কর্ণফুলী নদী শুধু চট্টগ্রামবাসীর নয়, এটি সমগ্র দেশের প্রাণভোমরা। কর্ণফুলীর স্রোত, নাব্যতা ও পানি আমাদের অর্থনীতির প্রাণ।এ নদীর প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া, নদীকে জীবন্ত রাখা দেশের সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী বর্তমানে দখলে দূষণে বিপর্যস্ত। নানাভাবে দখল হয়েছে নদী এবং এখনো হচ্ছে। আমরাই লিখেছি আজাদীতে, ‘দূষণ থেমে নেই বহু বছর ধরে। অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে নদী উদ্ধারে বিভিন্ন সময় বহু আলোচনা হয়েছে। উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। শোনা গেছে, অনেক প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস বাণী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ কথা রাখেনি। বিপর্যস্ত কর্ণফুলীর শেষরক্ষা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কর্ণফুলী গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা’। কর্ণফুলী নদীতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বাধা এসেছে। তবে আশার সংবাদ এই, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। এর ফলে ওই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আর কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন রিটকারী পক্ষের আইনজীবী। গত রোববার জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ এ রায় দেয়। রিটকারী সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনিক আর হক এবং জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাহবুব উদ্দীন খোকন।
মনজিল মোরসেদ বলেন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী রক্ষায় জনস্বার্থে এইচআরপিবি একটি রিট আবেদন দায়ের করে। শুনানি শেষে হাই কোর্ট রায়ে নদীর ভেতরে থাকা সব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নোটিস দেন। ওই নোটিস পাওয়ার পর জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি হাই কোর্ট একটি রিট দায়ের করে এবং স্থিতাবস্থার আদেশ পায়। রিটে এইচআরপিবি পক্ষভুক্ত হয়ে রিট খারিজের আবেদন জানায়।
তিনি বলেন, শুনানি শেষে হাই কোর্ট রায়ে বলে, হাই কোর্টের দেওয়া কর্ণফুলী নদী রক্ষার রায়ের নির্দেশনা পালনে কোনো বাধা নেই। রায়ের বিরুদ্ধে জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি আপিল বিভাগে যায়, যা খারিজ হয়ে গেল। এখন কর্ণফুলী নদীতে জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আর কোনো বাধা রইল না।
বলা জরুরি যে, জনসাধারণের অসচেতন ও বেপরোয়া ব্যবহারে দিন দিন কর্ণফুলী নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। দখল ও ভরাটের করাল গ্রাসে এই নদীর মতো অনেক নদী মরে গেছে। নদী বাঁচলে জীবন বাঁচবে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই নদীকে বাঁচাতে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্ণফুলীতেই চট্টগ্রাম বন্দর। দেশে চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো বিকল্প বন্দর নেই। দখল–দূষণে কর্ণফুলী যদি গতিপথ হারায় তখন বন্দর বন্ধ হয়ে যাবে। তাই কর্ণফুলী রক্ষায় সকল আয়োজন চট্টগ্রাম বন্দরকেই করতে হবে।
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারলে কর্ণফুলীর দখল থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত করার প্রয়াস চালানো যাবে। কর্ণফুলী নদী গবেষকরা বলছেন, কর্ণফুলী সুরক্ষায় এ মুহূর্তে দু’টি বিষয় জরুরি। এক. দূষণরোধ এবং দুই. অবৈধ দখলকৃত স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ। অভিযোগ উঠেছে, কর্ণফুলী ভরাট করে ভূমির ব্যবসা চলছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমির দাম বৃদ্ধির সুবাদে জমির ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় এই অপতৎপরতাও বেড়ে গেছে। গবেষকদের অভিযোগ, কর্ণফুলীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দিলেও সেই আদেশ লঙ্ঘন করে নদীকে হত্যা করা হচ্ছে। এই নদীর সঙ্গে দুই কোটির বেশি মানুষের জীবনজীবিকা জড়িত। শহরের সকল বর্জ্য এসে পড়ছে নদীতে। এটি জলজ বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতি। উন্নত শহরে এসব নেই। চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, বন্দর ও জেলা প্রশাসনকে দিয়ে এই নদীকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষজ্ঞদের দাবি, কর্ণফুলীর দুই পাড়ে যেসব বেসরকারি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে।