সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন

ড. আনোয়ারা আলম | শুক্রবার , ১৪ মার্চ, ২০২৫ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব, নারী শিক্ষা ও অধিকার, আর্থিক স্বাধীনতা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই উন্নয়ন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরের নারী পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও কর্মপরিবেশের দাবিতে ধর্মঘট ও তাঁদের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯০৯ সালে প্রথম বারের মতো নারী দিবস উদযাপনের উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Accelerate Action’. বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন প্রতিপাদ্যে দিনটি উদযাপন করছে।

নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে এমন একটি অবস্থাকে বোঝানো হয়, যেখানে নারী নিজের অর্থ উপার্জন করে এবং তার আয়ের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখে। এর উপাদানগুলো অনেক বিস্তৃত। প্রথমত একজন নারী যখন নিজের উপার্জনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং এর উপাদানগুলো অনেক বিস্তৃত। একজন নারী যখন তার উপার্জিত আয় নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারে, তখনই তাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন বলা যায়। দ্বিতীয়ত নারীর শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন যা তাকে কর্মসংস্থান বা ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেয়। সেটিও এক অপরিহার্য উপাদান। এছাড়া সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনি কাঠামোর সহায়তা, নারী পুরুষ সমান সুযোগ এবং বেতন কাঠামোও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

নারীর শিক্ষা ও অধিকার এবং আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে বাঁধাগুলো মুখ্যত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি ভঙ্গির কারণে সামাজিক চাপ এবং পরিবারে প্রচলিত ধারণা, স্বাস্থ্য সমস্যা বিশেষত মাতৃত্বের সাথে সম্পর্কিত বিষয় বা গৃহস্থালি কাজে নারীর একক দায়িত্ব এবং এর সাথে বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, পারিবারিক সহিংসতা ইত্যাদি সূচকে নারীকে পিছিয়ে রেখেছে।

এবারে দেখা যাক বাংলাদেশের নারীর অবস্থান। জেন্ডার বৈষম্য ও বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার বৈষম্য প্রতিবেদনে (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট) –২০২৪ অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও আগের বছরের তুলনায় ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯ তম। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে ও সুযোগ সৃষ্টিতে এবারের সূচকে বাংলাদেশে নারী ও পুরুষে বৈষম্য আরও বেড়েছে। মাত্র ০.৩১১ স্কোর নিয়ে ১৪৬ টির মধ্যে শেষ অবস্থানে বাংলাদেশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবাপ্রাপ্তিতে, আয়বৈষম্যে পেশা ও প্রযুক্তিগত চাকরিতে মোট কর্মসংস্থানে নারীরা মাত্র এক পঞ্চমাংশের মতো। কর্মক্ষেত্রে ও জ্যেষ্ঠ পদে নারীর অংশগ্রহণের অনুপাত কমেছে।

নারীর প্রতি সহিংসতাবিবিএস ও জাতিসংঘের তহবিল কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী দেশের ৭০ শতাংশ নারী একবার হলেও শারীরিক যৌনতা, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

এবারে টেকসই উন্নয়ন কী? এ বিষয়ে বলতে হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যাতে ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে কোন ঘাটতি বা বাঁধার কারণ না হয়সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পিত উন্নয়ন হলো টেকসই উন্নয়ন।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, সুশাসন ও নারী এ লক্ষ্যে কী করণীয়

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও নতুন বাংলাদেশ এই চেতনার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে নারীর প্রতি সকল বৈষম্যের অবসান ঘটাতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিকূলতার অবসান ঘটাতে হবে।

টেকসই উন্নয়ন অর্জনের কর্মপরিকল্পনায় অভীষ্ট ৫ ও ১৬ কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধের পূর্ব শর্ত হিসেবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সহ আইনের শাসন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

জেন্ডার সমতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে নারীর অভিগম্যতা নিশ্চিত, ইন্টারনেট ও প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস সুলভ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

যে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানপরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাঙ্গনে বা সমাজে নারীর সমান সুযোগ দেওয়ার কাজ করছেন, তাদের উৎসাহিত করতে হবে।

নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি ও বেসরকারি উভয়ভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

সকল সেবাদান কারী প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কারীর পরিচয় গোপন করার নিশ্চয়তাসহ একটি নারীবান্ধব অভিযোগ প্রদান ও নিরসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধে যে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখার নিশ্চয়তা সহ একটি নারীবান্ধব অভিযোগ প্রদান ও নিরসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধে অভিযুক্ত যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে আইনের সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। সবচাইতে প্রয়োজন জনগণের সার্বিক পর্যায়ে সচেতনতা ও নারীর প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা। আদিবাসী নারীসহ প্রান্তিক পর্যায়ে নারীদের অধিকার বাস্তবায়ন। টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয় বরং সামাজিক ও মানবিক উন্নয়ন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকালের সাক্ষী পটিয়া: একটি জীবন্ত ইতিহাস
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা