সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! নিশ্চয় আপনারা অবগত আছেন, পবিত্র রমজানুল মুবারক অসংখ্য ফজিলতমন্ডিত মহিমান্বিত, জাগতিক ও আধ্যত্মিক চেতনায় তাৎপর্যমন্ডিত আলোকিত মাস। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানুল মুবারকে ই’তিকাফ পালন করা উম্মতের জন্য সুন্নাত সাব্যস্ত করেছেন। পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের অসংখ্য স্থানে ই’তিকাফের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আজকের খোত্বার আলোকে এতদবিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপনের প্রয়াস পাব।
ই’তিকাফ এর সংজ্ঞা:
ই’তিকাফ আরবি শব্দটি “আকফুন” শব্দ থেকে নির্গত, এর শাব্দিক অর্থ: অবস্থান করা, ইসলামী শরীয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিয়ত সহকারে রোযা রেখে মসজিদে অবস্থান করাকে ই’তিকাফ বলা হয়। (ফতওয়ায়ে শামী, বাহারে শরীয়ত)
আল কুরআনে ই’তিকাফের বর্ণনা:
পবিত্র কুরআনুল করীমে ই’তিকাফ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলের নিকট অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী ও ই’তিকাফকারী এবং রুকু, সিজদা কারীদের জন্য পবিত্র রাখ (সূরা: বাকারা: ২: ১২৫)
আল্লাহ তা’য়ালা অন্য আয়াতে এরশাদ করেছেন, তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তাদের সাথে সহবাস করোনা (সূরা বাকারা: ২: ১৮৭)
ই’তিকাফ’র প্রকারভেদ:
ই’তিকাফ তিন প্রকার: ১. ওয়াজিব, ২. সুন্নাত, ৩. মুস্তাহাব।
১.প্রথম প্রকার ই’তিকাফ হলো ওয়াজিব যেমন কেউ ই’তিকাফ পালন করার মান্নত করল তা পালন করা ওয়াজিব।
২.সুন্নাতে মোয়াক্কাদা কিফায়া: রমজানের শেষের দশদিন ই’তিকাফ পালন করা অর্থ্যাৎ বিশ রমজান সূর্যাস্তের পূর্বে ই’তিকাফের নিয়াতে মসজিদে প্রবেশ করবে। ত্রিশে রমজান সূর্যাস্তের পর বা উনত্রিশ তারিখ চাঁদ দেখার পর মসজিদ থেকে বের হবে। মহল্লার কেউ আদায় না করলে সকলে গুনাহগার হবে। যদি মহল্লাহর একজনও পালন করে সকলে দায়মুক্ত হবে। ওয়াজিব ও সুন্নাত ই’তিকাফ পালনের ক্ষেত্রে রোজা রাখা জরুরী। (বাদায়েউস সানায়ে খন্ড ২, পৃ: ১০৮,১০৯)
৩. মুস্তাহাব : ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফ ছাড়া যেসব ইতিকাফ পালন করা হয় তা মুস্তাহাব ও নফল ইতিকাফ হিসেবে গণ্য হবে। মুস্তাহাব ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত নহে। মসজিদে ই’তিকাফের নিয়তে প্রবেশ করলে যতক্ষণ অবস্থান করবে ই’তিকাফকারী থাকবে। বের হলে ই’তিকাফ শেষ হয়ে যাবে।
ই’তিকাফের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান:
ই’তিকাফের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হলো ১. মসজিদুল হারাম, ২. মসজিদে নববী শরীফ, ৩. বায়তুল মুক্কাদ্দাস শরীফ, ৪. জামে মসজিদ, ৫. যে মসজিদে মুসল্লী সংখ্যা বেশী হয়। এ ক্ষেত্রে হানাফী মযহাব মতে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতসহকারে অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদকে বুঝানো হয়েছে। এ অর্থে ই’তিকাফের জন্য জুমাআহ মসজিদ হওয়া শর্ত নয়। সহজ অর্থে প্রত্যেক মসজিদে ই’তিকাফ সহীহ যদিও সেটা জামাত বিশিষ্ট মসজিদ না হয়। বিশেষত: বর্তমানে অনেক মসজিদ এমন রয়েছে যেখানে ইমামও নেই মুয়াজ্জিনও নেই। (রদ্দুল মোখতার বাহারে শরীয়ত)
মহিলাদের জন্যও ই’তিকাফ পালন করা সুন্নাত:
মহিলাদের জন্য নিজ গৃহে নামাযের জন্য নির্ধারিত স্থানে ই’তিকাফ করা বাঞ্চনীয়। মহিলাদের জন্য মসজিদে ই’তিকাফ থাকা মাকরুহ। মহিলাদের ই’তিকাফ পালনে আরেকটি শর্ত হলো যে স্বামীর অনুমতি ছাড়া ই’তিকাফ পালন তাদের জন্য জায়েজ নয়। (ফতোওয়ায়ে শামী)
হাদীস শরীফের আলোকে ই’তিকাফের ফযীলত:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশদিনে ই’তিকাফ পালন করতেন (বোখারী শরীফ, খন্ড: ৩, হাদীস নং ২০১৫)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমজানে দশ দিন ই’তিকাফ করতেন অত:পর যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সেই বছর বিশ দিন ই’তিকাফ করেন। (বোখারী শরীফ, হাদীস নং ২০৪৪)
মান্নতের ই’তিকাফ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফের বর্ণনা:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত ওমর (রা.) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, আমি জাহেলী যুগে মান্নত করেছিলাম মসজিদুল হারামে একরাত ই’তিকাফ পালন করব। নবীজি তদুত্তরে বললেন, তুমি তোমার মান্নত পূর্ণ করো।(বোখারী শরীফ, হাদীস নং ২০৩২)
ই’তিকাফের উদ্দেশ্য লায়লাতুল কদর অনুসন্ধান করা:
ই’তিকাফ পালনের মাধ্যমে শবে কদর অনুসন্ধান করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উদ্দেশ্য ছিল, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমি প্রথম দশকে ই’তিকাফ করেছি এই কদর রজনী অনুসন্ধান করার উদ্দ্যেশ্যে। অত:পর ই’তিকাফ করেছি মধ্য দশকে অত:পর মধ্য দশক পেরিয়ে এলাম অত:পর আমাকে বলা হলো কদর তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ই’তিকাফ করতে চায় সে যেন ই’তিকাফ করে। অত:পর লোকেরা তাঁর সাথে ই’তিকাফ করল। (মুসলিম শরীফ, হাদীস: ১১৬৭)
হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে রমজানে দশ দিনের ই’তিকাফ করলো সে যেন দুটি হজ্ব ও দুটি ওমরা আদায় করলো। (বায়হাকী)
ই’তেকাফকারী যা করা নিষেধ:
উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা (রা🙂 থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ই’তিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হলো যে কোন অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাবেনা, কোন জানাযায় উপস্থিত হবেনা, স্ত্রীকে স্পর্শ করবেনা, স্ত্রী সহবাস করবেনা, কোন প্রয়োজনের জন্য বের হবেনা তবে যে প্রয়োজন অপরিহার্য সেক্ষেত্রে বের হবে। রোজা ছাড়া কোন ই’তিকাফ হয় না। (আবু দাউদ হাদীস নং : ২৪৭৩)
ইতিকাফকারীর আমল:
ই’তিকাফকারী দুনিয়াবী কথাবার্তা বলা থেকে নিজকে বিরত রাখবে। একেবারে চুপও থাকবেনা। কুরআন মজীদ তিলাওয়াত, হাদীস শরীফ পাঠ, সম্মানিত নবী রসূল আলাইহিমুস সালাম এর জীবনী গ্রন্থ পাঠ, সাহাবায়ে কেরাম ও আউলিয়া কেরামের জীবন চরিত পাঠ, নবীজির উপর অধিক হারে দরুদ শরীফ পাঠ, যিকির আযকার, তসবীহ তাহলীল ও ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠের মাধ্যমে বরকতময় প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত করবে। (ফাতহুল কদীর)
প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও শরয়ী প্রয়োজনে ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ:
প্রাকৃতিক প্রয়োজন যথা প্রস্রাব, পায়খানা, অযু, গোসল, দ্বিতীয় টি হলো শরয়ী প্রয়োজন এমন মসজিদে ই’তিকাফ করেছে যেখানে জুমা বা জামাত হয়না তাহলে জুমা বা জামাতের জন্য বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে ( রদ্দুল মোখতার) বিনা ওজরে ই’তিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। ই’তিকাফের কাযা ওয়াজিব হবে। অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখার জন্য অথবা জানাযার নামায পড়ার জন্য মসজিদ হতে বের হলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। কাযা ওয়াজিব হবে। (ফিকহ কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য)
মাসআলা: মসজিদ যদি ভেঙ্গে যায় বা ই’তিকাফকারীকে জোর করে মসজিদ থেকে বের করে দিল তাৎক্ষনিক অন্য মসজিদে চলে গেল ই’তিকাফ ফাসিদ হবেনা। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫ম, পৃ: ১৮৫)
মাসআলা: ই’তিকাফ পালনকারী মসজিদে পানাহার করবে, নিদ্রা যাবে। ওসব কাজের জন্য যদি মসজিদের বাইরে গমন করে ই’তিকাফ ভঙ্গ হবে। (দুরুল মোখতার) কিন্তু পানাহারের বেলায় সতর্কতা অপরিহার্য যেন মসজিদ অপরিস্কার না হয়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫ম, পৃ: ১৮৬)
মাসআলা: ই’তিকাফকারী দিনের বেলা ভুলক্রমে পানাহার করলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হবেনা। ই’তিকাফ অবস্থায় গালমন্দ করলে, ঝগড়া বিবাদ করলে ই’তিকাফ নূরবিহীন ও বরকতবিহীন হয়ে যাবে। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫ম, পৃ: ১৮৬)
হে আল্লাহ আমাদের উপর রহমত, বরকত, শান্তি ও কল্যাণ দান করুন। হে বিশ্ব বিধাতা ইহকাল পরকালে আমাদেরকে করুণা ও ক্ষমা নসীব করুন। হে প্রভূ আমাদের সকল নেক আমল সালাত–সিয়াম কিয়াম ও ই’তিকাফ কবুল করুন। যেমন কবুল করেছেন আপনার মকবুল বান্দাদের। আল্লাহ আমাদের আপনাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন। কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা আমাদের নাজাত দান করুন। বিতাড়িত শয়তানের প্রতারণা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
হে আল্লাহ আমাদের রুহানী শক্তি অর্জন ও আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য ই’তিকাফ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।