তারাবীহ’র নামায বিশ রাক্‌‘আত

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান | বুধবার , ৫ মার্চ, ২০২৫ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামএর সমস্ত উম্মত এ কথার উপর একমত যে, ‘তারাবীহ’র নামায বিশ রাকআত, আট রাক্‌‘আত নয়।’ অবশ্য যাদের নিকট নামায ভারী ও কষ্টকর, যারা নাফ্‌সের উপর বোঝা মনে করে তারাই ‘তারাবীহ্‌’র নামে শুধু আট রাক্‌‘আত পড়ে। আর তাদের পক্ষে কিছু সংখ্যক বর্ণনাকে বাহানাঅজুহাত সাব্যস্ত করে। এ জন্য বিশ রাকআত তারাবীহর পক্ষে অকাট্য প্রমাণাদি নিম্নে উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ বিশ রাক‘আত তারাবীহ্‌ পড়ারাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, সাহাবাই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ও আম মুসলমানদের সুন্নাত। (সুতরাং আট রাক‘আত তারাবীহ্‌ সুন্নাতের পরিপন্থী।) দলীলাদি নিম্নরূপ: হাদীস নম্বর ১: ইবনে আবী শায়বাহ্‌ ও ত্বাবরানী ‘কবীর’, বায়হাক্বী, আবদ্‌ ইবনে হুমায়দ এবং ইমাম বাগাভী সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন-‘নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পবিত্র রমযান মাসে বিশ রাক্‌‘আত পড়তেনবিত্‌র ব্যতীত। ইমাম বায়হাক্বী এতটুকু লিখেছেন– ‘জামা’আত ব্যতীত বিশ রাক’আত তারাবীহ্‌ পড়তেন’।” এ হাদীস শরীফগুলো থেকে বুঝা গেলো যে, খোদ্‌ হুযূরই আন্‌ওয়ার সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিশ রাক্‌’আত তারাবীহ্‌ পড়তেন। এও বুঝা গেলো যে, তারাবীহ্‌ ‘সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্‌ ‘আলাল ‘আয়ন।’ (অর্থাৎ শরীয়তের বিধানাবলী বর্তায় এমন প্রত্যেকের জন্যই তারাবীহ্‌র নামায সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্‌) কারণ, হুযূরই আক্‌রাম এ নামায সব সময় পড়েছেন এবং লোকজনকে উৎসাহ্‌ও দিয়েছেন।

হাদীস নম্বর: ইমাম মালিক হযরত ইয়াযীদ ইবনে রূমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেছেন-‘হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর যামানায় রমযানে লোকেরা তেইশ রাক্‌‘আত নামায পড়তেন।’ তারাবীহ্‌ বিশ রাকআত, বিতর তিন রাকআত।

হাদীস নম্বর: ইমাম বায়হাক্বী মা’রিফায় সহীহ সনদে হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদের সূত্রে বর্ণনা করেছেনতিনি বলেন, ‘আমরা (সাহাবীগণ) হযরত ওমর ফারুক্বের যামানায় (খিলাফতকালে) বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ ও বিত্‌র পড়তাম।’

হাদীস নম্বর : ইবনে মুনী’ হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেনহযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তুমি লোকজনকে রমযানের রাতে তারাবীহর নামায পড়াবে। কেননা, লোকেরা দিনের বেলায় রোযা রাখে এবং ক্বোরআন করীম উত্তমরূপে পড়তে পারে না। সুতরাং উত্তম হবে যদি তুমি তাদেরকে রাতে ক্বোরআন পড়ে শুনাও।” হযরত উবাই আরয করলেন, “হে আমীরুল মু’মিনীন, এটা ওই কাজ, যা ইতোপূর্বে ছিলো না।’’ তিনি বললেন, “আমি জানি; কিন্তু এটা উত্তম কাজ।’’ সুতরাং হযরত উবাই তাঁদেরকে বিশ রাক্‌‘আত পড়িয়েছেন।

হাদীস নম্বর : ইমাম বায়হাক্বী তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে হযরত আবু আবদুর রহমান সুলামী থেকে বর্ণনা করেছেনহযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রমযান শরীফে ক্বারীদেরকে ডাকলেন, তারপর একজনকে নির্দেশ দিলেন যেন পাঁচ তারাবীহ্‌ অর্থাৎ বিশ রাক‘আত নামায পড়ান। হযরত আলী তাঁদেরকে বিতর পড়াতেন।

হাদীস নম্বর ১০: ইমাম বায়হাক্বী হযরত আবুল হাসানা থেকে বর্ণনা করেনহযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন যেন তিনি পাঁচ তারাবীহ্‌ অর্থাৎ বিশ রাক‘আত নামায পড়ান। নমুনাস্বরূপ কয়েকটা হাদীস এখানে পেশ করা হলো। অন্যথায় বিশ্‌ রাক্‌‘আতের পক্ষে হাদীস শরীফ অনেক রয়েছে। আগ্রহ থাকলে ‘লুম্‌‘আতুল মাসাবীহ্‌ ফী রাক্‌‘আতিত্‌ তারাবীহ্‌’ এবং ‘সহীহুল বিহারী’ ইত্যাদি পাঠপর্যালোচনা করতে পারেন।

উম্মতের আলিমদের আমল: সবসময় প্রায়সব উম্মতের আমল বিশ্‌ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ পড়াই চলে আসছে। এখনো বিশ্বের সর্বত্রই এ আমল বলবৎ রয়েছে। এ পর্যন্ত হেরমাঈন শরীফাঈন ও সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানগণ বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ই পড়ে এসেছেন। তিরমিযী শরীফের রমযান মাসে ‘রাত জাগরণ করে ইবাদত করার বিবরণ’ শীর্ষক অধ্যায়ে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছেএবং অধিকাংশ আলিমের আমল এর উপরই, যা হযরত ওমর, হযরত আলী ও অন্যান্য সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম থেকে বর্ণিত অর্থাৎ বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌। আর এটাই হযরত সুফিয়ান সওরী, ইবনে মুবারক ও ইমাম শাফে‘ঈ আলায়হিমুর রাহ্‌মাহর অভিমত। ইমাম শাফে‘ঈ বলেছেন, ‘আমি মক্কাবাসীদেরকে বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ পড়তে দেখতে পেয়েছি।’ ‘ওমদাতুল ক্বারী শরহে বোখারী’: ৫ম খণ্ড: ৩৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে– ‘ইবনে আবদুল বার বলেন, বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ই প্রায় সব বিজ্ঞ আলিমের কথা। এটাই কূফী হযরতগণ, ইমাম শাফে‘ঈ এবং অধিকাংশ আলিম ও ফক্বীহ্‌গণের অভিমত। বস্তুত এটাই বিশুদ্ধ কথা। এটা হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত। এ’তে সাহাবীগণের কোনো বিরোধ নেই।” মাওলানা আলী ক্বারী ‘শরহে নিক্বায়াহ্‌’য় বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ সম্পর্কে বলেনবিশ রাক্‌‘আত তারাবীহর উপর মুসলমানদের ইজমা’ (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেননা, ইমাম বায়হাক্বী সহীহ্‌ সনদে বর্ণনা করেছেন যে, সাহাবাই কেরাম ও সমস্ত মুসলমান হযরত ওমর, হযরত ওসমান ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমের যমানায় বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ পড়তেন। আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামী বলেছেনসমস্ত সাহাবী এ কথার উপর একমত যে, তারাবীহ্‌ বিশ রাক্‌‘আত।

উপরিউক্ত বরাতগুলো থেকে বুঝা গেলো যে, বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামএর সুন্নাত। বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহর উপর সাহাবাই কেরামের ইজমা’ হয়েছে। বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ পড়া আম মুসলমানদের আমল। বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ হারামাঈন শরীফাঈনে পড়া হতো। বিশ্‌ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ বিবেক ও যুক্তির অনুরূপ। বিশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ ক্বোরআনের রুকূ’গুলোর সংখ্যানুরূপ। জানিনা, যারা আট রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ পড়ে তারা কার অনুসরণ করে? আট রাক্‌‘আত কিংবা দশ রাক্‌‘আত তারাবীহ্‌ তো সুন্নাতে রসূলের বিরোধী, সুন্নাতে সাহাবার পরিপন্থী, মুসলমানদের সুন্নাতের বরখেলাফ। ওলামামুজতাহিদীনের সুন্নাতেরও বিপরীত; বরং মনের কুপ্রবৃত্তিরই অনুরূপ। কারণ, নামায নাফ্‌সে আম্মারার উপর বোঝা স্বরূপ। মহান রব নাফসে আম্মারার ফাঁদগুলো থেকে মুক্ত করে সুন্নাতে রসূলের উপর আমল করার তাওফীক দিন। আমীন।

লেখক: মহাপরিচালকআনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