সিরাজুল মোস্তফার ‘জীবনযুদ্ধ’ ঐশীপ্রেমের অনন্য স্মারক

নাসির উদ্দিন হায়দার | শনিবার , ১৫ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ একটি মহাজ্ঞানসমুদ্র। এই জ্ঞানসমুদ্রে আছে কত মণিকাঞ্চন। মাইজভাণ্ডারে নিত্য ফোটে আজব রঙের ফুল। মাইজভাণ্ডারের প্রেমপুষ্প সৌরভ ছড়ায় ভুবনজুড়ে। সিরাজুল মোস্তফা নামের অশীতিপর মানুষটি মাইজভাণ্ডারী প্রেমকাননের একটি ফুল। পুরো একটি জীবন তিনি কাটিয়েছেন ঐশীপ্রেমের মায়ায়।

সিরাজুল মোস্তফার বয়স এখন ৮১। নয় বছর বয়সে তার ‘জীবনযুদ্ধ’ শুরু, বিড়ি শ্রমিক হিসাবে। টানা ৬৮ বছর তার কেটেছে কঠিন এক সংগ্রামে। সিরাজের জীবন সংগ্রামে গড়া, আধ্যাত্মিকতায় মোড়া। এই বয়সেও তিনি সমান কর্মঠ। এখনো তিনি চাকরি করেন, একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই সুদীর্ঘ জীবন তার কেটেছে যুগপৎ জাগতিকতা ও আধ্যাত্মিকতায়যার নান্দনিক বয়ান আছে তার আত্মজীবনীমূলক ‘জীবনযুদ্ধ’ গ্রন্থে। বইটির উপশিরোনামে সিরাজুল মোস্তফা তার জীবনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে-‘নেক নজর পীরআউলিয়ার, চার আনাতে সাগর পার’।

হ্যাঁ, সাগর পার হতে ষোল আনাই লাগে। কিন্তু কোন কোন মানুষ যারা অতুলনীয়, অনন্য, তারা চার আনাতেই সাগর পাড়ি দিতে পারেনসিরাজুল মোস্তফা সেই রকম একজন মানুষ।

সিরাজুল মোস্তফা কেমন মানুষ? মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের গাউসিয়া হক মঞ্জিলের সাজ্জাদনশীন, মওলা হুজুর সৈয়দ মুহাম্মদ হাসান মাইজভাণ্ডারীর বাণী এখানে প্রণিধানযোগ্য– ‘আদর্শবান, সংস্কৃতিমনষ্ক, সজ্জন ও সুফি মানুষের প্রতিকৃতি সিরাজুল মোস্তফা ছাহেব।’ (সূত্র : অভিব্যক্তি, জীবনযুদ্ধ)

সিরাজুল মোস্তফা পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান, মাইজভাণ্ডারী প্রেমকাননের প্রেমপুষ্প সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের ৬ দশকের বন্ধু। কেমন বন্ধু? শোনা যাক সুফি মিজানের জবানিতে, ‘অবিশ্বাস্য চড়াইউতরাই, বিচ্যুতি আর নৈতিকতার চরম মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একপর্যায়ে হয়ে গেলেন আমার জীবনসংগ্রামের শ্রেষ্ঠতম বন্ধু। সে ১৯৬৭ সালের কথা। সেই থেকে দুই ভাইয়ের আর এক নতুন ইতিহাস। উপরি পাওনা হিসাবে সংযোজন হলো ঐশী দিশাআল্লামা আবদুছ ছালাম ঈছাপুরী হুজুরের আধ্যাত্মিক মেহেরবাণী।কাজের সময় ৪০ ফুট মাটির নিচে ইট মাথায় দিয়ে দুই ভাই একত্রে ঘুমানোর মত কত না বলা বিচিত্র স্মৃতি আছে।’

লিখতে বসেছি করপোরেট ব্যক্তিত্ব, মরমী সংগীতশিল্পী ও সুফি ধারার ‘সুজন’ সিরাজুল মোস্তফার ‘জীবনযুদ্ধ : নেক নজর পীর আউলিয়ার, চার আনাতে সাগর পার’ গ্রন্থ নিয়ে। ড. সেলিম জাহাঙ্গীর সম্পাদিত সিরাজের ‘জীবন যুদ্ধ’ গ্রন্থটি সুফি গবেষণায় নবতর সংযোজন।

গ্রন্থমতে, সিরাজুল মোস্তফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের তালুকদার বাড়িতে। পিতাআহাম্মদ ছফা, মাতমেনা খাতুন। সিরাজুল মোস্তফার পূর্বপুরুষরা সুদূর আরব থেকে এসে মোহাম্মদপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন আউলিয়া ঘরানার।

মাত্র ৩৩ বছর বয়সে কলেরায় মারা যান সিরাজুল মোস্তফার পিতা আহাম্মদ ছফা। শিশু সিরাজুল মোস্তফার বয়স তখন নয় বছর। পিতার আকষ্মিক মৃত্যু, কলেরা রোগী দোহাই দিয়ে বাড়িতে লাশ আনতে নিকটাত্মীয় সমাজপতির বাধা, মায়ের আর্তনাদ, শেষবারের মতো পিতার মুখটুকুও দেখতে না পারার যে বেদনা, সেটা সিরাজুল মোস্তফার লেখায় ফুটে উঠেছে করুণভাবে। সিরাজুল মোস্তফা লিখেছেন, ‘‘মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল বাবার মৃত্যুর খবর। তখন মাকে দেখলাম বুক চাপড়ে সবার সামনে কান্না করতে। মা বলছে, না না সে মরতে পারে না, সে বেঁচে আছে, তোমরা আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও। আমি তাকে দেখব, তাকে দেখতে চাই। সে সময় আমি আর ছোট দুই ভাই মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছিলাম। আরেক ছোট ভাই তখনো মায়ের পেটে, বাবা মারা যাওয়ার দুই মাস পর তার জন্ম হয়।’

পিতার মৃত্যুর পর অকূল পাথারে পড়া মায়ের কাছে সিরাজুল মোস্তফা হয়ে উঠলেন ‘অন্ধের ষষ্টি’। ৯ বছর বয়সে চার আনা পারিশ্রমিকে বিড়ি কারখানায় কাজ নিলেন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সিরাজুল মোস্তফা, বন্ধ হয়ে গেল পড়াশুনা। এক সপ্তাহ পরে কাজের মজুরি পেলেন এক টাকা ৭৫ পয়সা। বাড়ি গিয়ে সেই টাকা মায়ের হাতে দিলেন, মা দুই হাত তুলে দোয়া করলেন, সেই টাকায় মায়ের জন্য বাজারসদাই করলেন সিরাজ। মা সবাইকে ডেকে বলছেন, ‘দেখ আমার সিরাজ নিজের আয়ের টাকায় বাজার করে এনেছে’এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। ৯ বছরের একটি শিশুর জীবনে এর চেয়ে আনন্দময় ঘটনা আর কী হতে পারে? এরপর মানুষের বাড়িতে জায়গীর থাকা, চাকরি, কাজেম আলী হাইস্কুল থেকে প্রাইভেটে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়াসিরাজের জীবনটা আসলেই সংগ্রামে গড়া। সিরাজুল মোস্তফার জীবনে দেবদূত হয়ে আসেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম, যিনি পারিবারিক সূত্রে তার আত্মীয়। তৎকালীন চট্টগ্রাম ডিভিশনাল ইনকাম ট্যাঙ কমিশনার নানা ইকবালুর রহমান যখন সিরাজকে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি দেন, তখন তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সিনিয়র ক্লার্ক থেকে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারএসবে কাজের গুণ যেমন আছে তেমনি আছে পীর আউলিয়ার নেক নজর।

সিরাজুল মোস্তফা ও তার পরিবার সমাজপতি চাচা, এলাকার প্রভাবশালীদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় ব্যাপার প্রতি বার সিরাজ মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় প্রতিকার পেয়েছেন, ১৩ বছরের একটি শিশু পুলিশ অফিসারের দরজায় কড়া নাড়ছেন, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর মমতামাখা ভালোবাসা, কিংবা জমি উদ্ধারে ডিআইজির অবিশ্বাস্য সহায়তা পাওয়াএসব যে পীর আউলিয়ার নেক নজরের ফল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আগেই উল্লেখ করেছি সুফি মিজানুর রহমান ও সিরাজুল মোস্তফা দুজনই মহাত্মা আবদুছ ছালাম ঈছাপুরীর মুরিদ। ঈছাপুরী হুজুর মাইজভাণ্ডারী রত্নভাণ্ডারের গুপ্তধন। সিরাজুল মোস্তফা বড়ই আদবে উল্লেখ করেছেন তাদের দুজনের প্রতি ঈছাপুরী হুজুরের দয়ার কথা, মায়ার কথা। ঈছাপুরী তার পাক জবানে সিরাজকে বলেন, বাবা ভাণ্ডারী কেবলা কাবার কারামতের কথা। একদিন জোছনা রাতে স্থানীয় কিছু অবিশ্বাসী লোক ঈছাপুরী হুজুরকে বলেন, বাবা ভাণ্ডারী যদি আলোকিত এই রাতে বৃষ্টি নামাতে পারেন, তাহলে আমরা মাইজভাণ্ডারকে বিশ্বাস করব। ঈছাপুরী হুজুর সেই আরজ নিয়ে গেলেন বাবা ভাণ্ডারীর কাছে। আরজি পেশ করলেন।

এরপর কী হলো? পড়ুন ঈছাপুরী হুজুরের বয়ানে, ‘কিছুক্ষণ পর দেখলাম হঠাৎ করে বাবাজান বিছানায় উঠে বসলেন, উনার হাত মোবারক উপরের দিকে উঠাইয়া বজ্রকণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘হক , হক, হক’ এবং আবার আগের মতো সারা শরীর ছাদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে, প্রচণ্ড বাতাস ইছে, আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবাজানকে বললাম, বাবা দয়া করে এবার থামান। বাবাজান আবার বিছানায় উঠে বসলেন, নিজের ডান হাত উপরে উঠিয়ে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগলেনথাম, থাম, থাম। এ কথা বলে তিনি আবার শুয়ে পড়লেন। অল্পক্ষণ পর থেমে গেল ঝড়বৃষ্টি। যারা বাবা ভাণ্ডারীকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন তারা সবাই কান্না করতে করতে বাবাজানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, বাবা ভাণ্ডারীর প্রেমের ফাঁদে বন্দী হয়ে পড়লেন।’

কবিয়াল রমেশ শীল লিখেছেন, ‘মানুষ ধরার কল বসাইছে আমার বাবা ভাণ্ডারী/সেই কলেতে পড়লে ধরা তার থাকে না ঘরবাড়ি।’ বাবা ভাণ্ডারীর এই কারামতই তো রমেশ শীলের গানের সারমর্ম।

সিরাজুল মোস্তফা আলোচ্য গ্রন্থে লৌকিক ও অলৌকিক উপায়ে মাইজভাণ্ডারের মহান সব অলিদর্শনের বিবরণ দিয়েছেন। এই বিবরণে একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে সিরাজের ঐশীপ্রেমের নানা কাণ্ডকারখানাও। সিরাজুল মোস্তফার গ্রন্থে বাঙময় হয়ে উঠেছে তার প্রেমের মানুষ রজ্জাক ভাণ্ডারী ও আবদুল গফুর হালীর ঐশীদিশার কথাও।

শেষ করব পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমানের কথা দিয়ে। আলোচ্য ‘জীবনযুদ্ধ’ গ্রন্ধের মুখবন্ধে সুফি মিজান উল্লেখ করেছেন সিরাজুল মোস্তফা তার ‘জীবন সংগ্রামের শ্রেষ্ঠতম বন্ধু’। একজন সুফী ব্যক্তিত্বের দেওয়া এই অভিধা অমূল্য। সিরাজুল মোস্তফার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ মূলত তার জাগতিক ও আধ্যাত্মিকতার অনন্য স্মারক। এটি সম্পাদনা করেছেন ড. সেলিম জাহাঙ্গীর, প্রকাশ করেছে আপন আলো।

লেখক

সাংবাদিক ও চট্টগ্রামের লোকসংগীত গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনে নিজেকে সম্মান করতে শেখাটা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধওরে কর্ণফুলীরে…