ইফতার আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো ভাঙা, নাস্তা, সকালের খাবার, উপবাস ভঙ্গ করা ইত্যাদি। রোজাদার ব্যক্তি সূর্যাস্তের পর যে পানাহারের মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ করে, তাকে ‘ইফতার’ বলা হয়। যে খাদ্য বা পানীয় দ্বারা ইফতার করা হয়, তাকে বলা হয় ‘ইফতারি’। ইফতারের সময় আল্লাহর প্রেমে ত্যাগের আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে প্রত্যেক ঈমানদারের অন্তর। একটুখানি পানি মুখে দেওয়ার সাথে সাথে সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই মুছে যায়। সম্মিলিত ইফতার গ্রহণ মানুষের হৃদয়ে সাম্য, সহমর্মিতা, সমপ্রীতি ও বৈষম্যহীনতার এমন একটি দৃশ্য ভেসে উঠে যা অন্য কোনো ধর্মে বা সভ্যতায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
১.ইফতারের আত্মিক গুরুত্ব: রোজাদার ব্যক্তি দিনের বেলায় আত্মসংযমের মাধ্যমে ভোগের স্বাধীনতা থেকে বের হয়ে আত্মিক উৎকর্ষতা লাভের ব্যাপক সুযোগ লাভ করে। ইফতারের সময় বান্দার দেহমনে আনন্দের শিহরণ তৈরি হয়। ইফতার শুধু খাবার গ্রহণ নয় বরং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম। সারা দিন ক্ষুধা পিপাসা, সকল কামনা বাসনা উপেক্ষা করে নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হয়ে আল্লাহর একটি আদেশ পালনে সফল হয়েছে, ইফতার করার সুযোগ পেয়েছে, তাই তার মন আনন্দে উদ্বেলিত। এটি একপ্রকার খুশি। আবার যখন রোজার পুরস্কার স্বরূপ পরকালে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাবে, তখন আরেকবার খুশি হবে। আনন্দে নেচে উঠবে হৃদয়মন। সেটাই মুমিনের প্রকৃত পাওনা। প্রিয় নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোজাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হলো, ইফতারের সময়। অপরটি হলো, যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে । (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং–১১৫১)
২. ইফতারের সামাজিক শিক্ষা: রোজাদার ব্যক্তি গরিব, অসহায়, দিনমজুর, অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষের অবস্থা সহজেই উপলব্ধি করতে পারে। ফলে তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশের মানসিকতা তৈরি হয়। সামর্থবান ব্যক্তিরা গরিব মানুষের জন্য ইফতার– সাহরি পাঠিয়ে থাকেন বলে সেই সমপ্রীতির ভিত্তি মজবুত হয়। সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এটি সহমর্মিতা প্রকাশের মাস। (ইবনে খুযাইমা)
বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকায় মাস ব্যাপী ইফতারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই আয়োজনে ধনী–গরিব, অভিজাত ও সাধারণ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার গ্রহণ করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন, সামাজিক মসজিদ ও মাদ্রাসার উদ্যোগে বিশেষ দিনে ইফতার মাহফিলের আয়োজন হয়ে থাকে। সকল স্তরের মানুষের উপস্থিতিতে সেখানে রমজানের তাৎপর্য, যাকাত ও সাদকাতুল ফিতর ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এমনকি সামাজিক সমস্যা ও সম্পর্ক উন্নয়নের দিকনির্দেশনা বা করণীয় বিষয় নিয়েও আলোচনা থাকে।
৩. ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়: এই সময়টা দোয়া কবুলের উপযুক্ত সময়। এই বরকতময় সময়ে আল্লাহ তাআলা বান্দার সকল দোয়া কবুল করে নেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তির দোয়া ফেরত দেয়া হয় না। ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোযাদার যতক্ষণ না ইফতার করে এবং মজলুমের দোয়া। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার দোয়া মেঘমালার উপরে তুলে নিবেন এবং তার জন্য আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং আল্লাহ্ বলবেন, আমার মর্যাদার শপথ! আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবো, একটু বিলম্বেই হোক না কেন। (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং–১৭৫২)
