বাংলাদেশের আন্দোলন–সংগ্রামে নারীদের ভূমিকা ছিল বরাবরের মতোই অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ বিরোধী থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন; সবকিছুতে নারীরা ছিল সম্মুখসারিতে। সর্বশেষ জুলাই আন্দোলনেও নারীরা অসামান্য অবদান রেখেছে। এ আন্দোলনে রাজপথে অংশ নিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নানাভাবে আন্দোলনকে বেগবান করেছে নারীরা। জুলাই–আগস্ট ছাত্র–জনতার আন্দোলনে রাজপথে নারীদের কখনো রাগে কাঁপতে দেখা গেছে, কখনো দুঃখে কাঁদতে দেখা গেছে, চরম দুঃসময়ে সহায়তার হাত বাড়াতেও দেখা গেছে কখনো। অনেকে আহত হয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তবু প্রতিবাদী কণ্ঠ জারি ছিল তাদের। এছাড়া এখনো যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসের অগ্নিকণ্ঠে ‘আমার ছাত্রের মুখ চেপে ধরার সাহস কে দিয়েছে আপনাকে?’ সেই আওয়াজ কানে ভাসে। এখনো মনে পড়ে বাবাকে বলা কন্যার সেই কথা ‘বাবাকে বলে আসছি যদি মরে যাই, বিজয়ের পরে যেন আমার লাশ দাফন করে’। জুলাই আন্দোলনে এক মা পথের ধারে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের পানি দিচ্ছেন আর বলছিলেন ‘বাবা আমি অসুস্থ তোমাদের সাথে যেতে পারছি না। তোমাদের জন্য দোয়া করছি, বিজয়ের বেশে তোমরা ফিরে আসবে’। নারীদের এমন আবেগ–ভালোবাসা আন্দোলনে ছাত্র জনতাকে সাহস জুগিয়েছে। আন্দোলনকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল। আন্দোলনে কিশোরীরা সব সময় ছিল সম্মুখ সারিতে। সরকার পতনের দিন ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে সাভার থানা রোডে মারা যায় নাফিসা। একই দিন বেলা ১১টায় মিরপুর ২ নম্বর ওভারব্রিজের নিচে পুলিশের ছোড়া গুলি মাথায় বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় রিতা আক্তারের। সিদ্ধেশ্বরী নিউ সার্কুলার রোডে ১৪ তলার বারান্দায় ১৯ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে নিহত হন গৃহকর্মী লিজা আক্তার। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে আরও নিহত হন নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে ছয় বছর বয়সি রিপা গোপ, উত্তরায় চারতলার বারান্দায় নিহত হন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইমা সুলতানা। ২১ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সুমাইয়া সুমির মাথায় লাগে। সেখানে ঢলে পড়েন তিনি। ৫ আগস্ট টঙ্গীতে এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাফিসা হোসাইন মারওয়া নিহত হন। এরকম শতাধিক নারী–কিশোরী আহত–নিহত হন জুলাই আন্দোলনে।
কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতনের অভ্যুত্থানে পরিণত হওয়া আন্দোলনে নারীদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ ছিল। লাখো নারী রাজপথে নেমেছিলেন। নারীদের অংশগ্রহণ জুলাই আন্দোলনকে পূর্ণতা দিয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আজ বিশ্ব নারী দিবস। প্রতি বছর ৮ মার্চ পালিত হয় এ দিবস। বিশ্বব্যাপী একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদ্যাপন হয়ে থাকে। বিশ্বের একেক প্রান্তে নারী দিবস উদ্যাপনের প্রধান লক্ষ্য একেক রকম হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদ্যাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও নারীদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি বেশি গুরুত্ব পায়। নারী দিবসকে কেন্দ্র করে কয়েকজন নারীর সাথে কথা হয় আজাদীর। তারা তুলে ধরেন সমাজে এখনো কোন অবস্থায় রয়েছে। জুলাই আন্দোলনে নারীর ভূমিকা, নারীর নিরাপত্তার কথা বলেন তারা।
নারীদের এত জয়জয়কার হলেও এখনো নারীরা সমাজে অবহেলিত বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মোহনা বখতিয়ার মীম। তিনি বলেন, নারীরা আজও সমাজে নানা ধরনের অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। যদিও নারীর অধিকার রক্ষায় নানা আইন ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তবুও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, শিক্ষার সীমাবদ্ধতা, পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও যৌতুক এবং নিরাপত্তাহীনতাসহ নানাভাবে অবহেলিত নারীরা। তাই আমার মতে নারীর প্রতি অবহেলা দূর করতে হলে শিক্ষার প্রসার, আইনের কঠোর প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারীদের আত্মনির্ভরশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে নারীর প্রতি এই বৈষম্য দূর করতে। নারী দিবসের প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেন, সমাজে নারীরা সমান সুযোগ ও মর্যাদা পাক। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিক জীবনে বৈষম্য দূর হোক, নারীরা নিরাপদ ও স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারুক। শুধু বিশেষ দিনে নয়, প্রতিদিন নারীর অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত হোক–এটাই আমার চাওয়া।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সাজেদা ইসফাত রহমান সামান্তা বলেন, আগের তুলনায় অনেক এগিয়ে আসলেও অনেক ক্ষেত্রে নারীরা এখনো অবহেলিত। বাল্যবিবাহের থাবা থেকে এখনো আমরা মেয়েদের বের করে আনতে পারিনি, একজন মেয়ে ঘর থেকে বের হলে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এখনো আমরা ব্যর্থ। যার কারণে প্রতিনিয়ত সহিংসতা ও ধর্ষণের শিকার হতে দেখছি নারীদের। একজন নারী তার সম্মানের খাতিরেই সব চোখ বুঝে সহ্য করে, হয়তো কয়েকজন আওয়াজ তুলেন তবে বেশিরভাগ নেতিবাচক ঘটনা ভয়, পরিবার কিংবা সমাজের সম্মানের চিন্তায় চাপা পরে যায়। তিনি বলেন, এর থেকে উত্তোরণের জন্য যেমন প্রয়োজন আইনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন তেমন প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি। সকলের মাঝে এই বোধ তৈরি করা যে নারী পুরুষ একই বৃত্তের দুটি ফুল, আলাদা নয়। নারী এগিয়ে গেলে দশের এবং দেশেরই উন্নতি। কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা, আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পাশাপাশি নারীদের আত্মসচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে শুধু নারীই নয় পুরুষদেরও এই বিষয়টিতে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
নারী দিবসে নারীদের নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে চট্টগ্রাম যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করছি। কারণ এখন শিশু থেকে বৃদ্ধ মহিলা সবারই নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। আমরা সবাই অনিরাপদ এই সমাজে। তাই নারী দিবসে আমি চাই, নারীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। নারীরা যেন নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে এবং তাদের অধিকার রক্ষিত হয়। আমি চাই, সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীদের সকল অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। নারীদের মেধা ও শ্রমকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক।
জুলাই আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে থেকে চট্টগ্রামে আন্দোলনে ছিলেন ফাতেমা খানম লিজা। তিনি বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগরের মূখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকার স্মৃতিচারণ করেন। তিনি আন্দোলনের সময় বিভিন্ন হেনস্তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রথম চট্টগ্রামে ১১ জুলাই আমাদের ওপর হামলা করে পুলিশসহ আওয়ামী বাহিনী। এরপর অনেকবার আমাদের আহত হতে হয়েছে। আমরা ছিলাম সম্মুখ সারিতে। কোনো আঘাত আসলে আমরাই আগে সেটা বুক পেতে নিয়েছি। তিনি বলেন, আগামীতেও যদি দরকার হয় নারীরা রাজপথে নেমে আসবে। সামনের সারিতে থেকে আন্দোলন করবে। সকল অধিকার এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান থাকবে। নারী দিবসে তিনি প্রত্যাশা করেন সকল নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। তিনি বলেন, নারী দিবস উপলক্ষে আমরা একটি প্রোগ্রাম রেখেছি। বৈষম্যবিরোধী প্লাটফর্মের নারীদেরকে নিয়ে পথ শিশুদের মাঝে আমরা ইফতার বিতরণ করব এবং প্রেসক্লাবে একটি আলোচনা সভা করব। এতে নারীরা উপস্থিত থাকবে। সেখানে ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে আমরা ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, নিপীড়ন, অন্যায়–অত্যাচার সবকিছু তুলে ধরবো।