দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৫ মার্চ, ২০২৫ at ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

রানওয়ে ধরে ছুটছিল আমাদের বোয়িং। পথের নানা ঝক্কি সামলে বিমানটি ঠিকঠাকভাবে অবতরণ করায় যাত্রীদের সকলের পরাণে যে পানি এসেছে তা কেবিনে আলো জ্বালানোর সাথে সাথে টের পেলাম। বিমান মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে দারুণ একটি ব্যাপার ঘটে, আর তা হলো ফোনগুলো নানা ঢঙে বাজতে থাকে। চীনের বাজারেও আই ফোনের জয়জয়কার রিংটোন শুনেই বুঝতে পারছিলাম।

ঘড়ি না থাকলে রাতের গভীরতা টের পেতাম না। রাত চারটা বেজে গেছে! একটি ঝড় কেমন করে যে আমাদের রাতটি পথে খেয়ে ফেললো তা টের পাচ্ছিলাম হাড়ে হাড়ে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। চীনের ৪টা মানে আমার বডি ক্লকে ৬টা। গভীর ঘুমের সময়। চীনে কয়েকদিন হয়ে গেলেও বডি ক্লক যে এখনো ঠিকঠাকভাবে চীনকে মেনে নেয়নি তা রাত নামার পরই টের পাই।

ধীরে ধীরে এগুচ্ছে বোয়িং। বোর্ডিং ব্রিজের দিকে এগুচ্ছে। তাও ভালো যে সরাসরি বোর্ডিং ব্রিজে গিয়ে দরোজা খোলা হবে। এতো রাতে বাসে চড়ে টার্মিনালে পৌঁছাতে হলে মেজাজ আরো বিগড়ে যেতো। অন্যান্য যাত্রীদের পাশাপাশি আমরাও কেবিন থেকে বের হয়ে এলাম। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নেই, শুধু লাগেজটি টেনে নিলেই হবে। এরপর আবারো পথে নামতে হবে। সেই পথ কতদূর কে জানে!

বিমানবন্দরে প্রচুর লোক। চারদিক থেকে ফ্লাইট মিস হওয়ায় সবগুলো বিমানই যেনো এই ভোররাতে এসে গুয়াংজুর মাটি স্পর্শ করেছে। অনেকগুলো লাগেজ বেল্ট, প্রায় সবগুলোই ঘুরছিল। বিমান থেকে নামার আগেই পাইলট আমাদের লাগেজ কত নম্বর বেল্টে থাকবে তা বলে দিয়েছিলেন। আমরা সেই বেল্টেই ঠাসাঠাসি করে অপেক্ষা করছিলাম। প্রচুর লোক স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করছেন, অপেক্ষা করছেন হোটেল এবং ট্যুর গাইডের লোকজনও। রাত হলেও বিমানবন্দর ছিল বেশ কর্মচঞ্চল। বিভিন্ন বিমান থেকে নামা যাত্রীরা বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ ফোনে কথা বলছেন, লাগেজ নেই এমন যাত্রীরা দ্রুতগতিতে হেঁটে বের হয়ে যাচ্ছেন।

গুয়াংজুর এই বিশাল বিমানবন্দরকে বলা হয় দক্ষিণ চীনের প্রধান আকাশদ্বার। অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধার জন্য এই বিমানবন্দরটি বিখ্যাত। এটি চীনের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যাতায়াত করে। চারদিকে গ্লাসআচ্ছাদিত আধুনিক স্থাপত্য, উজ্জ্বল আলোর বাহার, আর ডিজিটাল সাইনবোর্ডগুলো এমনভাবে সাজানো যেন মনে হয় কোনো সাইফাই মুভির ভেতর চলে এসেছি। বিমানবন্দরের বিশাল ছাদ চোখে পড়ল ঢেউয়ের মতো বাঁকা, যেন চীনের ঐতিহ্যবাহী প্যাগোডার আধুনিক সংস্করণ।

কাচের দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল, বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে আমি লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবীসহ একপাশে দাঁড়ালাম। আমাদের প্রটোকলে থাকা জ্যাক টেকনোলজির কর্মকর্তা শাসা ও ফ্রাঞ্চি কাকে যেনো ফোন করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের গাড়ি এসে হাজির হলো। জ্যাকের অফিসার বহনকারী একটি বাস। বেশ সুন্দর। প্রথম দেখায় গাড়িটি ভালো লাগলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, দুই সিট নিয়ে ঘুম দেবো। পরে যা হবার হবে!

আমরা মাত্র কয়েকজন মানুষ, পুরো গাড়িই অনেকটা খালি। সুতরাং আমার দুই সিট পেতে কোন সমস্যা হলো না। গাড়ি ছুটতে শুরু করল শহরের দিকে। ভোরের গুয়াংজু তখনো ঘুমিয়ে। রাস্তায় খুব বেশি ভিড় নেই, শুধু মাঝে মাঝে কিছু ক্যাব ও বাস ছুটে চলেছে। বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার পার হচ্ছি, মাঝে মাঝে ঝলমলে এলইডি বিলবোর্ড চোখে পড়ছে।

শহরের মূল অংশে ঢুকতেই পাশ দিয়ে ভেসে যেতে লাগল উঁচু উঁচু ভবন। মনে হচ্ছিল যেন আকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটি কাচে মোড়া, কোনোটি ঝলমলে লাইটিং দিয়ে সাজানো, আবার কিছু ভবনে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে চীনা স্থাপত্যের ঐতিহ্য। রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ, কোনো কোনো স্থানে ছোট্ট পার্ক, এই ভোররাতেও জনশূণ্য পার্কগুলো আলোকোজ্জ্বল।

একসময় শহর পেছনে ফেলে মনে হচ্ছিলো কোন পাহাড়ী অঞ্চলে ঢুকে যাচ্ছি। চারপাশে অসংখ্য গাছগাছালী, ক্রমশ সবুজের বিস্তার বাড়ছে। রাস্তার দুপাশে ঘন বন, মাঝে মাঝে টিলা, আর সরু বাঁক নেওয়া রাস্তা। মনে হচ্ছিল, আধুনিক নগরী থেকে প্রকৃতির কোনো রহস্যময় অঞ্চলে প্রবেশ করছি।

কিন্তু এই নিশুতি রাতে কোথায় যাচ্ছি আমরা! দুই সিট নিয়ে ঘুমানোর প্ল্যান করে বাসে চড়লেও ঘুম উবে গেছে। গুয়াংজু শহরের গভীর রাতের এক অপরূপ রূপ যেনো আমাকে কেবলই মুগ্ধ করছিল এতোক্ষণ। কিন্তু এখন আবার বনজঙ্গল দেখে কেমন কেমন যেনো লাগতে শুরু করে।

দুইপাশের বনবনানী পেছনে ফেলে আমরা সামনে এগুচ্ছিলাম। বেশ বড়সড় একটি গেটের সামনে এসে আমাদের বাসটি থামলো। গেট বন্ধ। গাড়ির তীব্র লাইটের আলোতে দুইজন গার্ড এগিয়ে এলেন। তারা চালকের সাথে কথা বলে গেটের কপাট খুলে দিলেন। আমরা যেনো আরো গভীর বনের দিকে এগুতে থাকলাম।

অল্পক্ষনের মধ্যেই আমাদের বাস থামলো। কিন্তু আমি রীতিমতো বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। গাড়ির লাইটের আলোতে যতটুকু দেখা যাচ্ছিলো তাতে শুধু অরণ্য আর অরণ্য দেখছিলাম। আর আমাদের বাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকৃতির চারটি হাতি! ভীষণ ভয় পেলেও সবার সাথে বাস থেকে নেমে এলাম। বাস থেকে নামার পর বুঝতে পারলাম যে, হাতিগুলো আসল নয়, বরং পাথরের তৈরি। কি নিখুঁত নির্মাণ, একেবারে তরতাজা হাতির মতো মনে হচ্ছিলো। চোখগুলোও জ্বল জ্বল করছিল! আমাদেরকে বলা হলো, এটিই আমাদের হোটেল। এখানেই আমরা তিনদিন থাকবো। বুঝতে পারলাম না, জ্যাক আমাদেরকে শুধু জঙ্গলে জঙ্গলে রাখতে চাচ্ছে কেন!

করিম ভাইয়ের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সময় পাশ থেকে ফ্রাঞ্চি বললো, এটি সিক্সস্টার হোটেল। গুয়াংজুর অন্যতম অভিজাত হোটেল এটি।

হোটেলের রিসেপশনে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল। আমি হোটেলটির আলীশান ভাব দেখে চমকে গেলাম। দেয়ালজুড়ে বন্যপ্রাণীর শিল্পকর্ম, ছাদ থেকে ঝুলে থাকা লতাগুল্মের মতো ডিজাইন, আর বিশাল কাঁচের জানালা দিয়ে রাতের বনের দৃশ্য যেন একেবারে সামনে হাজির! রিসিপশন ডেক্সটাও দেখার মতো। হোটেলের মুল কাঠামোর ভিতরে বড়সড় একটি ঘর। সেটিকে পুরোপুরি গাছগাছালি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। বুঝতে পারছিলাম গাছগুলো কৃত্রিম, তবুুও নান্দনিকতা মন ছুঁয়ে গেলো। রিসিপশন ডেক্সের চারদিকেই মুখ। অর্থাৎ চারদিক থেকেই চেক ইন বা চেক আউট করার সুযোগ রয়েছে। এতে বুঝতে পারছিলাম যে, হোটেলটি কী পরিমান ব্যবসা করছে। কত মানুষকে সামাল দিতে হলে এমন চতুর্মুখী ডেক্স বানানোর প্রয়োজন পড়ে!

রিসেপশনের সুন্দরী চীনা কর্মচারীরা হাসিমুখে স্বাগত জানাল। ফ্রাঞ্চি আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে এক চীনা সুন্দরীর হাতে দিলো। অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে রুমকী দিয়ে দেয়া হলো। লাগেজ বেলবয়’কে বুঝিয়ে দিয়ে ক্লান্ত শরীরে রুম কোনদিকে জানতে চাইলাম। দেয়ালে এ্যারো মার্ক দিয়ে বিভিন্ন নম্বরের রুমের নির্দেশিকা দেয়া হয়েছে। সেটি অনুসরণ করে সামনে এগুতেই আমি মুল ভবনটি থেকে বেরিয়ে গেলাম। ছোট্ট একটি সিঁড়িপথ ডিঙ্গানোর পর পুরো জঙ্গলের ভিতরে অপর একটি ভবন। সেই ভবনটির পাঁচতলায় আমার রুম। কী এক যন্ত্রণা! এতো এলোমেলো পড় মাড়ানো যায়!

উপায় নেই, রুমে যেতে হলে এসব ঝক্কি সামাল দিতে হবে। একপর্যায়ে বিশাল লিফটে চড়ে নিজের রুমের হদিশ করে নিলাম। রুমে ঢুকেই আমার মনটি ভালো হয়ে গেলো। সিক্স স্টার হোটেলের আবহ রুমের পরতে পরতে। নান্দনিকতা ছড়িয়ে রয়েছে রুম, ওয়াশরুম, ছোট্ট বারান্দাসহ সর্বত্র। নানা সামগ্রিতে সাজানো রুম, ধবধবে সাদা তুলোর মতো নরোম বিছানা ছাড়া, ওয়াশ রুমের তোয়ালেগুলো মন ভরিয়ে দিল। টুথ ব্রাশগুলোতেও রয়েছে বনের ছোঁয়া। গাছ গাছালী এবং বণ্যপ্রাণীর আদল দেয়া ব্রাশ, বাচ্চাদের ব্রাশ কার্টুন আদলের। চিরুনি, সাবান, স্যাম্পু, বডিলোশন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বন এবং প্রকৃতিকে এক অনন্য রূপ দেয়া হয়েছে।

সকালে সব ভালো করে দেখার ইচ্ছে রেখে কোনরকমে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম, ঢুকে গেলাম তুলতুলে নরোম লেপের ভিতরে। কখন যে ঘুমের দেশে হারিয়ে গিয়েছিলাম মনে নেই। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর জানালার পর্দা সরাতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল! বিশাল জানালা দিয়ে দেখা গেল ঘন সবুজ বন। বনকে বনের আদলে রেখে তৈরি করা হয়েছে হোটেলের এক একটি ভবন! শতবর্ষী গাছগুলোকে অক্ষত রেখে তৈরি করা হয়েছে কাঠের পথ, ছোট্ট ঝুলন্ত ব্রিজ, আর ঢালু করে নির্মিত সিঁড়ি। প্রকৃতিকে কোনরকমে বিরক্ত না করে এমন বিলাসবহুল হোটেল আমি আগে কখনো দেখেছি কিন মনে করতে পারছিলাম না। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাসন্তী সন্ধ্যায় পূর্ণিমার আলো
পরবর্তী নিবন্ধতারাবীহ’র নামায বিশ রাক্‌‘আত