যাকাত ও সদকাতুল ফিতর : অসহায় গরিব মানুষের মুখে ঈদের হাসি ফোটায়

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ২৮ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র রমজানের ইবাদতের মধ্যে সদকাতুল ফিতর আদায় করা অন্যতম ইবাদত। রমজানের সিয়াম সাধনা শেষে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদের আনন্দ ধনীগরিব সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং এ আনন্দে যেন মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্য শরিক হতে পারে এ জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে সদকাতুল ফিতর। সাদকাতুল ফিতর পবিত্র রমজান মাসের অন্যতম ইবাদত। আসছে ঈদুল ফিতর। আর ঈদুল ফিতরের দিনের অন্যতম আমল হলো সদকাতুল ফিতর। ইসলামে সদকাতুল ফিতরের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি যাকাতেরই একটি ধরন। রাসুল (সা.) হাদিস ও সুন্নাহ তা আদায়ের তাগিদ করেছেন এবং এর নিয়মনীতি শিক্ষা দিয়েছেন। এ কারণেই রাসূলের (সা.) যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ ইসলামের পাঁচ রোকন ও দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক আমল ও ইবাদতের মতো সদাকাতুল ফিতরও নিয়মিত আদায় করে আসছে। আমাদের এ অঞ্চলে তা ফিতরা নামে পরিচিত।

সদাকাতুল ফিতর যাকাতের মতোই একটি আর্থিক ইবাদত। তবে সম্পদের সদাকাকে যাকাত বলা হয়। আর দেহের যাকাতকে সদকাতুল ফিতর বা সদকায়ে ফিতর বলা হয়। সদাকাহ শব্দটি আরবি শব্দ। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এটি দ্বারা ফরজ যাকাতকে বুঝায় আবার নফল দানের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। আধুনিক প্রেক্ষাপটে যাকাতের বিধান নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে : ফিতরাহ শব্দের অর্থজন্মস্থান বা সৃষ্টিকার্য। পারিভাষিক অর্থেসাদাকাতুল ফিতর বলতে ঐ আর্থিক ইবাদতকে বুঝায় যা পবিত্র রমজানের রোজা সমাপ্ত হওয়ার এবং রোজা খোলার পর দেয়া হয়। যে বছর মুসলমানদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয় সে বছরই নবী করিম (সা.) সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার হুকুম দেন। অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরি সনের রমজান মাসে রোজা ফরজ করার আয়াত নাযিল হয়। (সুরা বাকারাহ : ১৮৩)। যাকাত যেমন মালকে পবিত্র, বৃদ্ধি ও পরিশুদ্ধ করে তেমনি সাদাকাতুল ফিতর রোজাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে রোজা পালনকালে যে সব বেহুদা বা অনর্থক কাজ অথবা কোনো অশ্লীল কথা ও কাজ করা হয়েছে বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটেছে তা ধুয়ে মুছে পবিত্র করার লক্ষ্যে। একই সাথে ঈদুল ফিতরের দিন গরিবমিসকিনদের মুখে ঈদের হাসি ফোটানোর উদ্দেশ্যে সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব।

যাকাত আদায়ের মাধ্যমে শুধু মালের পবিত্রতা অর্জনই নয়। যাকাত প্রদানের ফলে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবিধ উপকার হয়। আর যাকাত আদায়ের মাধ্যমেই আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পরকালে মুক্তি দিয়ে থাকেন। যে সুখবর দিয়েছেন বিশ্বনবী (সা.)। হজরত আবু আইয়ুব (রা.) থেকে বর্ণিতএক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আপনি আমাকে এমন একটি কাজ সম্পর্কে অবহিত করুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বলেন তার কী হয়েছে? তার কী হয়েছে? রাসুল (সা.) আরো বললেন, তার বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে যাকাত দেবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখবে। উল্লেখিত হাদিস থেকে বুঝা যায় যে যাকাত আদায়ের মাধ্যমেও আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জাহান্নাম থেকে নাজাত দিয়ে জান্নাত দান করবেন। এখন রমজান মাস চলছে। যারা এই রমজানে যাকাত আদায় করবে তারা অন্য মাসের চেয়ে ৭০ থেকে সাতশ গুণ বেশি সাওয়াবের অধিকারী হবে।

