অজস্র নাট্যকর্মীর সহস্রদিবসের শ্রমে ঘামেপ্রেমে গড়ে উঠেছে আমাদের নাট্যসড়ক। এ–সড়ক কখনোই মসৃণ ছিল না। বন্ধুর নাট্যপথে দুরন্ত স্বপ্ন আর অপরিমেয় সাহস নিয়ে হেঁটেছে আমাদের নাট্যকর্মীরা। নাটককে ভালোবেসে তারা উজাড় করে সঁপেছেন নিজেকে। রৌদ্রতাপে হেঁটে হেঁটে নাটকের বন্ধুর প্রান্তরে খুঁজেছেন জীবনের পূর্ণতা। অনেকে ধ্রুপদী মেলবন্ধনে সহযাত্রীকেই করেছেন জীবনের ধ্রুবতারা। তখন তাদের কাছে সমার্থক হয়ে গেছে নাটক, জীবন আর সংসার। নাটকের মঞ্চকে ঘিরে তারা ছড়িয়েছেন শিল্প ও জীবনের সমূহ ডালপালা।
যুগপৎ নাট্য ও জীবনসাধনায় মগ্ন এই জীবনসঙ্গী নাট্যশিল্পীদের হার্দ্য সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে, সময়ের প্রয়োজন মেটাতে তাারুণ্যের শক্তিতে ভর করে সৃষ্ট, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ও তার অনালোকিত দিকসমূহ উপস্থাপনে প্রয়াসি স্কেচ গ্যালারি–নন্দন। সে প্রচেষ্টার প্রথম পর্বে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ শুক্রবার বিকাল ৫টায় নাট্যাঙ্গনের দুই নাট্যদম্পতি জোবায়দুর রশিদ–মাফতুহা মুনমুন এবং মোহম্মদ আলী হায়দার–সামিনা লুৎফা নিত্রাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত অগ্রজ নাট্যকার রবিউল আলম। আব্দুল্লাহ আল মামুন ও দিলরুবা জাহানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে দুই নাট্য দম্পতিকে অনুষ্ঠানে নীল খাম, প্রকাশনা, ভালোবাসি ভালবাসি টি শার্ট ও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় তানহা–তানশি ও আরিবা–জুবিয়া। স্কেচ গ্যালারি নন্দন–এর চেয়ার পারসন মানিক হোসাইন বলেন সময়ের প্রয়োজনে তারুণ্যের শক্তিতে ভর করে স্কেচ গ্যালারি নন্দন–এর পথ চলা শুরু ২০১৮ সালে। প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে তাদের প্রচেষ্টা সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ও তার অনালোকিত বিষয় সমূহ উপস্থাপন। সংস্কৃতি অঙ্গনের সকলকে নিয়ে স্কেচ গ্যালারি নন্দন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়। সংগঠনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর শাহরিয়ার হান্নান বলেন খুব পরিকল্পিতভাবে স্কেচ গ্যালারি নন্দন গঠিত হয়েছে তা নয়। ব্যক্তিগত আগ্রহে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় হতে ২০১৮ পর্যন্ত চট্টগ্রামের মঞ্চ নাটকের ছবির প্রদর্শনী “আলোকচিত্রে মঞ্চালোক” আয়োজন করার মাধ্যমে এর জন্ম। কিন্তু প্রথম আয়োজনে নাট্যাঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা ও উৎসাহ তাদের তা চলমান রাখতে প্রেরণা জোগায়। তার ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যে ১০ টি প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছে। মঞ্চায়ন করা হয়েছে ও হেনরির গিফট অফ দ্য মেজাই অবলম্বনে নাটক “ভালোবাসি ভালোবাসি”। চট্টগ্রামের নাট্য ব্যক্তিত্বদের জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মাণ করেছে প্রামাণ্য চিত্র। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সকলকে নিয়ে স্কেচ গ্যালারি নন্দন সামনে আরোও সৃষ্টিশীল কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়। নাট্যদম্পতি জোবায়দুর রশিদ–মাফতুহা মুনমুন এবং মোহম্মদ আলী হায়দার–সামিনা লুৎফা নিত্রার হাতে সম্মাননা তুলে দেন রবিউল আলম। নাট্য দম্পতি দর্শকের প্রশ্নোত্তরে তাদের নাট্য জীবন ও যাপিত জীবনের প্রতিক্রিয়া জানান।
জোবায়দুর রশীদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদালয় থেকে নাটক বিষয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে নাট্যকলা বিষয়ে প্রথম স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম নাট্যঞ্চলের স্বনামধন্য এই নাট্যজন ১৯৮১ সালে রূপকার নাট্যদলের মাধ্যমে নাট্যচর্চা শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার চট্টগ্রাম নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। তিনি সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) এর প্রতিষ্ঠাতা অর্থ–সম্পাদক সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এ সংগঠনের “কোষাধ্যক্ষ” পদে যুক্ত ছিলেন। নাটকের সংগঠন, নির্মাণ, শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার সাথে তিনি আজও নিবিড়ভাবে যুক্ত। বিগত ৩ দশকের অধিককাল ধরে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, চট্টগ্রামের এর নাট্য প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত আছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য অভিনীত নাটক হলো– হইতে সাবধান ডানসেন, প্রায়শ্চিত্ত, জনক, বহিপীর, আন্তিগোনে, সখিনার পালা, খোয়াব প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা প্রস্তাব, বায়োস্কোপ, ডানসেন, প্রায়শ্চিত্ত, জনক, জন হেনরী, বাসন, বহিপীর, সত্যসন্ধ, শেষরক্ষা, বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রো, দর্পণ প্রভৃতি। মাফতুহা মুনমুনের জন্ম চট্টগ্রামে। তাঁর পূর্বপুরুষের নিবাস বৈদ্যপাড়া বরিশাল। পিতা–মুহাম্মদ ইসমাইল হোসাইন, মাতা–রাজিয়া ইসমাইল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি নাট্যকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। চট্টগ্রামের মঞ্চে মাফতুহা মুনমুন সক্রিয় আছেন নাটকের অভিনয় এবং বিভিন্ন ডিজাইন পরিকল্পনা নিয়ে। অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট, থিয়ট্রেন রেপার্টরী, সমীকরণ থিয়েটার, থিয়েটার গিল্ড, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার প্রভৃতি সংগঠনে বিগত তিন দশক ধরে তিনি নাটকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছেন। তাঁর অভিনীত নাটক হলো মহেশ ও গফুর আমিনা সংবাদ, বহিপীর, আন্তিগোনে, সত্যসন্ধ, উন্মাদ সাক্ষাৎকার, দন্ডধর, মলকাবানু, মেঘ, অভিজ্ঞান শকুলেম, কবিয়াল রমেশ শীল, মৃচ্ছ কটিক, সত্যসন্ধ, নাট্যকারের বিপত্তি, সখিনার পালা, খোয়াব, সংকটে শয়তান, নয়া গরবা আইস্যে প্রভৃতি। বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নাট্যকর্মশালায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন পুরস্কার।
জোবায়দুর রশীদ এবং মাফতুহা মুনমুন উভয়েই নাটক–অন্তপ্রাণ। তাঁদের দুজনের ধ্যানে জ্ঞানে জড়িয়ে আছে নাটক। এই অভিন্ন মনন চিন্তন এবং নাটকের কর্মসূত্রে দুজনের কাছে আসার গল্পের সূত্রপাত। তারপর নিজেদের পছন্দ আর পরিবারের সম্মতিতে ১৯৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর দু’জন আবদ্ধ হন পরিণয়সূত্রে। তাঁদের ভালোবাসার উত্তরাধিকার– একমাত্র কন্যা রঙধনুকে নিয়ে জোবায়ের–মুনমুনের শিল্পীত সুখের সংসার।
মোহাম্মদ আলী হায়দারের জন্ম ১৯৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের কালীগঞ্জে। ১৯৯১ সালে যোগ দেন ঢাকার অন্যতম নাট্যদল সুবচন নাট্য সংসদে। সুবচন–এর রাষ্ট্র বনাম, খানদানী কিসসা, তীর্থঙ্কর, পাঁচ শয়তানের ব্লাড প্রেসার, ১৯৭১, বউ, টুয়েলফথ নাইট, রূপবতী, ক্ষুধিত পাষাণসহ আরো অনেক মঞ্চসফল নাটকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় করেছেন শিল্পকলা একাডেমি প্রযোজিত রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট এবং সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার–এর সত্যপীর নাটকে। সুবচনের অর্থ সম্পাদক, প্রশিক্ষণ সম্পাদক ও প্রযোজনা সম্পাদক ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে নির্দেশক হিসেবে মঞ্চে এনেছেন বাংলাদেশের অত্যন্ত সফল ও নন্দিত মঞ্চনাটক ‘খনা’ ও পথনাটক ‘পুশিক্যাট’।
সুবচনের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে ২০০৮ সালে কয়েকজন সতীর্থ মিলে গড়ে তোলেন নাট্যদল বটতলা–এ পারফর্মেন্স স্পেস। বর্তমানে তিনি দলটির নান্দনিক পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। অভিনয় করেছেন খনা, জতুগৃহ, মধুশিকারী, বন্যথেরিয়াম ও ধামাইল নাটকে। তাঁর নির্দেশিত বটতলার খনা, দ্য ট্রায়াল অফ মাল্লাম ইলিয়া, জতুগৃহ, মধুশিকারী, ক্রাচের কর্নেল, সখী রঙ্গমালা ঢাকার মঞ্চে ও পথে অত্যন্ত আলোচিত নাটক। যুক্তরাজ্যের থিয়েটার ফোকস–এ নির্দেশনা দিয়েছেন দুটি ইংরেজি নাটক ‘এ টেইল অফ টু ফ্রেন্ডস’ এবং ‘যমুনা’ যা একাধিক দেশে মঞ্চায়িত হয়েছে। তিনি অক্সফোর্ড থিয়েটার গিল্ড এর সদস্য এবং এ–দলের সাথে একাধিক নাটকে মঞ্চের পেছনে কাজ করেছেন। অভিনয় করেছেন একাধিক চলচ্চিত্রে। মোহাম্মদ আলী হায়দার একুশে টেলিভিশন, দুরন্ত টিভি, গ্রিন টিভিসহ একাধিক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ওটিটি চ্যানেল ‘বঙ্গ’–তে কর্মরত আছেন।
সামিনা লুৎফা নিত্রা একজন অভিনেত্রী ও নাট্যকার। বটতলা’র প্রতিষ্ঠাকালীন এ–সদস্য লিখেছেন তিন মঞ্চনাটক তীর্থঙ্কর, খনা এবং বাঁয়েন। এছাড়া যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন শেক্সপিয়র–এর টুয়েলফথ নাইট (আসাদুল ইসলামের সাথে), রূপান্তর করেছেন শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল এবং শাহীন আখতারের সখী রঙ্গমালা (সৌম্য সরকারের সাথে)। ইংরেজিতে লিখেছেন বীরাঙ্গনা (লীসা গাজীর সাথে), লিখেছেন পথনাটক জতুগৃহ এবং বৃক্ষ সম্মেলন বা পুরো ঐতিহাসিক। মঞ্চ নাটকে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে অভিনয়, কোরিওগ্রাফি, পোশাক পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন সুবচন, বটতলা, যাত্রিক, গ্যেটে ইন্সটিটিউট, কমলা কালেক্টিভ এবং ঢাকা আর্ট সামিটের সাথে। কর্মজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এ শিক্ষকের আগ্রহ পরিবেশগত ন্যায্যতা, নারীবাদ, রাজনৈতিক প্রতিবেশ, সামাজিক আন্দোলন, শ্রমিক অধিকার ও জনপ্রিয় সংস্কৃতি। তার জন্ম ১৯৭৬ সালের ১ জুন, ময়মনসিংহে।
মোহাম্মদ আলী হায়দার–সামিনা লুৎফা (নিত্রা) ১৭ মে ২০০২ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র সন্তান প্রাকৃত নৃ হায়দার।
নাট্যজন রবিউল আলম বলেন জীবনসঙ্গী নাট্যশিল্পী সম্মননা একটি ব্যতিক্রমী আয়োজন। এর মাধ্যমে নাট্যকর্মীদের কাজের যে সম্মান প্রদান করা হলো তা তাদের আরোও ভালো কাজ করার উৎসাহ যোগাবে। তিনি নাট্য দম্পতিদের শুভেচ্ছা জানান ও স্কেচ গ্যালারি নন্দন তাদের সৃষ্টিশীল কার্যক্রম চালিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
সম্মাননা প্রদান পর্বের নাট্যশিল্পী নওমান এ আলম খান গুড্ডু ও মুক্তা সরকার গান পরিবেশন করেন। উপস্থিত দর্শক তাদের পরিবেশনা উপভোগ করেন।
স্কেচ গ্যালারি নন্দন জীবনসঙ্গী নাট্যশিল্পী সম্মাননা ২০২৫ ছিল রেখা হাবিবুল্লাহ ও রাহাত রহমান লিমার স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত।