বর্তমান সময়ে যাঁরা লেখালেখি করছেন, তাঁদের প্রায় সবাই লিখছেন ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক। রম্য রচনা খুব কমই লেখা হচ্ছে। রম্য সাহিত্যিকরা হাসি–ঠাট্টা ও ব্যঙ্গ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বাস্তব কথাগুলো উপস্থাপন করেন। এবারের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হলো দৈনিক আজাদী সম্পাদক আবদুল মালেকের লেখা রম্যরচনা গ্রন্থ ‘উল্টো থেকে’–এর দ্বিতীয় মুদ্রণ। বইটির শুরুতেই আমরা পাই ‘পিন সমাচার’। ড্রেসিং টেবিল থেকে শুরু করে অফিস আদালত, বিয়ে বাড়ি, সিনেমা পাড়া–কোথায় তার সদম্ভ বিচরণ নেই! সূঁচের মতো শরীরে পিন কখনো নারীর পোশাকে চড়ে তো কখনো মানুষের মুখে মুখে চলে আবার কখনো ফাইল–পত্রে। ঠিক তেমনি ‘উল্টো থেকে’ পড়ে পাঠক অবশ্যই নিজেকে চিন্তা করে নেবেন একবার। ভাববেন, আরে! এতো আমিও ভাবি! যখন আমরা কোনো যানবাহনে থাকি তখন মনে হয় সব মানুষ রাস্তায় হাঁটছে। আবার যখন হাঁটি তখন গাড়িগুলোকে বিরক্তিকর মনে হয়। ভ্রুকুঞ্চন করে এইসব দৃশ্য আমরা প্রতিনিয়ত সহ্য করি। এই জায়গাতেই একজন লেখক অন্যদের চাইতে আলাদা হয়ে যান। তাঁর দৃষ্টির সূক্ষ্মতা যে অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ‘অ্যাকসিডেন্টলি অ্যাকসিডেন্ট’ এর শেষ লাইনে না যাওয়া পর্যন্ত পাঠকের মনে ভয়াবহ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। একটু পরে মনে হবে গল্পটি বড়ো করুণ। কিন্তু হাসপাতালে এসে সীমা ও রায়ানকে দেখে চমকে যাবেন এই ভেবে যে, প্রেমেও আছে শুভঙ্করের ফাঁকি! বেশ মজার রচনা ‘চক্কর’। আমাদের চট্টগ্রাম শহরেও একটি রিভলভিং রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কিন্তু লেখক যখন জাপানের মিউনিখ শহরের দুই হাজার ফিট উঁচু রিভলভিং রেস্টুরেন্টের কথা বলেছেন তখন হয়তো বাংলাদেশে এমন একটি টাওয়ার হবে কেউ চিন্তাও করেননি। মিউনিখ টাওয়ারে খেতে গিয়ে তাঁর যে মজার অভিজ্ঞতা, সেটি লেখক গম্ভীর মুখে বললেও পাঠকের মুখ গম্ভীর থাকে না। সেমসাইড শব্দটির চমৎকারভাবে যথার্থ অর্থে ব্যবহার হয়েছে ‘হাইজ্যাক’ রচনায়। প্রভাবশালী দুই হাইজ্যাক গ্রুপের মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার একটি দৃশ্য এখানে লেখা হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের সমস্ত খবর জানার জন্য ‘‘আন্দরকিল্লা’র মোড়ে বোম্বাইওয়ালার চায়ের দোকানের এক কাপ চা–ই যথেষ্ট। ট্রাফিক পুলিশ, ফুলের দোকান, ছাপাখানার অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে আমরা পেয়ে যাই আন্দরকিল্লা নামকরণের ইতিহাস। ক্রিকেটের আভিধানিক নাম ঝিঁ ঝিঁ পোকা শুনে লেখকের মতো আমরাও থতমত খেয়ে যাই। সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীন লেখকের ক্রিকেটের জন্ম ইতিহাস রচনা পড়ে মনে পড়ে যেতে পারে নিজেরও কোনো স্মৃতি। প্রকৃত প্রেম মানুষকে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। হোক না সে পরিবেশ বৈরী। ‘কিন্তু’ পড়ে আমরা তেমন একটি ঘটনা পাই। হাঁটতে যেমন আমাদের চরম অপত্তি তেমনি সিঁড়ি বাইতেও। বর্তমানে তিন চারতলায় উঠতে গেলে আমরা লিফট আছে কি–না সে খবর জেনে নিই। চিন্তা করেছেন ইফেল টাওয়ারের চূড়ায় কখনো সিঁড়ি বেয়ে উঠবেন? ‘উল্টো থেকে’র লেখক সেই অসাধ্যকে সাধন করতে যেয়ে লিখলেন ‘‘ই–ফেইল টাওয়ার’। টাওয়ারের চূড়া থেকে প্যারিস নগরীর সৌন্দর্য অবলোকন করার আকাঙ্ক্ষা সিঁড়ি, লিফট আর পায়ের ব্যথার কারণে মাঝপথেই জলাঞ্জলি দিতে হলো। এই বইয়ের আরো রচনা, লিভিং ট্র্যাজেডি, ছিলাম বোকা হইলাম বুদ্ধিমান, ট্র্যাজেডি, হাওয়াইন শার্ট, অথ বাস সমাচার, কাবুলিওয়ালা, একটি সেমিনারে ও বিরস ভাবনা – প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্য আলাদা। চলার পথের দৃশ্যগুলো তিনি পাঠকের জন্য চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। চট্টগ্রাম শহরের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। ‘একটি সেমিনার ও বিরস ভাবনায়’ তিনি ঠাট্টার ছলে কিছুটা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। বর্তমানের চট্টগ্রাম অনেক উন্নত। তবুও কিছু জায়গায় এখনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি।
আমরা অনেকেই সমরেশ বসুর ‘ছুটির ফাঁদে’ পড়েছি। পিকভোট যতোই কড়া বস হোন না কেন, তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও কোমল মনের একজন ব্যক্তিও বটে, উপন্যাসটি পড়ে আমরা সেই ধারণা পাই। আবার হুমায়ুন আহমেদ এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, দারিদ্র্যতাকে তিনি হাসিঠাট্টায় মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর লেখায়। দৈনিক আজাদী সম্পাদক আবদুল মালেক কখনো গম্ভীর কথা দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন না। তিনি মজার কোনো ঘটনা বা গল্প বলে শ্রোতাদের মনোযোগ সৃষ্টি করে তবেই তাঁর কথাগুলো বলেন। ‘উল্টো থেকে’ বইটিতেও তার প্রতিফলন পাই। সম্ভবত তিনি বহুবছর ধরে সঞ্চয় করা লেখাকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। কিছু কিছু বাক্যে সেটি বোঝা যায়। আবার অনেক হারিয়ে যাওয়া শব্দকে তিনি পুনরোদ্ধার করেছেন। যেমন মোটরগাড়ি, বলিহারি দুনিয়া, গগলস, নাসিকা রন্ধ্র, কর্ণকুহর ইত্যাদি। আমার মতে, এই শব্দগুলো কখনো পুরনো হয় না। এসব শব্দে অনুভূতির প্রকাশ যেভাবে হয়েছে হয়তো বর্তমানে ব্যবহৃত শব্দ লিখলে লেখার প্রকৃত ভাব প্রকাশিত হতো না। লেখক একজন সচেতন মানুষ। সুবক্তা। বইটি পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে কথাগুলো লেখক সরাসরি বলছেন। তাই কখনো হাসি, কখনো কিছুটা গম্ভীর, কখনো ভাবনা আক্রান্ত হবেন। উপস্থিত না থেকেও বইয়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে পাঠকের সামনে বসে যাওয়া সোজা কথা নয়। এটিই একজন লেখকের সার্থকতা।
‘উল্টো থেকে’ বইটির প্রকাশক কোহিনূর লাইব্রেরি। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ রফিকুন্নবী (রনবী), প্রথম প্রকাশ ১৪ই এপ্রিল ১৯৮৯। দ্বিতীয় প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।
লেখক : গল্পকার; সম্পাদক–অনন্য ধারা।