৪.অন্যকে ইফতার করানোর ফজিলত: রোজাদারকে ইফতার করানো একটি পুণ্যময় আমল। এর মাধ্যমে রোজার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করা যায়। হযরত যায়েদ বিন খালিদ আল জোহানি রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাই সে রোজাদারের মতোই সওয়াব লাভ করে এবং রোজাদারের সাওয়াব কমেনা। (তিরমিজি, হাদীস নং –৮০৭)
হজরত সালমান ফারসি রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য তা গোনাহের ক্ষমাস্বরূপ হবে এবং দোজখের আগুন থেকে তার মুক্তির কারণ হবে। এ ছাড়া সে রোজাদার ব্যক্তির সমান সওয়াব পাবে; অথচ রোজাদারের সওয়াবও কিছুমাত্র কম হবে না।
৫.ইফতার আয়োজনকারীর জন্য দোয়া: কারো বাড়িতে ইফতার গ্রহণ করলে তার জন্য দোয়া করা প্রিয় নবীজির সুন্নাত। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিআল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে উবাদাহ রাদিআল্লাহু আনহু এর বাড়িতে গেলেন। সা’দ রাদিআল্লাহু আনহু রুটি ও যাইতুন তৈল আনলেন। তা খাওয়ার পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের নিকট রোজাদারগণ ইফাতর করেছে, সৎ লোকেরা তোমাদের খাদ্য খেয়েছে এবং ফিরিশতাগণ তোমার জন্য রহমতের দোয়া করেছেন। (আবু দাউদ, হাদীস নং –৩৮৫৪)
ইফতারের সময় দোয়া পাঠ করা সুন্নাত। ইফতারের সময় প্রিয় নবীজি বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিযকিকা আফতারতু। হে আল্লাহ আমি আপনার উদ্দেশ্যেই সাওম পালন করেছি এবং আপনার দেয়া রিজিক দ্বারাই ইফতার করছি। (আবু দাউদ, হাদীস নং–২৩৫৮)
৬. ইফতার বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ : রোজার অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হলো ইফতার। বর্তমানে এটি মুসলিম সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে। ইফতারির এই আয়োজন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে এবং অমুসলিমরাও তার স্বীকৃতি দিচ্ছে। (যদিও রোজাদারদের জন্য কারো স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি মূল বিষয় নয়)। পৃথিবীর বিভিন্ন অমুসলিম দেশে মুসলিম রাষ্ট্রদূতদের সম্মানে ইফতারের আয়োজন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি পৃথিবীর বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রমজান মাস উপলক্ষে মুসলিম শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানানো হয়ে থাকে। মুসলিমদের জন্য ইফতার, সাহরি ও নামাজের ব্যবস্থা করার আয়োজন মুসলমানদেরকে উদ্বেলিত করে।
এমনকি ইফতার এখন ইসলামি সাম্রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে অন্যদের কাছে গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে সাব্যস্ত। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেসকো’ ইফতারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। সংস্থাটির তথ্য মতে, ‘পবিত্র রমজানে মাগরিবের আজানের পর ইফতার করা হয়। মুসলমানেরা একত্রিত হয়ে ইফতার করেন। এতে পারিবারিক ও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি মজবুত হয়। এ ছাড়া ইফতারের মাধ্যমে একাত্মতা, উদারতা ও সামাজিক যোগাযোগ বাড়ে। ইফতারের খাবার বানাতে শুধু প্রবীণরাই নন, প্রায়ই ১. ইফতারের লাগান পরিবারের তরুণ সদস্য, এমনকি শিশুরাও’। (ওয়েবসাইট, ইউনেস্কো)
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, ইসলাম শিক্ষা, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ।