারি মনিটর থেকে স্থলে থাকা সৈন্যদের সতর্ক করা হয়, একটি গাড়িবহর ‘সন্দেহজনকভাবে এগিয়ে আসছে’। অ্যাম্বুলেন্সগুলো হামাসের গাড়ির পাশে থামায়, সৈন্যরা মনে করেছিল, তারা হুমকির সম্মুখীন এবং এজন্য তারা গুলি চালিয়েছিল। যদিও জরুরি দলের কোনো সদস্যের কাছে অস্ত্র ছিল, তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এখন ইসরায়েল তাদের আগের দাবি ভুল বলে স্বীকার করেছে, যেখানে তারা দাবি করেছিল, গাড়িগুলো আলো ছাড়া এগিয়ে এসেছিল। রিপোর্টে ওই ঘটনায় জড়িত সৈন্যদের দায়ী করা হয়েছে।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গাড়িগুলোর অবস্থান স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল এবং প্যারামেডিক কর্মীরা রিফ্লেকটিভ হাইভিউজ ইউনিফর্ম পরে ছিলেন, অর্থাৎ অনেক দূর থেকে প্রতিফলিত হয় এমন পোশাক পরে ছিলেন তারা। কর্মকর্তারা জানান, সৈন্যরা ওই ১৫ জন মৃত কর্মীর দেহ বালি দিয়ে চাপা দিয়েছিল। ঘটনার এক সপ্তাহ পরও তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কারণ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিরাপদভাবে এলাকায় চলাচল করতে পারেনি বা ঘটনাস্থলটি শনাক্ত করতে পারেনি।

অবশেষে একটি সহায়ক দল যখন মরদেহগুলো খুঁজে পায়, তখন তারা রেফাত রাদওয়ানের মোবাইল ফোনও পায়, যেখানে ঘটনার ফুটেজ ছিল। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই জরুরি সেবাকর্মীদের হাতকড়া পরানো হয়েছিল। তবে, ওই দাবি অস্বীকার করে ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তারা বলেছেন, মৃত্যুর আগে কোনো মেডিকেল কর্মকর্তাকে হাতকড়া পরানো হয়নি। সেইসঙ্গে, তাদের খুব কাছে থেকেও গুলি করা হয়নি, যেভাবে কিছু প্রতিবেদন ইঙ্গিত করেছে।

এ সপ্তাহের শুরুর দিকে একজন জীবিত প্যারামেডিক বিবিসি’কে বলেছিলেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলোর লাইট জ্বালানো ছিল এবং তার সহকর্মীরা কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত ছিলেন না।

আইডিএফ ঘটনার ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত’ করার পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা ‘ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং পরিস্থিতি পরিচালনার পদ্ধতি বোঝার চেষ্টা করবে’। রেড ক্রিসেন্ট এবং অন্যান্য অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ঘটনায় একটি স্বাধীন তদন্তের ও আহ্বান জানিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআফগানিস্তানের কোমল পানীয় উঠছে নিলামে
পরবর্তী নিবন্ধহাসিনা ও সাধারণ দুর্নীতিবাজের মধ্যে পার্থক্য নেই : দুদক চেয়ারম্যান