২০২৫ সালের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের সুস্থ চলচ্চিত্রের চর্চার অঙ্গনে বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে চলেছে। একে একে চলে গেলেন টিভি ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, নির্মাতা ও চলচ্চিত্র শিক্ষক সৈয়দ আলী হায়দার রিজভী (৯ ফেব্রুয়ারি); চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের নেত্রী, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি স্থপতি লাইলুন নাহার স্বেমি (১২ ফেব্রুয়ারি) এবং অগ্রজ চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী, নির্মাতা ও চলচ্চিত্র শিক্ষক জাহিদুর রহিম অঞ্জন (২৪ ফেব্রুয়ারি)। তিনজনই এদেশের চলচ্চিত্রের সুস্থ ধারার চর্চায় নিরবচ্ছিন্নভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন এবং তিনজনই চলে গেলেন ফেব্রুয়ারি মাসে।
হায়দার রিজভী, যিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় রিজভী ভাই, ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন ছিলেন পোল্যান্ডে। কাজ করেছেন আন্দ্রে ভাইদা, রোমান পোলানস্কির মতো কিংবদন্তী পরিচালকের সহকারী হয়ে। সহকারী হয়ে কাজ করেছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ ও লার্স ভন তিয়ারের মতো বিশ্বখ্যাত পরিচালকের সঙ্গেও। পোলিশ ভাষায় ‘নার্সারি রাইমস’ ও ‘প্রাশিয়ান অফিসার’ নামে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সাড়া ফেলেছিলেন তিনি। ৩৫ বছর পর দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে হায়দার রিজভী তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এর আগে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেসি অধ্যয়নের জন্যে লন্ডনে যান।
কিন্তু সেখানে অভিনয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পরে দেশে ফিরে আসেন। পরে পোল্যান্ডের বিখ্যাত লড্্জ ফিল্ম স্কুল থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনায় ডিপ্লোমা করেন। ডিপ্লোমা করার পর তিনি ওয়ারশতে তাঁর চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি পোল্যান্ডে ছিলেন। তারপর দেশে ফেরেন ৩৫ বছরের প্রবাস জীবনের শেষে। শিক্ষকতার পাশাপাশি হায়দার রিজভী বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটার চর্চার সঙ্গেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। ছিলেন নাট্যদল ‘থিয়েটার’–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বাংলাদেশের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গেও আজীবন যুক্ত ছিলেন রিজভী ভাই। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে ছিল আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। চট্টগ্রামে এলে দেখা হতো তাঁর সঙ্গে। কথা হতো ফোনে। এত বড় মাপের মানুষটির মধ্যে কোনোদিন এতটুকু অহমিকা–বোধ দেখিনি। ছয়–সাতটি ভাষা জানতেন, কিন্তু নিজের ভাষা বাংলায় কথা বলতেন সম্পূর্ণ প্রমিত এবং বিশুদ্ধভাবে। অন্য কোনো ভাষার শব্দের মিশেল দিতেন না। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে হতো। রিজভী ভাইয়ের জন্ম ১৯৪৪ সালে কিশোরগঞ্জ শহরে। ১৯৬২ সালে বাবার ইচ্ছায় লন্ডনে যান চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেসি পড়তে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি ভর্তি হন অ্যাক্টরস স্টুডিওতে এবং ১৯৬৬ সালে অভিনয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এবং দুই বছর যুক্তরাজ্যের পেশাদারী মঞ্চ নাটকে কাজ করার পর ঢাকায় ফিরে এসে তৎকালীন পিটিভির ঢাকা কেন্দ্রে প্রথমে সহকারী প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ পদে উন্নীত হন। ১৯৭২ সালে পোল্যান্ড সরকারের বৃত্তি নিয়ে লড্্জ ফিল্ম স্কুলে পড়তে যান এবং ক্রমশ পোলিশ চলচ্চিত্র জগতে সংযুক্তি ঘটে তাঁর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে টিভির পাশ ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে যাতায়াতে সহায়তা করতেন তিনি এবং যুদ্ধের নৃশংসতার নানা তথ্য ও চিত্র বিভিন্ন বিদেশি প্রচার মাধ্যমে গোপনে সরবরাহ করতেন। ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির রাতে ঢাকার এক হাসপাতালে কর্মযোগী মানুষটির ৮১ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
১২ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রয়াত হলেন স্থপতি লাইলুন নাহার স্বেমি। বাংলাদেশের একজন অগ্রজ চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী ও সংগঠক। এক্ষেত্রে তিনি পাঁচ দশক ধরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। স্বেমি আপা ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সভাপতি। ২০১৪ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
ফেডারেশনের সহ–সভাপতি হিসেবে আমি তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর স্নেহপূর্ণ সান্নিধ্য সবার মতো আমাকেও আপ্লুত করে রাখতো। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। বিভিন্ন সময়ে চলার পথে আমাদের মধ্যে কোনো মতদ্বৈততা কিংবা মনোমালিন্য দেখা দিলে স্বেমি আপা তাঁর চমৎকার বুদ্ধিমত্তা ও আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে সেসব সমস্যার সুন্দর সমাধান করে নিতেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কঠোর ও অবিচল মনোভাব লক্ষ করতাম। অনেক সময় তাঁর নেয়া সিদ্ধান্ত অন্যদের মনঃপুত না হলেও তিনি অটল থাকতেন। পরে দেখা যেত, তাঁর সিদ্ধান্তই সঠিক। স্বেমি আপার এই অভিভাবকত্ব ও নেতৃত্ব বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার এই কঠিন দুঃসময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্বেমি আপা ছাত্রজীবনেই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে সংযুক্ত হন। প্রায় ছয় দশক জুড়ে অব্যাহত ছিল তাঁর এই চলচ্চিত্র চর্চা। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা মুহম্মদ খসরুর নেতৃত্বে। খসরু ভাই সম্পাদিত চলচ্চিত্র বিষয়ক বিখ্যাত পত্রিকা ‘ধ্রুপদী’র সঙ্গে সহ সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন ১৯৬৯ সালে। খসরু ভাইয়ের সম্পাদনায় ‘চলচ্চিত্রপত্র’ চলচ্চিত্র বিষয়ক অন্যান্য প্রকাশনায়ও লেখক, সহ সম্পাদক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি যুক্ত থেকেছেন। ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা তৈরি, জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, চলচ্চিত্র সেন্সর প্রথা বাতিল করে সার্টিফিকেশন আইন প্রণয়ন–এসব আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন।
লাইলুন নাহার স্বেমি ছিলেন এদেশের একজন অগ্রগণ্য স্থপতি। দেশে বিদেশে তাঁর অনন্য স্থাপত্যকীর্তির অনেক নিদর্শন তাঁর মেধা ও কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর হয়ে রয়েছে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি চলচ্চিত্রচর্চায় সমান মনোযোগী ও অগ্রবর্তী হয়ে থাকতেন যা কখনো ভূমিকা নিত একজন সক্রিয় কর্মীর, কখনো একজন নেতার, কখনো অভিভাবকের। ১৯৫৪ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকায় তাঁর জন্ম। পৈতৃক নিবাস গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনিজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। অসুস্থতাকে উপেক্ষা করেও তিনি কর্মব্যস্ত রাখতেন নিজেকে। ১২ ফেব্রুয়ারি রাতের প্রথম প্রহরে প্রয়াত হলেন আমাদের এই প্রিয় অভিভাবক।
জাহিদুর রহিম অঞ্জন বাংলাদেশের একজন নিষ্ঠাবান চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী ও নেতা। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ২০০৪–০৬ মেয়াদের সভাপতি। পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের স্নাতক। সফল একজন নির্মাতা। তাঁর অকাল প্রয়াণ বাংলাদেশের সুস্থ চলচ্চিত্রের চর্চা ও নির্মাণের ক্ষেত্রে বিরাট এক শূন্যতা সৃষ্টি করলো।
তরুণ বয়সে ছোট গল্প লিখতেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। তারপর যুক্ত হয়ে পড়েন চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সঙ্গে। অঞ্জনদার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘মেঘমল্লার’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা ছোট গল্প ‘রেইনকোট’ অবলম্বনে বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে নির্মিত ছবিটি সুধীমহলের প্রশংসা অর্জন করেছিল। প্রথম ছবির জন্যই তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন ২০১৬ সালে। এর অনেক আগে ১৯৯০ সালে আন্তন চেকভের গল্প অবলম্বনে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মর্নিং’ নির্মাণ করেন। এরপর অতীশ দীপঙ্করের জীবন ও কর্ম নিয়ে ২০০৭ সালে নির্মাণ করেন প্রামাণ্যচলচ্চিত্র ‘শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর’। প্রথম কাহিনীচিত্র ‘মেঘমল্লার’ নির্মাণ করেন ২০১৪ সালে। ছবিটি কানাডার টরন্টো, ভারতের গোয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ অবলম্বনে একই নামের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি শেষ করেছিলেন সম্প্রতি। এ ছবির সেন্সরও হয়ে গেছে। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ছবির মুক্তি দেখে যেতে পারলেন না নির্মাতা।
অঞ্জনের কাছে চলচ্চিত্র ছিল যাপিত জীবনের অংশ। চলচ্চিত্রকে জীবন থেকে আলাদা করে দেখা যায় না।
কথাগুলি প্রায়শই বলতেন তিনি। সিনেমাকে বিনোদনের বা বাণিজ্যের উপাদান হিসেবে মনে করতেন না। অসংখ্য গুণগ্রাহী মানুষের ভালোবাসায় সৃষ্টিমুখর এক জীবন যাপন করে গেছেন তিনি। চলচ্চিত্র ছিল তাঁর কাছে সৃষ্টিশীলতার অপরিহার্য এক উপাদান। বলতেন, একটি চলচ্চিত্রকে তার প্রাথমিক দর্শক সংখ্যার পরিমাপে মাপাটা অযৌক্তিক। কারণ সৃজনশীল ও শিল্পসমৃদ্ধ একটি চলচ্চিত্র দীর্ঘদিন ধরে দর্শকরা দেখতে থাকেন, প্রজন্মান্তরে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘দ্য আইডিয়া অব রিডিম্পশন ইজ অলওয়েজ গুড নিউজ, ইভেন ইফ ইট মিন্্স স্যাক্রিফাইস অর সাম ডিফিকাল্ট টাইমস।’
জাহিদুর রহিম অঞ্জনের সবচেয়ে সফল ক্ষেত্র ছিল তাঁর চলচ্চিত্র শিক্ষকতা। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি শিক্ষকতা করেছেন ঢাকার স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে। সেখানে তিনি অত্যন্ত শিক্ষার্থীপ্রিয় এক শিক্ষক ছিলেন। তৈরি করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিক্ষা ও নির্মাণের এক তরুণ প্রজন্ম যাঁরা তাঁর শিক্ষণ পদ্ধতির অতিশয় গুণগ্রাহী।
১৯৬৪ সালে তাঁর জন্ম। ২০২৫ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৬১ বছর বয়সে তাঁর অকাল প্রয়াণ এদেশের সুস্থ ধারার সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্রের যাত্রাকে বিঘ্নিত করেছে নিঃসন্দেহে। দীর্ঘদিন ধরে লিভারের অসুখে ভুগছিলেন। ভারতের বেঙ্গালুরুর এক হাসপাতালে কয়েকমাস যাবৎ চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অস্ত্রোপচারের কয়েকদিন আগেও তাঁর সঙ্গে ফেসবুকে কথা হয় আমার। চরম অসুস্থতার কথা বলেছিলেন। বলেছিলাম, সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। ফিরলেন। তবে নিথর হয়ে। অঞ্জনদার সঙ্গে ১৯৮৫ সাল থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন সময়ে দেখা হতো ঢাকায়। চট্টগ্রামেও এসেছেন অনেকবার। শেষবার এসেছিলেন ২০১৪ সালে ‘মেঘমল্লার’ ছবির প্রদর্শনীর সময়। দীর্ঘদিনের সম্পর্কের নানা স্মৃতি মনে পড়ে যায় চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো। রিজভী ভাই, স্বেমি আপা ও অঞ্জনদার স্মৃতিতে আন্তরিক শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি।