কী নিয়ে লিখবো এই নিয়ে আমার বরাবরের সমস্যা, বিশেষ করে মন যখন হয়ে উঠে অস্থির, চঞ্চল। না, কারো অপেক্ষার কারণে নয় এই অস্থিরতা কিংবা চঞ্চলতা। কারণ অতি ব্যস্ততা। তাছাড়া মনের উপর তো কারো দখল নেই। নজরুলের যে ‘বিরাট শিশু’, তার হাতেই তো আমাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত। তিনিই তো কলকাঠি যা নাড়ার নাড়েন। যারা নিয়মিত লেখেন তাদের এমনটি হয় কিনা জানিনে, কিন্তু আমার হয়। এ যে লেখকের ব্যর্থতা সে কথা স্বীকার করতে লেখকের কোন সংকোচ নেই। কলমের ভার, পাশাপাশি চিন্তাশক্তির ধার কম হলে এমনটি হতে বাধ্য। এর থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে যে কাজটি আমার করা হয় তাহলো, ফিরে দেখা, ফেলে আসা দিনগুলিকে, রেখে আসা মুহূর্তগুলিকে বর্তমানে নিয়ে আসা এবং তার ওপর ভর করে কলমকে এগিয়ে নেয়া। এ যেন অনেকটা ক্রাচে ভর করে পঙ্গুর হেঁটে চলা। এই ফেলে আসা মুহূর্ত কিংবা দিনের কথা মনে এলে মনে পড়ে অস্কার ওয়াইল্ডের বিখ্যাত উক্তির কথা। ডাবলিনে (আয়ারল্যান্ড) জন্ম হওয়া এই আইরিশ লেখক ও কবি বলেছিলেন, ‘কোন মানুষ তার অতীত কেনার মত ধনী নন।’ তিনি এও বলেছিলেন, ‘স্মৃতি হলো সেই ডায়েরি যা আমরা সকলেই আমাদের সাথে বহন করে চলি।’ মানুষের বয়স যখন একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে, একেবারে শেষ–পর্যায়ে নয়, গিয়ে পৌঁছায়, যখন তার সামনে যাবার আর কোন পথ খোলা থাকে না, কিংবা শারীরিক–মানসিকভাবে কিছুটা কিংবা অনেকটা স্থবির তখন সেই ব্যক্তি ফিরে যায় তার অতীতে। যে অতীতকে নিয়ে সে এতটা পথ বহন করে এসেছে সেই অতীতের পাতা উল্টাতে থাকে জেনে বা না–জেনে, নিজের অজান্তে। কথা হলো– কেবল বয়স বাড়লে কিংবা জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এলেই কি আমাদের পিছু ফিরে তাকানো হয়? না, তা নয় কিন্তু। সময়ে–অসময়ে আমরা সবাই কম–বেশি ফিরে তাকাই। সে যে বয়সেরই হোক না কেন। ফেলে আসা অতীত, ফেলে আসা আনন্দ–দুঃখ, হাসি–কান্না, সুখ–অসুখ ভরা দিন, মুহূর্তের কথা স্মরণ করি। স্মরণ করে আনন্দ পাই, দুঃখ পাই। কখনো–সখনো নিজে নিজে হাসি, নিজে নিজে কাঁদি। কখনো–সখনো নিজের অনেক বোকামি–মুহূর্তের কথা মনে করে ভাবি কী বোকাই না ছিলাম। ভাবি, কাজটি ঐভাবে না করে এইভাবে করলে বুঝি ভালো হতো। কিংবা কথাটা এইভাবে না বলে, ঐভাবে বললে বুঝি ভালো হতো। মানুষের ভাবনারও কি শেষ আছে? লাগামহীন চিন্তার যে নাটাই তার সুতো তো সেই ‘বিরাট শিশুর’ হাতে। আব্দুল আলীম তো গেয়েছেন– ‘ছায়াবাজি রূপে বানাইয়া মানুষ/যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ/ যেমনি নাচাও তেমনি নাচি/আল্লাহ তুমি খাওয়াইলে আমি খাই।’
এই যে এলোমেলো মনের ভাবনাগুলিকে যখন শব্দের আকারে একটি রূপ দেয়ার চেষ্টা করছি তখন ঘরের বাইরে প্রকৃতি তার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তীব্র তাপদাহ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতির সাথে মানুষের মনের যে একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে তা এই লেখা লিখতে গিয়ে আবারো টের পাচ্ছি। বাইরের দশা দেখে মনে হয় এ যেন, ‘প্রখর তপন তাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে,/ বায়ু করে হাহাকার।’ প্রকৃতির এই কঠিন রূপ এ যেন কবির ভাষায় ‘বৈরাগীর রুদ্র বেশ’। এ যেন কবির ভাষায় ‘রজনী নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধ দিন / আরাম নাহি জানে রে / দারুণ অগ্নিবানে রে।’ অনেক বছর আগে এমনি এক তীব্র গরমের দিনে গিয়েছিলাম দিল্লির আগ্রায় তাজমহল দেখতে। সাথে দুই সন্তান ও তাদের মা। আত্মজা সপ্তর্ষির আবার তার বাবার মত টুকটাক লেখালেখির অভ্যেস। ডাচ ভাষায় তার স্কুল ম্যাগাজিন সম্পাদনার দায়িত্বে সে তখন। ঠিক করেছিল যমুনা নদীর তীরে সম্রাট শাহজাহান ও তার স্ত্রী মমতাজের সমাধিস্থলের কোন এক স্থানে কিংবা বিশাল বাগানের কোন এক গাছের ছায়ায় বসে সাথে নেয়া ডায়েরিতে কিছু লিখবে। মার্বেল পাথরের তৈরি চোখ ধাঁধানো এই সমাধির এক কোনে কিছুক্ষণ বসে সে–চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গরমের তীব্র তাপে খানিকবাদেই তাকে ক্ষান্ত দিতে হয়। অন্যদিকে আত্মজ অতীশ, বয়স তখন বড়জোর ছয়/সাত তীব্র তাপদাহে অস্থির হয়ে ওঠে। উপায়ন্তর না দেখে তাড়াহুড়ো করে সবাই গেইটের কাছে পার্ক করা গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। গাড়ির শীতল হাওয়ায় যেন নুতন প্রাণ ফিরে পেলাম আমরা সবাই। সেই আমার প্রথম ও শেষ দৃষ্টিনন্দন ঐতিহাসিক ‘তাজমহল’ দর্শন। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম ভারতে ইসলামী শিল্পের রত্ন ও বিশ্ব হেরিটেজের প্রশংসিত শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলোর কেবল একটি নয়, অন্যতম তাজমহলের দিকে। উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে তাজমহলকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহি স্থান হিসাবে মনোনীত করা হয়। এর নির্মাণ কাজ শুরু ১৬৩২ সালে, শেষ হয় ১৬৪৮ সালে, অর্থাৎ ১৬ বছর লাগে এই অসাধারণ স্থাপত্য নির্মাণে। সমাধিকে ঘিরে যে সমস্ত স্থাপনা ও বাগান রয়েছে তা শেষ হয় আরো পাঁচ বছর পর। সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ ১৬৩১ সালে তাদের ১৪তম সন্তান গৌহারা বেগমের জন্মের সময় মৃত্যুবরণ করেন।
এই যে তাজমহলের কথা লিখছি এও সেই যে শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম পিছু ফিরে দেখা, তারই কারণে। কত কথাই তো মনে পড়ে, মনে পড়ে কত স্মৃতি। এখন যখন ফেলে–আসা দিন আর আজকের দিনের কথা তুলনা করি তখন মনে হয় ফেলে–আসা দিনই বুঝি ছিল ভালো। এ কথা শুনে হয়তো কেউ কেউ বলে উঠবে, মাছ যেটি ফসকে যায়, সেটি সব সময় বড়। কথাটি কতটা সত্যি জানিনে তবে এ কথা বলতেই হয়, আগের দিন ছিল অনেক নির্ভেজাল। মানুষের ভালোবাসা ছিল নির্ভেজাল। প্রেম, ভালোবাসা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব ছিল নির্ভেজাল। আমাদের স্কুল বয়সে গ্রাম আমাদের টানতো। কখন গ্রীষ্মের স্কুল ছুটি হবে, কখন গ্রামে যাবো, বাড়ির পেছনে পুকুর–পাড়ে পাটি বিছিয়ে বসে, কিংবা শুয়ে শীতল বাতাস গায়ে মাখবো, আম গাছ থেকে আম পেড়ে আম খাবো– এই নিয়ে দিন গুনতাম। মাথার মধ্যে ঘুরতো শীতের দিন পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা খেঁজুর গাছ থেকে কখন রসের হাঁড়ি নামিয়ে কাঁচা–রস খাবো। নিজের গাছের খেঁজুর আমরা কটি ভাই–বোন চুরি করে খেতাম। তাতে এক উত্তেজনা ও আনন্দ থাকতো। আজকের দিনে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই সমস্ত গল্প কোনভাবেই তাদের প্রলুদ্ধ করবেনা সে নিশ্চিত বলতে পারি। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই যে আমাদের নানা রংয়ের ছোট্ট বেলার সোনালি দিনগুলি। কেবল যে দিনগুলি হারিয়ে গেছে তা নয়। এখন যেন সব হারিয়ে গেছে। গ্রামের সেই পুকুর প্রায় শুকিয়ে গেছে। খেঁজুর, আম গাছ, বাড়ির সামনের বড়ই গাছ– সব হারিয়ে গেছে। যে গাছগুলির নিচে গ্রীষ্মের তীব্র দাহ থেকে বাঁচার জন্যে দুপুরে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম, সেই গাছগুলি আর নেই। কেউ নতুন করে গাছ লাগায় না, যারা আছে তারা কেবল কাটে, প্রকৃতির বারোটা বাজিয়ে। কেবল তাই নয় গ্রামের সেই আগেকার দিনের প্রাণও হারিয়ে গেছে। এখন সবাই হয়ে গেছে শহর–মুখো। কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে উপজেলা শহরে। এখন আর গ্রামের বাড়িতে বিয়ে বা কোন অনুষ্ঠান হয় না। সব হলে। বাজে না আর উঁচু গাছের ডগায় লাগানো মাইকে পুরানো দিনের গান। আমাদের পাশে যে গ্রামে ঘটা করে মেলা বসতো, এখন আর তেমন করে বসে না। আগের সে জৌলুশ হারিয়েছে অনেক আগে। এখন গ্রামের লোকজন আর পুরানো–দিনের মেলায় আকৃষ্ট হয় না। তাদের চাওয়া–পাওয়া অনেক বড় হয়ে গেছে। আধুনিক হয়েছে। কত কিছুই বদলে গেছে। কত কিছুই হারিয়ে গেছে। কেবল হারায়নি আমাদের মনে গেঁথে থাকা পিছু ফেলে আসা সেই সব দিনের কথা, সেই সময়কার মুহূর্ত, দিনগুলির কথা। তাইতো বারবার ফিরে যাই ফেলে আসার দিনে। পুরানো দিনের স্মৃতিকে সাথে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলি। ওয়াইল্ডের কথায় আবারো বলি– ‘স্মৃতি হলো সেই ডায়রি যা আমরা সকলেই আমাদের সাথে বহন করি।’
লেখক
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট