ঈদে নগরীতে তিন স্তরের নিরাপত্তা

লম্বা ছুটিতে অপরাধ ঠেকাতে সিএমপির এমন উদ্যোগ নগরবাসীকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ

হাসান আকবর | শুক্রবার , ২৮ মার্চ, ২০২৫ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ঈদের লম্বা ছুটিতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে ফাঁকা থাকবে চট্টগ্রাম নগরী। ওই সময়ে সক্রিয় হতে পারে অপরাধী চক্র। তাই ফাঁকা নগরীতে বাসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় সিএমপি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও উদ্যোগ নিয়েছে। রোজার সময়কালের মতো ঈদের ছুটিতেও নগরীকে অপরাধমুক্ত রাখার জন্য সিএমপি সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা পুলিশের পাশাপাশি নগরবাসীকেও ছুটির সময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

সূত্র জানিয়েছে, ঈদের লম্বা ছুটি শুরু হচ্ছে আজ থেকে। টানা নয়দিনের ছুটিতে নগরীর লাখো মানুষ গ্রামে ঈদ করতে চলে যাবে। শহরের অধিকাংশ বাসাবাড়ি, অফিস এবং দোকানপাটগুলো জনশূন্য হয়ে যাবে। মানুষ না থাকার সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা চুরি ও লুটপাটের ঘটনার সুযোগ নিতে পারে। এবারকার ঈদের ছুটিতে এই ধরনের অপরাধ ঠেকাতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ছক তৈরি করেছে পুলিশ। নগর পুলিশ শহরের রাজপথ থেকে শুরু করে অলিগলি এবং আবাসিক এলাকাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছে। বিশেষ করে জনগুরুত্বপূর্ণ ভবন, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, ঈদগাহ মাঠ, বিপণিবিতান, মার্কেট, ব্যাংক, এটিএম বুথ এবং বাসাবাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যক্রম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য সাদা পোশাকেও বাড়তি পুলিশ মোতায়ন করা হবে।

সিএমপি কর্তৃপক্ষ নগরীর প্রতিটি থানা এলাকাকে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেছে। থানা পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যাংক এবং এটিএম বুথগুলোর তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। একইসাথে এটিএম বুথে দায়িত্বরতদের নাম ও ফোন নম্বরও সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এসব কর্মকর্তাদের কাছে থানা পুলিশের ফোন নম্বর সরবরাহের পাশাপাশি ট্রিপল নাইনে ফোন করার ব্যাপারটিও স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে।

ইস্টার্ণ ব্যাংক জিইসি শাখার ব্যবস্থাপক পারভেজ আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে সিসিটিভিসহ এলার্ম সিস্টেম। এর বাইরে পুলিশের পক্ষ থেকেও সব ধরণের সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।

সিএমপির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, পুলিশের পাশাপাশি নগরবাসীকেও নিজেদের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তারা বলেন, এক সপ্তাহ থেকে নয়দশদিনের জন্য বাসা খালি রেখে চলে যাওয়ার সময় অবশ্যই বাড়তি সিকিউরিটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ জন্য বাসার নিরাপত্তায় দরজায় অধিক তালা ব্যবহার করা, নগদ অর্থ বা স্বর্ণালংকার ফাঁকা বাসায় রেখে না যাওয়া, সিসিটিভি ক্যামেরা ও অ্যালার্ম সিস্টেমের মতো প্রতিরোধমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া, আবাসিক এলাকায় রাতে অতিরিক্ত নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করা, নতুন নিয়োগ দেওয়া নিরাপত্তাকর্মীদের এনআইডি কার্ড ও ছবি সংরক্ষণ করা, সন্দেহজনক কোনো ব্যক্তি ঘোরাফেরা করলে তাৎক্ষণিক স্থানীয় থানাকে জানানো ও আইনশৃঙ্খলার অবনতিসংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯এ ফোন করলে অপরাধ বহুলাংশে নির্মূল করা সম্ভব হবে। বাসা খালি করে চলে যাওয়ার সময় প্রতিবেশি কিংবা ধারে কাছের কাউকে খেয়াল রাখতে বলে গেলেও একটি সুরক্ষা তৈরি হবে।

পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলাইমান জানান, আমার এলাকায় বেশ কয়েকটি অভিজাত আবাসিক এলাকা রয়েছে। কমিশনার স্যার আমাদেরকে যেভাবে নির্দেশনা প্রদান করেছেন আমরা সেভাবে কাজ করছি। ইতোমধ্যে আবাসিক এলাকার প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছি। অপরাধ রোধে তাদেরকে করণীয় সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যাংক, মার্কেটসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হবে। বিশেষ করে এটিএম বুথগুলোর নিরাপত্তায় বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আফতাব হোসাইন দৈনিক আজাদীকে বলেন, খুলশী আবাসিক এলাকা, দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকা, নাসিরাবাদ প্রোপাইটিজসহ সবগুলো আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পুলিশ এবং যৌথবাহিনীর টহল জোরদারের পাশাপাশি বাড়তি সাদা পোশাকেও পুলিশ মাঠে থাকবে। তিনি আবাসিক এলাকাগুলোর সিসিটিভি এবং সিকিউরিটি গার্ডদের সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

সিএমপির অতিরিক্তি উপকমিশনার (এসপি) (জনসংযোগ) মাহমুদা বেগম দৈনিক আজাদীকে জানান, ঈদের ছুটিতে নগরীতে পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকবে। এবার যৌথবাহিনীও মাঠে রয়েছেন। এতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় আগের থেকে অনেক বেশি লোকবল মাঠে রয়েছেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। নগরবাসীরও দায়িত্ব রয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের সম্পদের নিরাপত্তা স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করলে অঘটন রোধ করা যাবে।

সিএমপির ট্রাফিক বিভাগও ঈদের সময় মাঠে থাকবে বলে জানিয়ে একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, গাড়ির চাপ কমে গেলেও পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশও অপরাধ বিভাগের পুলিশের সাথে কাজ করবে।

সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, ঈদের ছুটিতে নগরী ফাঁকা হয়ে যাবে। হাজার হাজার মানুষ ঈদ করতে বাড়ি চলে যাবেন। কিন্তু পুলিশ নগরীতে থাকবে। নগরবাসীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে বলে উল্লেখ করে পুলিশ কমিশনার বলেন, আমরা একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছি। ওই প্ল্যান নগরীর সবগুলো থানাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হবে। আশাকরি নগরীর নিরাপত্তায় কোন অভাব হবে না।

তিনি বলেন, প্রতিটি থানা এবং পুলিশ ফাঁড়িকে নিরাপত্তা রক্ষায় কঠোর নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আমাদের যেসব ঈগল পার্টি রোজার সময় বিভিন্ন মার্কেটের নিরাপত্তায় কাজ করেছে ওগুলো ঈদের ছুটিতে মাঠে থাকবে। তাদেরকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। যেসব আবাসিক এলাকার বাসাবাড়ি খালি হয়ে যাবে সেখানে বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাদা পোশাকে পুলিশ কাজ করবে।

পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ নগরবাসীকেও নিজেদের সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, অপরাধীরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। তারা যেনো কোনভাবেই সুযোগ না পায় তা আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি নগরীকে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রাখার জন্য সিএমপি কর্তৃপক্ষ সব ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানান।

সিএমপির ১৩ নির্দেশনা : এদিকে ঈদে মহানগরীতে বাসাবাড়ি, প্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতান নিরাপত্তায় সিএমপি ১৩ টি নির্দেশনা দিয়েছে।

নির্দেশনা সমূহ হলো, বাসাবাড়ির দরজায় অধিক নিরাপত্তা সম্পন্ন অতিরিক্ত লক বা তালার ব্যবহার করা। নগদ টাকা বা স্বর্ণালংকার ফাঁকা বাসায় রেখে না যাওয়া। প্রতিরোধমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেমনসিসিটিভি ক্যামেরা, এলার্ম সিস্টেম ইত্যাদি। আবাসিক এলাকায় রাতে অতিরিক্ত নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করা। নতুন নিয়োগকৃত নিরাপত্তাকর্মীদের এনআইডি কার্ড ও ছবি সংরক্ষণ করা। সন্দেহজনক কোনো ব্যক্তি ঘোরাফেরা করলে তাৎক্ষণিক স্থানীয় থানাকে অবহিত করা। আইনশৃঙ্খলা অবনতি সংক্রান্ত কোন ঘটনা ঘটলে দ্রুত জরুরি সেবা৯৯৯ অথবা সিএমপি স্পেশাল কন্ট্রোল হটলাইন-() ০১৩২০০৫৭৯৯৮, ০১৩২০০৫৪৩৮৪ এ অবহিত করা। ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অধিকতর জোরদার করা। ব্যাংকের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা যাতে সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করে সে বিষয়টি তদারক করা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের জন্য স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন অফিসারকে পালাক্রমে নিযুক্ত করা। ব্যাংকের ভল্টের চারপাশে সিসি টিভি ক্যামেরার কাভারেজ নিশ্চিত করা এবং সন্দেহজনক কোনো বিষয় নজরে এলে তা নিকটস্থ পুলিশকে অবহিত করা। ব্যাংকের সিসি টিভি ক্যামেরাগুলো ভালোভাবে কাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে নিকটতম থানা পুলিশের সহায়তা গ্রহণ করা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুমাতুল বিদা : ফিলিস্তিনিসহ নিপীড়িত মানবতার মুক্তির শপথ ধ্বনিত হোক
পরবর্তী নিবন্ধআশরাফুল আলম খোকন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদন