ঈদের খাবারে সচেতনতা জরুরি

মো. ইকবাল হোসেন | শুক্রবার , ২৮ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। এই সময়ে খাবারের বৈচিত্রতা এবং পরিমাণ দুটোই অনেক বেশি থাকে। ঈদের দিনগুলোতে তেলমসলাযুক্ত খাবারসহ মাংস বেশি খাওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ একমাস রোজার রাখার পরে হঠাৎ করে এতোবেশি খাবার আপনার স্বাস্থ্যঝুকি তৈরী করতে পারে। তাই রমজান পরবর্তি সময়ে খাওয়ার ব্যাপারে একটু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

একটি পরিবারে শিশুসহ অনেকগুলো মানুষের বসবাস। তাদের অনেকেরই বিভিন্ন রকমের শারীরিক সমস্যা থাকতে পারে। এমন ব্যাক্তিদের জন্য ঈদে বাড়তি সচেতনতা গ্রহণ করা উচিৎ।

একদিনে কতটুকু মাংস খাওয়া যাবে : প্রতিটি মানুষের শরীরের বৈশিষ্ট্য আলাদা, তাই খাবারের চাহিদাও আলাদা। সুস্থ স্বাভাবিক ৭০ কেজি ওজনের একজন পুর্নবয়স্ক ব্যাক্তি সারাদিনে প্রায় ২৫০৩০০ গ্রাম মাংস খেতে পারেন। তবে অন্য কোন প্রোটিনের উৎস থাকলে মাংসের পরিমাণ কমাতে হবে। সঙ্গে প্রতিবেলায় কিছু শাকসবজি বা সালাদ অবশ্যই রাখতে হবে।

অতিরিক্ত মাংস খেলে কি ক্ষতিঃ শরীরের চাহদার চেয়ে বেশি মাছ বা মাংস বা প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন কন্সটিপিউশন, রক্তের কোলেস্টেরল বেশি, উচ্চ রক্তচাপ, পাইলস, ফিসার, ইউরিক এসিড ইত্যাদির সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। তাই প্রোটিন জাতীয় খাবার অবশ্যই পরিমিত পারিমাণে খেতে হবে।

কিডনী রোগঃ কিডনী রোগীদের ফার্স্টক্লাস প্রোটিনের ৩০৫০ শতাংশ কমাতে হবে। রেডমিটে সোডিয়ামের পরিমান কিছুটা বেশি থাকে। তাই গরু ও খাসি না খেয়ে মুরগির মাংস খাওয়া উত্তম। বিচিজাতীয় খাবার (সেকেন্ডক্লাস প্রোটিন) ডাল, ডালের তৈরী খাবার, লবনাক্ত খাবার বন্ধ করতে হবে। অন্যান্য খাবারগুলোও পরিমিত পারিমাণে খেতে হবে।

হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলঃ ঈদের দিনেও খাদ্যতালিকা মেনেই খেতে হবে। হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য গরু ও খাসির মাংস খাওয়া বন্ধ করতে হবে। চামড়া ছাড়া মুরগি বা হাঁসের মাংস খাওয়া যাবে। তবে গরু বা খাসির মাংসের গায়ে যে সাদা চর্বি লেগে থাকে, সেটা বাদ দিয়ে রান্না করে ঝোলছাড়া পরিমিত পারিমাণে খাওয়া যাবে। কলিজা, মগজ, ভুড়ি খাবেন না।

ডায়াবেটিসঃ ডায়াবেটিক ব্যাক্তিদের মিষ্টি এবং মিষ্টি জাতীয় খাবারগুলো খাবেন না। সরল কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে জটিল কার্বোহাইড্রেট খাবেন। সেই সাথে তৈলাক্ত ও চর্বি জাতীয় খাবারগুলো খুবই কম খেতে হবে। তেলচর্বি ক্যালরিবহুল খাবার। গরু খাসির মাংসে চবির্র পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাই ডায়াবেটিক ব্যাক্তিরা গরুখাসির চর্বিবিহীন মাংস পরিমিত পারিমাণে খাবেন, ঝোলে খাবেন না।

ইউরিক এসিডঃ যাদের রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমান বেশি আছে তারা হাঁস, গরু, খাসির মাংস খাবেন না। সবধরনের অর্গান মিট যেমন কলিজা, মগজ, মাছেরডিম, ভুড়ি খাওয়া যাবে না। সামুদ্রিক মাছ, বুটের ডাল, মটরেরডাল খাবেন না। অন্যান্য ডালও কম খাবেন। বেগুন ফুলকপি, ব্রোকলি, মাশরুম খাবেন না।তবে ইউরিক এসিডের পরিমান নিয়ন্ত্রণে থাকলে নিষিদ্ধ খাবারগুলো পরিমিত পারিমাণে খাওয়া যাবে।

ফ্যাটি লিভারঃ ফ্যাটি লিভারের সমস্যা থাকলে তেল চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। আপনার জন্য খুব কমতেলে বা তেলছাড়া আলাদা মিঙ সবজি রান্না করবেন। মাছ মাংস তেল দিয়ে রান্না হবে কিন্তু আপনাকে ঝোল বাদ দিয়ে খেতে হবে। ভাত রুটি বা অন্যান্য কার্বো কার্বোহাইড্রেট মেপে।খেতে হবে।

আইবিএসঃ আইবিএস এর রোগীরা দুধ এবং দুধের তৈরী খাবার খাবেন না। যেমন দুধের তৈরী পায়েস, পুডিং, সেমাই, সুজি ইত্যাদি। তবে ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ দিয়ে রান্না করলে খাওয়া যাবে। শাক খাবেন না। আপনি শাক, দুধ এবং দুধের তৈরী খাবার খেলে পেটের পীড়া বেড়ে গিয়ে, আপনার ঈদ আনন্দ বেদনায় রুপান্তরিত হতে পারে।

দইমিষ্টি কখন খাবেনঃ ঈদের আয়োজনের একটি অন্যতম অংশ হচ্ছে দইমিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার। দইমিষ্টি বেশ ক্যালরি বহুল খাবার। এতে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। তাই এই খাবারগুলো কখনোই মুল খাবারের সাথে খাবেন না। এগুলো স্ন্যাক্স হিসাবে খাবেন এবং বিকালের পরে এই খাবারগুলো খাবেন না। এক্ষেত্রে মিষ্টি দইয়ের পরিবর্তে টকদই খাওয়া উত্তম।

ব্যায়ামঃ অনেকে মনে করেন ঈদে আবার কিসের ব্যায়াম। কিন্তু না, আপনি না চাইলেও ঈদের দিনগুলোতে বেশি খাবার খাচ্ছেন। তাই এসময়ে ব্যায়াম খুবই জরুরি। প্রতিদিন অন্তত ৪০৫০ মিনিট একটানা হাটবেন। এতে আপনার খাবার পরিমান কিছুটা বেশি হলেও সমন্ময় হয়ে যাবে।

সকল ক্ষেত্রে কিভাবে স্বাস্থ্যঝুকি কিছুটা কমানো যায়ঃ

নিচের শর্তগুলো মেনে চললে স্বাস্থ্যঝুকি কিছুটা কমানো যায় :

) মাংসের গায়ে কোনো সাদা চর্বি লেগে থাকা যাবে না। রান্নার আগে সাদা চর্বি ফেলে দিতে হবে। ২) মাছ মাংস ঝোল ছাড়া খেতে হবে। ৩) রান্নায় সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সরিষার তেল বা সুর্য্যমুখির তেল ব্যাবহার করতে হবে। ৪) মাংস সকালে এবং দুপুরের খাবারের সাথে খাবেন। কখনোই রাতের খাবারের সাথে খাবেন না। ৫) হার্টের রোগীরা খাওয়ার পরে কিছুটা বিশ্রামে থাকবেন। ৬) মাংস ছোট ছোট টুকরো করে কেটে রান্না করবেন। ৭) রান্না মাংস না খেয়ে গ্রিল বা কাবাব করে খাওয়া যেতে পারে। ৮) মাংস রান্নার সময় পটাশিয়াম সমৃদ্ধ কোন সবজি যোগ করুন। যেমন টমেটো। খাওয়ার সময় এক টুকরা লেবু নিন। এগুলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করবে। ৯) প্রতিবার খাবারের সাথে টকদই দিয়ে তৈরী সালাদ খাবেন। ১০) সকল ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।

এক দিন বেশি খেলে কিছু হয় না

এই ভাবনা না ভাবাই ভালো। বেশি খেলে বেশি ক্যালরি শরীরে প্রবেশ করবে। সুস্থ থাকতে সে ক্যালরি ঝরাতে পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু সেটা করা হয় না। ফলে এক দিন বেশি না খেয়ে প্রতিদিনই পরিমাণ মতো খাবার খাওয়া স্বাস্থের জন্য ভালো।

লেখক : জ্যেষ্ঠ পুষ্টি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধকেন এই পৈশাচিক আচরণ
পরবর্তী নিবন্ধযাকাত ও সদকাতুল ফিতর : অসহায় গরিব মানুষের মুখে ঈদের হাসি ফোটায়