সদকাতুল ফিতর এমন প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমান নারীপুরুষ নাবালেগসাবালেগের ওপর ওয়াজিব যার নিকট তার প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত এতো মূল্যের মাল হবে যার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়। সে মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব হোক অথবা না হোক। সাদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয় ঈদের দিনে প্রত্যুষে। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি ফজরের পূর্বে মারা যাবে অথবা ধনসম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে তার ওপর ওয়াজিব হবে না। আবার যে শিশু ফজরের পর জন্মগ্রহণ করবে তার ওপরও ওয়াজিব হবে না। তবে যে শিশু ঈদের রাতে জন্ম গ্রহণ করবে তার ওপর ওয়াজিব হবে। আবার যে ব্যক্তি ফজরের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং ধনের মালিক হবে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার যৌক্তিকতা স্বয়ং রাসুল (সা.) বিশ্লেষণ করেছেন। হাদিস শীরফে পাওয়া যায় রাসূলে করিম (সা.) সাদাকাতুল ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাদারকে অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে পরিশুদ্ধ রাখা এবং মিসকিনদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা স্বরূপ। যাকাত, সদকা ও ফিতরা দেওয়ার সময় গ্রহীতাকে তা জানানোর প্রয়োজন নেই। যাকাত গ্রহীতা যদি আত্মীয়স্বজন আপনজন বা পরিচিত সম্‌ভ্রান্ত ব্যক্তি হন তাহলে যাকাত উল্লেখ করাটা মোটেই সমীচীন নয়। কারণ এতে গ্রহীতা অপমানিত অসম্মানিত ও বিব্রতবোধ করতে পারেন।

যে সকল ব্যক্তির পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব তার কয়েকটি নিম্নরূপ : . প্রত্যেক সচ্ছল ব্যক্তি তার নিজের ছাড়াও নাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করবে। ২. জ্ঞান ও হুশহারা সন্তানের পক্ষ থেকে তার মাল থাক অথবা না থাক তাদের পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। ৩. বাড়ির চাকরবাকর বা তারা যাদের ভরণপোষণ করেন তাদের পক্ষ থেকে মালিককে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। ৪. সাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে পিতার সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব যদি দুস্থ ও দরিদ্র হয়। ৫. স্ত্রীর পক্ষে তার স্বামী সদকাতুল ফিতর আদায় করবেন। ৬. পিতা মারা গেলে এবং দাদা জীবিত থাকলে দাদার ওপর সকল দায়িত্ব বর্তাবে যে দায়িত্ব পিতার ওপর ছিল। ৭. স্ত্রী যদি সচ্ছল হয়ে থাকেন তাহলে শুধু তার সদাকাতুল ফিতর নিজেই আদায় করা যাবে। এ বছর ১৪৪৬ হিজরি সনের ফিতরার হার জনপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮০৫ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটি এ হার নির্ধারণ করেছে। গতবছর (২০২৪) জনপ্রতি ফিতরার হার সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭০ টাকা ছিল। দেশের সব বিভাগ থেকে সংগৃহীত আটা, যব, খেজুর, কিশমিশ ও পনিরের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে এই ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে। মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ওই পণ্যগুলোর যেকোনো একটি পণ্য বা তার বাজারমূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবেন। এই পণ্যগুলোর স্থানীয় খুচরা বাজারমূল্যের তারতম্য রয়েছে। সে অনুযায়ী স্থানীয় মূল্যে পরিশোধ করলেও ফিতরা আদায় হবে।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদের খাবারে সচেতনতা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা