(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দুরুদুরু বুকে বাঘের সাথে লাঞ্চ সেরে রুমেই ফিরে আসলাম। একটি ভাতঘুম দেয়ার চিন্তা করছিলাম। বিকেলে কোন প্রোগ্রাম নেই। আজ প্রোগ্রাম সাজানো হয়েছে সন্ধ্যা থেকে। সিক্স স্টার হোটেলের তুলতুলে নরোম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। আমার কেবলই বাঘের কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল রেস্তোরাঁর কাচের উপর বাঘের জমকালো থাবার কথা। হোয়াইট টাইগার রেস্তোরাঁয় বসে সত্যি সত্যি দুইটি সাদা বাঘের কান্ডকারখানা দেখা যতটুকু না ভাগ্যের আমার মনে হচ্ছিল তার থেকে ঢের বেশি ভাগ্য হলো আপাদমস্তকে ফিরে আসা! খোলা চত্বরে উন্মুক্ত বাঘ দুইটি কী পরিমাণ আনন্দের সাথে যে সময় পার করছিল তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। তাদের সেই আনন্দ শতগুণে বৃদ্ধি পেতো যদি আমি বা আমার মতো দুয়েকজন তাদের ডাইনিং টেবিলের শোভা বাড়াতো!!
বাঘের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হলো আমি স্বপ্নেও বাঘের আনাগোনা দেখলাম। দেখলাম সুন্দরবনও। স্বপ্নের কোন তালগোল পেলাম না। বাঘ কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়েছি ঠিক আছে, তাই বলে কি স্বপ্নেও বাঘ হানা দিতে হবে! আবার বাঘ দেখবো ভালো কথা, সাথে সুন্দরবন কোত্থেকে হাজির হলো! আমি তো সুন্দরবনের কথা একটুও ভেবে ঘুমাইনি। বাঘের সাথে যে সুন্দরবনের একটি মোলায়েম সম্পর্ক আছে তা–ই বা স্বপ্নে কে ঠিক করে দিলো! অবশ্য বছর দুয়েক আগে আমরা সদলবলে তিনরাত– তিনদিন সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে কাটিয়েছিলাম। বন–বাদাড় থেকে শুরু করে সাগর–নদী–চর সব চষে বেড়িয়েও একটি বাঘ দেখিনি। তবে অসংখ্য হরিণ আর বানর দেখেছিলাম। দেখেছিলাম নদীতে ভাসমান কুমিরও। অবশ্য, প্রজনন কেন্দ্রেও প্রচুর কুমিরের দেখা মিলেছিল। বাঘ না দেখার অতৃপ্তি নিয়ে ফিরেছিলাম সুন্দরবন থেকে, অথচ চীনের গুয়াংজুর চাইমলং হোটেলের পাশে জ্যান্ত বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে! হোটেলটিতে বাঘগুলোর অবস্থা এবং অবস্থান এমন নান্দনিকভাবে করা হয়েছে যে, মনে হচ্ছে বন–বাদাড়ে বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। জঙ্গলের ভিতরে গড়ে তোলা রিসোর্টে বাঘের আবাসন সুন্দরবনের মতো গহীন না হলেও এখানকার আবহও একেবারে অন্যরকম। গা ছমছম করে!
লায়ন ফজলে করিম ভাই অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাগাদা দিলেন আমাকে। বললেন, দ্রুত করুন। সময় হয়ে গেছে। আমি জানি যে, এখানে অনুষ্ঠান একেবারে অন–টাইম শুরু হয়, শেষও হয় একইভাবে। কোনকিছুতেই আধিক্য নেই, নেই বালখিল্য। ডিনার শুরু হবে সাতটায়, শেষ হয়ে যাবে নয়টার মধ্যে। এগুলো ভদ্রপাড়ার হিসেব, রাতজাগা অঞ্চলে আবার সবকিছুই অন্যরকম। সেখানে নাকি রাতভর নানা আয়োজন চলে!
বিছানা ছাড়লাম, ফ্রেশ হতে যাওয়ার আগেই কফি মেকার চালিয়ে দিলাম। রেস্তোরাঁয় বসে কফি খাওয়ার চেয়ে রুমে বসে আয়েশ করা স্বস্তিদায়ক নানাভাবে। রেস্তোরাঁয় মানুষের ভিড়ের পরিবর্তে ঘরের আলীশান ডিভাইনে হেলান দিয়ে কফিতে চুমুক দেয়ার তৃপ্তি আলাদা। রুমে হোটেল কর্তৃপক্ষের দেয়া ফ্রুটস বাকেটে একটি আপেল ও কয়েকটি কলা অনাদরে পড়ে আছে। টাটকা ফলগুলো খাওয়ার সময় এবং সুযোগ কোনটিই হয়নি। আমার ব্যাগে বিস্কিটও রয়েছে। অতএব কলা বিস্কিট আপেল এবং কফি দিয়ে সান্ধ্য নাস্তার পর্বটি বেশ জমকালোভাবেই সারা যাবে।
আবারো ইন্টারকম। বুঝতে পারছিলাম তাড়া দিবেন ফজলে করিম ভাই। হ্যালো বলতেই লায়ন ফজলে করিম আমাকে অনুষ্ঠানস্থলে চলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। তিনি জানালেন যে, ব্যবসায়িক কিছু কাজ সেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমার সাথে যোগ দেবেন।
অনুষ্ঠানস্থলও এই হোটেলেই। হোটেলেরই একটি হলরুমে আয়োজন করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উৎপাদনকারী চীনা প্রতিষ্ঠান জ্যাক টেকনোলজিস। তাদের উৎপাদিত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির পণ্য সম্পর্কে দুনিয়াকে জানাতেই এই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে গত কয়েকদিন ধরে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকদের প্রটোকল দিতে দিতে চীনা সুন্দরীদের মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চীন হংকং তাইওয়ান ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, আমেরিকা, কলম্বিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিক রয়েছেন। বাংলাদেশ থেকেও লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী জ্যাকের আমন্ত্রণে চীন সফর করছেন। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চললেও নিজে বেশ হীনম্মন্যতায় ভুগছিলাম একটিমাত্র কারনে যে, অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বাংলাদেশের একমাত্র সংবাদিক আমি। ভারত কিংবা পাকিস্তান থেকে বেশ কয়েকজন করে সাংবাদিক অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও বাংলাদেশ থেকে আর কোন সাংবাদিককে দাওয়াত দেয়া হয়নি। তাই শুরু থেকেই নিজেকে সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু লাগছিল।
আমি তৈরি হয়ে অনুষ্ঠানস্থলের দিকে যাত্রা করলাম। রিসোর্টের এপথ–ওপথ মাড়িয়ে রিসিপশনে গেলাম এবং হলটি কোনদিকে জানতে চাইলাম। তারা আমার সাথে একজন নারী কর্মী দিয়ে হলটিতে পৌঁছে দিতে বললো। মনে হলো একটু বাড়াবাড়ি! ডানে বামে বলে দিলেই তো হতো। কী দরকার একজনকে কষ্ট দেয়া! নাকি মেয়েটিকে কোন ‘পানিশমেন্ট ডিউটি’ করানো হচ্ছে কে জানে! কিন্তু কিছুক্ষণ হাঁটার পর বুঝলাম যে, আসলে শুধু ডানে–বায়ে বলে দিলে হতো না। এই মেয়ে পথ দেখিয়ে না আনলে আমি রিসোর্টের চোরাগুপ্তা অলিগলির কোথায় যে হারিয়ে যেতাম কে জানে! চীনা মেয়েটি পৌঁছিয়ে না দিলে এই হল পর্যন্ত আসা আমার জন্য কঠিন ছিল। কী যে এক আয়োজন রিসোর্টের পরতে পরতে! কী এক অপার বিস্ময় সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে চাইমলং রিসোর্টে!!
আমাকে নিয়ে মেয়েটি এগিয়ে যাচ্ছিলো রিসোর্টের একেবারে বাইরে একটি ভবনের দিকে। আসলে সেটি আলাদা কোন ভবন নয়, হলরুম। আমি হলরুমের প্রবেশপথে পৌঁছে ভড়কে গেলাম। এতো বড় হলরুম আমি কখনো দেখিনি। বিশাল হলরুমের মাঝে কোন পিলার নেই, পুরোটাই যেনো উন্মুক্ত। সুউচ্চ হলরুমের ভিতরে নানা রঙের আলোর খেলা চলছিল। আমি হলের প্রবেশমুখে পৌঁছার সাথে সাথে দুই চীনা তরুণী প্রচন্ড বিগলিত ভাবে দাঁড়ালেন আমার সামনে। ‘ওয়েলকাম স্যার’ বলে আমাকে তাদের অনুসরণ করতে বললেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না তারা আমাকে চিনলেন কি করে! আমার গলায় জ্যাকের দেয়া কার্ড ঝুললেও সেখানে নাম এবং ছবি এতো ছোট্ট যে তা দুই তরুণীর এতো দূর থেকে চোখে পড়ার কথা নয়। নাকি অতিথিদের সবার চেহারা নিয়ে তারা আগেভাগে কাজ করেছে!
দুই তরুণী আমাকে একেবারে সামনের রো’তে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করলেন। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, টেবিলের উপরে একটি নেমপ্লেট। যাতে লেখা রয়েছে আমার এবং দৈনিক আজাদীর নাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে, দুই চীনা তরুণী কোন ভুল করেননি, তারা আমাকেই ঠিকঠাকভাবে এনে ঠিকঠাক মতো জায়গায় বসিয়ে দিয়ে সরে পড়েছেন।
আমি শুধু অবাকই নয়, বিস্মিত হলাম। খেয়াল করে দেখলাম যে, হলরুমের ভিতরে অসংখ্য গোলাকার টেবিল। প্রতিটি টেবিলে দশজন করে মানুষ। অন্তত হাজার দুয়েক মানুষের বসার ব্যবস্থা রয়েছে বিশাল হলটিতে। একইসাথে দুই হাজার মানুষের বসার ব্যবস্থা! অধিকাংশ চেয়ারেই মানুষ, আরো মানুষ আসছেন, নারী পুরুষ। চীন কিংবা গুয়াংজুর পাশাপাশি সারা দুনিয়া থেকে অতিথি এসেছেন হলটিতে। কি করে যে, এতো বিশাল একটি আয়োজন ম্যানেজ করা হচ্ছে কে জানে। কর্মীদের হাতে হাতে ওয়াকিটকি। সারাক্ষণই ওয়াকিটকি কথা বলছে। আর একটির পর একটি কাজ একেবারে নির্ভুলভাবে হয়ে যাচ্ছে। কোন টেবিলে কে কে বসবেন তাও ঠিকঠাক করে বোর্ডে প্রিন্ট টেবিলে ডিসপ্লে করা হচ্ছে। ম্যানুতে কি কি খাবার থাকছে তাও লিখে রাখা হয়েছে। সব টেবিলে একই রকমের খাবার নয়, বাছ–বিচার করে টেবিলের ম্যানু সেট করা হয়েছে। আমার পক্ষে আসলেই লিখে বুঝানো সম্ভব নয় যে, কী দুর্দান্ত এক আয়োজনে কী বিশাল একটি অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হচ্ছে!
সুবিশাল হল, বিশাল মঞ্চ, বিশাল ডিজিটাল স্কিন। হাজার দু’য়েক স্যুটেড বুটেড অতিথি। আমি এক চুনোপুটি বসে আছি একেবারে সামনের সারির মেইন চেয়ারটিতে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলেন সিনহুয়া টিভির সুদর্শনা এক উপস্থাপিকা, সাথে একজন চীনা উপস্থাপক। নারী উপস্থাপিকতা যা ইংরেজীতে বলেন সেটিকে চীনা ভাষায় বলছিলেন অপর উপস্থাপক। একেবারে জমকালো, গোছানো এবং নান্দনিক একটি অনুষ্ঠান বলতে যা বুঝায় ঠিক যেনো তাই করে দেখালো জ্যাক কোম্পানি। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম যে, ডিজিটাল স্কিনে তাবত বিশ্বের বড় বড় সব ব্র্যান্ডগুলোর লোগো প্রদর্শিত হচ্ছে, সাথে দৈনিক আজাদী লোগোও। নাইকি, এডিডাস, ওয়ালমার্ট, জারা, প্রাইমার, এইচএন্ডএম’সহ দুনিয়ার সেরা সেরা ব্র্যান্ডগুলোর সাথে দৈনিক আজাদীকে একই কাতারে দেখে আমি চমকিত। সিনহুয়া টিভির উপস্থাপিকা ইংরেজীতে বলছিলেন, দৈনিক আজাদী, ‘দ্য ফার্স্ট বেঙ্গলি নিউজপেপার অফ ইন্ডিডেপেন্ডেড বাংলাদেশ’। চীনা যুবক নিজের ভাষায়ও একইভাবে দৈনিক আজাদীর কথা বলছিলেন। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, বিশ্বের এতো বড় বড় ব্র্যান্ড ও আন্তর্জাতিক সংস্থার লোগোর পাশাপাশি দৈনিক আজাদীর লোগো বারবার স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল! আমার বুক ফুলে উঠছিল গর্বে। আমি উপরের দিকে তাকালাম। মনে হলো, সম্মানটা উপর থেকেই আসে। (চলবে)
লেখক : দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার।